ভাঙা শামুকের খোঁজে

চান্দার বিলে জলজ উদ্ভিদছবি: লেখক

সময়টা ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস। একদিন বিকেলে কাজী মসিউর রহমান স্যার, আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু একাডেমিক ভবন থেকে ক্লাস শেষ করে নামছেন। সিঁড়িতে দেখা। ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছিলাম। তারপর বললেন, আরও কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রকৃতি ও প্রতিবেশ নিয়ে একটা কাজে যেতে হবে। দুই-একজন যারা আছে, তাদের ডাকতে বললেন।

পরদিন যখন রওনা দিলাম, দেখলাম বন্ধু হিমাংশুসহ বিভাগের সিনিয়র শিক্ষার্থীরা আছেন। হরিদাসপুর লঞ্চঘাট থেকে ট্রলারে ওঠার সময় দেখি, পরিচিত মুখ সুব্রত সাহা ও বাপ্পী দাদা আছেন এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুসভার অনেকেই। মধুমতী নদীর বুক চিড়ে আমাদের ট্রলার এগিয়ে চলছে। বর্ষাকাল হলেও নিয়মিত বৃষ্টির দেখা নেই। প্রখর রোদ। ট্রলারে শামিয়ানাও দেওয়া হয়েছে।

একদল গান গাইছে। বাকিরা স্যারকে কেন্দ্র করে বসে নানা আলাপ করছে। গন্তব্য চান্দার বিল। ঝিনুকের কাজ কী, শামুকের কাজ কী, একটা আদর্শ প্রতিবেশের জন্য কী কী উপাদান থাকতে হয়, পানি কীভাবে হাজারো প্রাণ বয়ে বেড়ায়, নদীতে রাবার ড্যাম হলে সামগ্রিক বাস্তুসংস্থানে কী প্রভাব পড়ে, প্রতিবেশ, নদী ও জলাশয়ের সঙ্গে আমাদের সভ্যতার কী সম্পর্ক এবং আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এর গুরুত্ব কী-এসব ছোট ছোট বিষয় নিয়ে স্যার আমাদের কাছে নানা প্রশ্ন শুনতে চাচ্ছেন।

একটা সময় আমরা চান্দার বিলে পৌঁছে গেলাম। স্বচ্ছ কালো পানি। গাছের শিকড়গুলো প্রবহমান স্রোতকে জানান দিচ্ছে। কচুরিপানা, শাপলা, কলমি শাক, হেলেঞ্চা লতাসহ অনেক জলজ উদ্ভিদে বিল ভরে উঠেছে। বক উড়ছে।

কয়েকজন শামুক সংগ্রহকারীর দেখা পেলাম। ক্যামেরা, মাইক্রোফোন নিয়ে তাদের কিছু অভিমত নেওয়া হলো। শামুক কীভাবে শহরে পৌঁছে যায় আর এই বিলকে রেখে যায় একা করে; শামুকের মতো একটা ক্ষুদ্র প্রাণের এ রকম প্রতিবেশের সঙ্গে বিচ্ছেদের ফলে যে প্রভাব পড়ে, তার জীবনের অভিজ্ঞতা শুনলাম। অথচ এই বিলে চাঁদ সওদাগরের জাহাজ এসে নোঙর করেছিল বলে শুনতে পাওয়া যায়। বিলকেন্দ্রিক যে আদর্শ প্রতিবেশের কথা বলা হয়, সেই সোনালি অতীতের কথা শুনলাম।

স্যারের সঙ্গে লেখক ও তাঁর সহপাঠীরা
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

