এক অন্তঃপ্রাণ কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন
জন্ম মানেই সৃষ্টির অপার সম্ভাবনা। প্রত্যেক মানুষের একটি স্বপ্ন থাকে। আর জন্ম থেকেই এর শুরু। কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন মনে করেন, মানুষ তাঁর স্বপ্নের মতো বড়। এ জন্যই সে বাঁচতে পারে। পৌরাণিক ফিনিক্স পাখির মতো তিনি তাঁর শব্দগুলো জাদুবাস্তবতায় জীবিত করেন, আবার মৃত্যুর মুখে দাঁড় করিয়ে দেন। অমানবিকতার মধ্যেই মানবিকতার গল্প তৈরি হয়। তাই বাংলাদেশের ক্যানভাসকে তিনি দীর্ঘ ও আলোকিত করতে চান। ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যাহা তাহা সব সত্য নহে।’ রবীন্দ্রনাথের কবিতার এই চরণ তিনি ধারণ করেন। তাঁর কাছে ভালোবাসার, বেদনার, একাকিত্বের আলাদা রং নেই। সে জন্য সমান গুরুত্বের সঙ্গে এ বিষয়গুলো তাঁর কবিতায় স্থান পায়। ইংল্যান্ডের এক দার্শনিকের কবরে লেখা ছিল— ‘আমার হৃদয় কিছু দিতে চায়। কারণ, আমি সমাজ থেকে অনেক পেয়েছি।’ কবি স্টালিনও সমাজকে দিতে চান।
একজন সমৃদ্ধ মানুষ শুধু তাঁর পেশার মধ্যে হারিয়ে যান না, তিনি শিল্প–সাহিত্য, দর্শন, সংগীত, চিত্রকলাসহ বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন এবং সংশ্লিষ্ট থাকেন সমকালীন শিল্পচিন্তার সঙ্গে। রেজাউদ্দিন স্টালিনও কবিতার সঙ্গে প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, ছড়া সাক্ষাৎকারসহ সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় বিচরণ করেছেন।
এই বরেণ্য কবি ২০০৫ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান। এ ছাড়া তিনি মাইকেল মধুসূদন পুরস্কারসহ বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছেন।
চার দশকের বেশি সময় ধরে স্টালিন সাহিত্যচর্চা করছেন। মাত্র আট বছর বয়সে পত্রিকায় তাঁর কবিতা ছাপা হয়। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ফিরিনি অবাধ্য আমি’। এ পর্যন্ত কবি রেজাউদ্দিন স্টালিনের ৬০টি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থের নাম—‘একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে’। তিনি দেশের অন্যতম জনপ্রিয় কবি। পৃথিবীর নানা ভাষায় তাঁর কবিতা অনুবাদ হয়। এভাবে বাংলা কবিতাকে তিনি বিশ্বের পাঠকের কাছে উপস্থাপনে ভূমিকা রাখছেন।
কবিতার স্বাধীনতা চিরন্তন। কবি ও কবিতার কোনো সীমানা নেই। রেজাউদ্দিন স্টালিনও সীমানা মানেন না। নোঙরবিহীন তাঁর যাত্রা। সব ছেড়ে অসীমের পানে ছুটতে থাকেন। তাঁর অনুভব, কল্পনা ও বিষয়ের বৈচিত্র্য আছে। তাঁর কবিতায় যেমন বাংলার আকাশ, রোদ, বৃষ্টি, জোছনা আছে, তেমনই বৈশ্বিক মানবতার উত্থান-পতন, ভাঙা-গড়া, আনন্দ-বেদনার গল্প আছে।
