পরদিন সকালেই রাজ্যের নদীগুলো শুকিয়ে যেতে লাগল, ফসল মরে গেল, মহামারি ছড়িয়ে পড়ল।
হাজার বছর আগে দেবগিরির পাহাড় ছিল এক দেবতার ধ্যানস্থল। তিনি একবার মানুষকে আশীর্বাদ দিতে স্বর্গ থেকে এক উজ্জ্বল পাথর নামিয়ে আনেন। পাথরটির নাম চন্দ্রমণি। দেবতা বলেছিলেন, ‘যত দিন এটি পাহাড়ের চূড়ায় থাকবে, তত দিন রাজ্যে শান্তি ও সমৃদ্ধি থাকবে। কেউ যদি লোভ করে এটি সরিয়ে ফেলে, তবে তার হৃদয়ের অন্ধকারে এক অভিশাপ জন্ম নেবে; যা ধীরে ধীরে তাকে ধ্বংস করবে!’
চন্দ্রমণির আলোয় দেবগিরি রাজ্য শত বছর ধরে দুর্ভিক্ষহীন ও সুস্থ-সবল ছিল। কিন্তু রাজ্যের ইতিহাসে লেখা ছিল, একবার কেউ একজন চন্দ্রমণি চুরি করেছিল এবং তার রাজ্য ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এরপর দেবতারা আবার পাথরটিকে ফিরিয়ে এনে অভিশাপ রেখে যান, পরবর্তীকালে কেউ যদি পাথর চুরি করে, তবে শুধু সে নয়, তার রাজ্যও ধ্বংস হবে! রাজ্যের যুবরাজ আরকান ছিল উচ্চাভিলাষী, শক্তিমত্তার পূজারী। সে বিশ্বাস করতেন, যদি চন্দ্রমণি তার হাতে থাকে, তাহলে সে অমর হয়ে যাবেন। তার পিতা রাজা ধ্রুবসেন বলতেন, লোভ মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। প্রকৃত রাজা হয় সে, যে নিজের শক্তিকে সংযত রাখতে জানে।
আরকান এই উপদেশ শোনেনি। এক অমাবস্যার রাতে, যখন আকাশ ছিল চাঁদের আলোহীন, আরকান কিছু গুপ্তচর ও জাদুকরকে নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠল। যখন সে চন্দ্রমণি স্পর্শ করল, তখনই পুরো আকাশ কালো হয়ে গেল। পাহাড় থেকে অশুভ বাতাস বেরিয়ে আসতে লাগল, আর এক গভীর কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হলো, ‘লোভ তোমাকে ধ্বংস করবে, যুবরাজ!’
পরদিন সকালেই রাজ্যের নদীগুলো শুকিয়ে যেতে লাগল, ফসল মরে গেল, মহামারি ছড়িয়ে পড়ল।
রাজ্যের পণ্ডিতেরা বললেন, ‘যুবরাজের লোভের কারণে অভিশাপ নেমে এসেছে। চন্দ্রমণিকে ফিরিয়ে না দিলে রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে!’ কিন্তু আরকান নিজের ভুল স্বীকার করতে চায়নি। ভাবল, যদি সে পাথরটি নিজের সুরক্ষার জন্য লুকিয়ে রাখে, তবে অভিশাপ কেটে যাবে। এর পর থেকে আরকানের জীবনে নতুন আতঙ্ক দেখা দিল। সে যেখানেই যেত, একটি অন্ধকার ছায়া থাকত তার পেছনে।
এক রাতে, আরকান যখন আয়নার সামনে দাঁড়াল, নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেল না! সেখানে একটি অন্ধকার ছায়া দাঁড়িয়ে ছিল, যার লালচে চোখ দাউদাউ করে জ্বলছিল! ছায়ামূর্তি তার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘তুমি যতই পালাও, আমি তোমার মধ্যে আছি! যত দিন লোভ তোমার হৃদয়ে থাকবে, তত দিন আমি তোমাকে ধ্বংস করব!’
আরকান পাগলের মতো হয়ে গেল। সে এক মহান সাধুর কাছে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করল। সাধু বললেন, ‘যদি চন্দ্রমণিকে আবার পাহাড়ে ফিরিয়ে দাও, তবে অভিশাপ কেটে যাবে। তবে মনে রেখো, তুমি নিজে এটি ফেরালে, তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে। অন্য কেউ তোমার হয়ে তা ফেরালে, তুমি বেঁচে যাবে।’
যুবরাজ তখন এক সাধারণ কৃষক রায়হানের কাছে গেল। এই কৃষক রাজ্যের সবচেয়ে নীতিবান মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিল। যুবরাজ কাঁদতে কাঁদতে তাকে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে। আমি যদি পাথর ফিরিয়ে দিই, তবে আমি ধ্বংস হয়ে যাব। তুমি কি আমার হয়ে এটি ফিরিয়ে দেবে?’
রায়হান কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, ‘আমি রাজ্যের মঙ্গলের জন্য সবকিছু করতে রাজি। তবে মনে রেখো, ক্ষমতার জন্য নয়, ন্যায়ের জন্যই মানুষ বেঁচে থাকে!’
কৃষক রায়হান পাথর হাতে নিয়ে দেবগিরির পাহাড়ের চূড়ায় উঠল। যে মুহূর্তে সে পাথরটি পাহাড়ের শীর্ষে রাখল, সঙ্গে সঙ্গে আকাশ সোনালি আলোয় ঝলমল করে উঠল, রাজ্যের নদীগুলো আবার পূর্ণ হয়ে গেল, গাছগুলো আবার সবুজ হয়ে উঠল, অভিশাপ দূর হয়ে গেল।
অন্যদিকে, যুবরাজ আরকান হঠাৎ নিজের দেহের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল। তার শরীর ধীরে ধীরে ধুলো হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেল! সেই ছায়ামূর্তি তার দিকে তাকিয়ে বলল, লোভ থেকে জন্ম, লোভেই শেষ! তারপর মূর্তিটিও মিলিয়ে গেল, আর রাজ্যে আবার শান্তি ফিরে এল। রাজা ধ্রুবসেন ঘোষণা করলেন, রায়হান কেবল সাধারণ কৃষক নয়, সে রাজ্যের ত্রাণকর্তা! প্রকৃত রাজা হয় সে-ই, যে ন্যায়ের পথ অনুসরণ করে! রাজ্যের জনগণ আনন্দে মেতে উঠল। আর রায়হানকে যুবরাজ ঘোষণা করা হলো।
তার পর থেকে দেবগিরির পাহাড়ের চূড়ায় চন্দ্রমণি শান্তিতে জ্বলতে থাকল। আর যুগে যুগে মানুষ এই গল্প বলতে লাগল, ‘লোভ যদি তোমার রাজ্য হয়, তবে তোমার ধ্বংস অনিবার্য!’
শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়