বিলে প্রবেশের মুখে, মসিউর স্যার নদীর পাড়ে গাছপালার সবুজ আশ্রয়ে আমাদের সবাইকে নিয়ে নামলেন। খালি পায়ে মাটির স্পর্শ নিলেন। শিক্ষার্থীদের কাছে শুনতে চাইলেন, আমরা বাস্তুসংস্থান বলতে মূলত কী বুঝি? অনেকেই নিজ নিজ অভিজ্ঞতা বললেন। স্যারও মন দিয়ে শুনলেন। সবকিছু ছাপিয়ে স্যার বলেন, ‘ইন্টারডিপেন্ডেন্সের একটা জায়গা সরে গেলে-যেমন আমাদের শরীর, শরীরে অসংখ্য আলাদা আলাদা অঙ্গ রয়েছে। সবকিছু মিলে কিন্তু শরীর তৈরি হয়। ঠিক? ধরো, আমার কোনো একটা চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেল, এটার প্রভাব কিন্তু পুরো শরীরকে বয়ে বেড়াতে হবে। কোনো একটা হাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেলে, পুরো শরীর কিন্তু এর প্রভাব বয়ে বেড়াবে, তাই না? এটাকে বলে ইকোসিস্টেম। সেই ইকোসিস্টেমে মানুষও তো একটি অংশ। মুশকিলটা হয়েছে কী, মানুষকে আমরা সব সময় আলাদা করে ভেবেছি যে সে মনে হয় ইকোসিস্টেমের অংশ নয়। সে শুধু ইকোসিস্টেমকে ব্যবহার করবে।’ বাপ্পী দাদার কারণে ওই দিনের পুরো অভিজ্ঞতার মধ্যে শুধু এই অংশটুকু এখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাওয়া যায়।

প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে স্যারের জ্ঞানের সঞ্জীবনী নিয়ে বলার কিছু নেই। তিনি বলতেন, ‘কেবল আমি নই, সবাই; মানুষ নয় শুধু, জগৎকেন্দ্রিক চিন্তাই প্রধান ধারা হয়ে উঠুক।’ এভাবেই তিনি সেদিন সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের মধ্যমণি হয়ে উঠেছিলেন।

একে একে অন্যরাও প্রতিবেশের প্রতিটি ক্ষুদ্রকণাও কেন গুরুত্বপূর্ণ, সেটা নিয়ে আলাপে অংশ নিলেন। এর আগে, পাঠ বলি বা পড়াশোনা বলি, পরিবেশ নিয়ে এমন জীবনঘনিষ্ঠ জানাশোনা হয়নি।

অনেক দূর পর্যন্ত বেড়িবাঁধ দেওয়া। দুই পাশে বাঁশ দিয়ে দেয়াল করে দেওয়া হয়েছে। রেইনট্রি, আকাশমণি, জারুল ও অর্জুন গাছ লাগানো। বেশ ঝলমলে। বর্ষার শেষে, বিলটায় পানি কমে যায়। তখন সেখানে ফসলে ভরে ওঠে।

বছর আট-নয় হবে, দূরে দুই কিশোরীকে দেখা যাচ্ছে। নৌকা বেয়ে এগিয়ে আসছে তারা। কখনো শাপলা তুলছে, কখনো তুলছে না। অথচ এই বিলে জনমানুষ তেমন নেই। যেখানে আমরা নেমেছি, দুটো নৌকা পাড়ে বাঁধা; যেন একজন আরেকজনের কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে আছে। দক্ষিণা বিশ্বাস দিদি ও সীমা ঘোষ দিদি একটা নৌকায় উঠলেও অতটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলেন না।

বাঁধের পাড় ধরে এক মাঝি নৌকা বয়ে এগিয়ে চলেছেন। বন্ধুসভার একজন সেই মাঝিকে ডেকে নিলেন, তিনি এখানে কী করছেন, কোন সময়টায় কী মাছ পাওয়া যায়, এই জল তো বর্ষার শেষে শুকিয়ে যায়; তবু এখানে এত মাছের উৎস কী? সেসব নিয়ে ওনার কথা শুনলাম। কী কী মাছ তিনি ধরতে পেরেছেন, আগে কী কী মাছ পাওয়া যেত, তা শোনা হলো। পরে দুপুরের খাবার ভাগ করে নিলাম আমরা। খাবার শেষে পাতানো জাল দেখতে চলে গেলেন তিনি।

চান্দার বিলের খননকাজে পাওয়া মহিষ, শুকর ও গরুর ফসিল
ছবি: লেখক

এই বাঁধের ধারে বয়ে চলা যে জলরাশি, বিলের অপর প্রান্তে অবস্থিত গ্রামে সহজে পৌঁছানোর এটাই একমাত্র পথ। আরেকটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে গেল নববধূকে বরণ করার হিন্দি গানের সুর।