রেজাউদ্দিন স্টালিনের একেকটি কবিতা যেন জীবনের একেকটি গল্প। সাধারণ বিষয়গুলো কবিতায় হয়ে ওঠে অসাধারণ। রাষ্ট্রব্যবস্থার নানা বৈষম্য, অনাচার ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁর কবিতা সোচ্চার। আবার সেই একই কবিতায় পরম মমতায় ধারণ করেন প্রেম, বিরহ, দুঃখ-বেদনা এবং দেশ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা।
সাহিত্যে বিলাসিতার জায়গা নেই। এক অকল্পনীয় প্রতিভার অধিকারী হয়েও রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এর সাধনা করেছেন। কবি স্টালিনও নিরন্তর ভাবনা, লেখালেখি ও চর্চার মধ্যে থাকেন। অক্ষর ও শব্দের মধ্য দিয়ে জীবনকে দেখেন। যিনি লেখেন, তিনি সময়কে লেখেন, জীবনকে লেখেন, মহাকালকে লেখেন এবং দিন শেষে নিজেকেই লেখেন। যাঁর শব্দ ছাপা হয়, তাঁর জীবন সৃষ্টি হয়। এসবই কবি স্টালিনের অন্তরের অনুসঙ্গ কবিতায় চিত্রিত।
বড় মানুষেরা সাধারণত বিনয়ী, নিরহংকার ও নির্বিবাদী হয়ে থাকেন। কবি স্টালিনের মধ্যেও এটা দেখা যায়। দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে তিনি অনন্য। তাঁর ভাবনা, দেশপ্রেম কাউকে দেখানোর বিষয় নয়। এটা বুকের গভীরে লালন করতে হয়। এ দেশের মানুষ চিরকাল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সুবিচার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। এসব মানুষের কথাই তাঁর কবিতার কথা।
কেউ যদি কোনো কিছু গভীরভাবে বিশ্বাস করে, তাহলে সে তা অর্জন করে। তিনি যখন বলেন—
‘শুধু আমি সবকিছু ঠিক করে উঠতে অপারগ,
ঘড়িকে ঠিকমতো নাস্তা দিতে পারি না।
জুতোর দাঁত মাজতে ব্রাশ কেনা হয় না এবং
চশমার জন্য একটা ফ্লাট।
অপেক্ষা করছি
ভাবছি হয়তো একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।’
স্টালিনের আধুনিক কাব্যচিন্তা নিরাশার মধ্যে আশাবাদের জায়গা করে দেয়, যেখানে চশমার একটা ফ্লাট দরকার। প্রতীকের এমন আশ্চর্য আয়োজন আমাদের কৌতূহল বাড়িয়ে দেয়। রেজাউদ্দিন স্টালিন সেই অনন্য কবিদের একজন, যাঁর প্রতিটি কবিতা বিষয় ও প্রকরণে আলাদা।
প্রতিনিয়ত মানুষকে আশা-হতাশার, অর্জন-বিসর্জনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। লালনের গানে আছে, এমন মানবজীবন আর হবে না। কবি স্টালিনও মনে করেন, যা করতে হবে তা এই এক জীবনেই। নিরবধি সেভাবেই নিজেকে প্রস্তুত করেন।
স্টালিনের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আছে। তিনি এমন দেশ চান না, যেখানে একদল লুটেরা নদী, খালবিল, পাহাড় দখল করবে। রাজার কোষাগারে নাগরিকের জমা টাকা নিয়ে যাবে বাজিকর। তলস্তয়ের ‘আন্না কারেনিনা’ উপন্যাসে আছে, ‘সব সুখী মানুষ একই রকম। কিন্তু অসুখী মানুষগুলো যার যার মতো করে আলাদা।’ তাঁর কবিতায় পাওয়া যায় এই অসুখী মানুষের বেদনার ন্যারেটিভ।
রেজাউদ্দিন স্টালিন প্রকৃত পক্ষে জীবনবাদী কবি। তাঁর কবিতায় রয়েছে মানবমুক্তির কথা এবং গভীরতর সমাজ বিপ্লবের সংকেত।