এরপরের গন্তব্য একটি সংগ্রহশালায়। সেখানে এই বিলের অনেক ঐতিহ্য সংরক্ষিত আছে। কিছুটা আবার নদীপথ, তারপর সুনসান মেঠো পথ পেড়িয়ে গ্রামে ঢুকতে হয়। একদম প্রান্তিক গ্রাম। নামটা মনে পড়ছে না। গিয়ে দেখা গেল, ঘরটি ঝড়ে ভেঙে গেছে। চান্দার বিলের খননকাজে যেসব প্রাণীর ফসিল পাওয়া গিয়েছে, সেগুলো পাশের একটা ঘরে রাখা হয়েছে। মহিষ, শুকর, গরু-যেসব ফসিল দেখতে পেলাম তাতে এটা পরিষ্কার যে চান্দার বিলজুড়ে একসময় একটি আদর্শ প্রতিবেশ ছিল। বনাঞ্চল ছিল, পশুপাখির অভয়াশ্রম ছিল। শীতকালে অতিথি পাখির জন্য নিরাপদ ঠিকানা ছিল। এখনো কিছু অতিথি পাখি প্রতিবছর আসে। তবে জীববৈচিত্র্যের সংকটে এই বিল এখন আর নিরাপদ নেই। কালের বিবর্তনে সেখানে বর্তমানে কেবল অথই জল।

এসব ফসিল সেখানকার এক উন্নত জীববৈচিত্র্যের জানান দেয়। পাশের যে ঘরে এগুলো স্থানান্তর করা হয়েছিল; এটার তূলনামূলক অবকাঠামো বেশ ভালো। এই কয়েকটি দেখার সুযোগ হয়েছিল আমাদের। বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের তৎকালীন সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার বিধান চন্দ্র ঠিকাদার আমাদের এসব ফসিল কীভাবে চান্দার বিলে পাওয়া গেল; সেসব ঘটনা জানালেন। তিনি জানালেন, এগুলোর বেশির ভাগ পাওয়া গেছে বিলের গভীরতা ও জলাধার খননের কাজ চলাকালীন। যার অর্থ, এই তাবৎ অঞ্চলে এক নিবিড় বাস্তুসংস্থান টিকে ছিল একটা সময়। তিনি এটাও জানান, বিভিন্ন সময় বিলের বৈচিত্র্য রক্ষায় পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেনি।

সম্প্রতি আমরা বর্তমান জলবায়ু সংকটের নিরিখে চান্দার বিলকেন্দ্রিক একটি মাঠ পর্যায়ের পাঠ-গবেষণার জন্য পদক্ষেপ নিলে বিসিএএসের ওই অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি মর্মাহত হয়ে জানান যে ফসিলগুলো বর্তমানে সংগ্রহে নেই। এমনকি সংগ্রহশালাটিও আর নেই।

এই জায়গায়ও একটা প্রতিবেশ গড়ে তোলা হয়েছে। যদিও সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় বাণিজ্যিক ছাপ আছে। তবে প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি গুরুত্ব দিতে চেষ্টার কমতি নেই। চারপাশে ঝোপঝাড়ে ভরে উঠেছে। আদর্শিকভাবে পুকুর রাখা হয়েছে। চারদিকে হরেক প্রজাতির গাছ ও উদ্ভিদ। নামফলকে লিখে রাখা, ‘সাবধান! চারপাশে বিষধর সাপ রয়েছে।’ এই সবকিছুই এখন মরীচিকা!

সতেজ বিশ্রামের জন্য শৌখিন স্থাপনা রয়েছে। গোল হয়ে বসে চা পান করতে করতেই বেলা ঘনিয়ে এল। এখন স্যারের প্রিয় শিক্ষার্থীরা তাঁর চিন্তা জাগানিয়া এমন কথামালাকে চোখের পলক ফেলতেই শুনতে পান। দূর আকাশ থেকে কথা রাখা যায় কি না; জানা নেই। প্রায়ই মনে হয় এসব কেবলই এখন কবির মায়া ছাড়া আর কিছুই নয়—
‘ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা।
ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা।
ভালো থেকো।’

শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়