রাষ্ট্র বেশির ভাগ সময় ভুলে যায় ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য’, ভুলে যায় যে একজন মানুষকেও দুঃখ দিয়ে অপমান করা উচিত না। কবি স্টালিনও মনে করেন, একজন মানুষ রাষ্ট্রনায়ক, কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক—যা-ই হতে চান না কেন, প্রথমেই তাঁকে ভালো মানুষ হতে হবে। এই মানুষই তাঁর কবিতার প্রধান বিষয়। তিনি জানেন, মানুষের শক্তিই বড় শক্তি। সব জায়গায় ভালো মানুষ আছে। অধিকাংশ মানুষই শুভবাদের পক্ষে। তাদের চেষ্টায় একদিন সুন্দর বাংলাদেশ নির্মিত হবে।
এক সাধক তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন, ‘নিজের প্রদীপ নিজে হও।’ কবি স্টালিন সব সময় নিজেকেই সমৃদ্ধ করে চলেছেন। তাই নিরন্তর নিজের সঙ্গে তাঁর নিজেরেই লড়াই। প্রতিনিয়ত নিজেকে ভাঙেন, গড়েন, নতুন করে নির্মাণ করেন। তিনি মনে করেন, জীবনে হারানোর কিছু নেই। যেকোনো জায়গা থেকে জীবন শুরু করা যায়। রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ কাব্যনাটকে আছে, ‘মেঘ ক্ষণিকের। এ মেঘ কাটিয়া যাইবে…, চিরদিবসের সূর্য উঠিবে আবার…।’ তিনি জানেন, ভালো সময় আসবেই। তাই দুঃসময়ে পথ হারান না।
নিজেকে বিকশিত করার ভালো দিক বই পড়া ও ভ্রমণ। তিনি গ্রিক পুরাণ থেকে সাহিত্যের প্রায় সব বিষয় জানার চেষ্টা করেন। ভারত, নেপাল, চীন আমেরিকাসহ নানা দেশ ভ্রমণ করেন। তাঁর কবিতায় দেখা যায় স্বাধীন মতপ্রকাশের আকাঙ্ক্ষা। বিপন্ন মানুষের মুখ। মানবিক দর্শনের জিজ্ঞাসা।
রেজাউদ্দিন স্টালিন প্রকৃত পক্ষে জীবনবাদী কবি। তাঁর কবিতায় রয়েছে মানবমুক্তির কথা এবং গভীরতর সমাজ বিপ্লবের সংকেত।
একজন সৃষ্টিশীল মানুষ তাঁর অপার সৃজনশীলতা শুধু একটি বিষয়ে সীমাবদ্ধ করেন না। তাই কবিতা ছাড়াও কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন সাহিত্যের আরও বিষয়ে নিজেকে যুক্ত করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ‘রবীন্দ্রনাথের আরোগ্য’ নামের একটি প্রবন্ধের বই। ‘হাঁটতে থাকো’ নামে ছড়ার বই। আছে তিনটি সাক্ষাৎকারভিত্তিক বই ও উপন্যাস ‘সম্পর্কেরা ভাঙে’। এ ছাড়া ‘সিলেক্টেড পোয়েমস’ শিরোনামে তাঁর কবিতার একটি ইংরেজি অনুবাদের বই রয়েছে। হিন্দি, উর্দু, চীনা, জাপানি, ফরাসি, রুশ, জার্মানসহ নানা ভাষায় তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে।
রেজাউদ্দিন স্টালিন প্রতিনিয়ত সময়কে ছাড়িয়ে যান। তিনি সীমাবদ্ধতা ভেঙে নতুনের ডাকে সাড়া দেন। যেমন তিনি বলেন, ‘আমাদের এখন বাইরে যেতে হবে, দরোজাটা ভেঙে কিংবা ঘরটা।’ আমাদের এখন বাইরে যেতে হবে, অবশ্যই যেতে হবে।
এই বরেণ্য কবি ২০০৫ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান। এ ছাড়া তিনি মাইকেল মধুসূদন পুরস্কারসহ বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছেন। ১৯৬২ সালের ২২ নভেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কবির প্রতি অভিনন্দন ও ভালোবাসা। ভালো থাকুন তিনি জীবনের প্রতিটি দিন।
লেখক, সংগঠক ও সাংবাদিক