ঘন কালো মেঘে আকাশটা চেয়ে আছে। এই ভরদুপুরেই মনে হচ্ছে সন্ধ্যা নেমেছে। নদীর দক্ষিণ ধারে ফোটা কেয়া, ঝরা শেফালি-বকুলের গন্ধ বাতাসের সঙ্গে মিশে একাকার। হালকা বাতাসে খেজুরগাছ আর নারকেলের ডগাগুলো ক্রমশ দোল খাচ্ছে।
জামার কোণে নেওয়া খেজুরগুলো সামলাতে সামলাতে তিথি বাড়ির দিকে ছুটছে। আঁচলে তুলে নিল কয়েকটি বেলি আর আধফোটা জুঁই। একটা গন্ধরাজ নিতে চেয়েও নিল না!
আকাশের কালো মেঘের ক্রন্দন চারপাশকে ভারী করে তুলেছে। তাড়াহুড়ো করে বেলগাছের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় অগোচরে তার পায়ে একটা কাঁটা বিঁধে গেল। গতকাল বাবা বরইগাছের ডালগুলো কেটে এখানে রেখেছিল, তার খেয়ালই ছিল না।
আহ! বলে নিচু হয়ে একটানে কাঁটাটা বের করে নিল তিথি। কেমন ঠনঠন ব্যথা করছে।
এরই মধ্যে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। ব্যথা ভুলে কোনো রকমে দৌড়ে ঘরে ঢুকল সে।
তিথির মা রাজিয়া বেগম। সাংসারিক ও কর্মঠ মহিলা। সারা দিন মায়ের এত কাজ করা দেখে তিথির কষ্ট হয়। ওর বাবা কেন কাজ করে না, বুঝতে পারে না। সারা দিন পাড়ার দোকানে আড্ডা দিয়ে কাটায়। খাওয়া আর ঘুমানো ছাড়া বাড়িতে ওনার পা পড়ে না খুব একটা। কোনো দায়িত্ববোধও নেই। রাজিয়া বিভিন্ন সবজি উৎপাদন, ফলগাছ লাগানো, হাঁস-মুরগি পালন—এসব করেই সংসার চালান। একসময় রাজিয়াকে সবাই লালু বলে ডাকত। একদম ফর্সা-লাল গাল বলে আদর করে ডাকত সবাই। সেই লালুর রূপ এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সারা দিন রোদে, বৃষ্টিতে কাজ করে। সংসার খরচের পাশাপাশি স্বামীর হাত খরচের জোগানও দিতে হয় তাকে। নয়তো বাড়িতে অশান্তির শেষ থাকে না।
তিথি সব সময় ভাবে, তার বন্ধুদের মায়েদের তো এত কাজ করতে হয় না। কিন্তু তার মায়ের কেন এত কাজ, বুঝে আসে না। সে সব সময় মাকে সাহায্য করে এবং ছোট বোন তিনাকে সামলায়।
তিথি বাড়ি এসে দেখে মা এখনো বাড়ি আসেনি। নিশ্চয়ই এখনো সবজিখেতে কাজ করছে, সে মনে মনে ভাবল। কুড়ানো কাঁচা খেজুরগুলো ঘরের এক কোণে রেখে দৌড়ে গেল ছেঁড়া খাতা আর নতুন কম্বলটা ঢুকাতে। আগে তাদের কম্বল ছিল না। বিদেশ থেকে আসা এক চাচাতো ভাই এটা দিয়েছে গত ঈদে। কম্বলটা যদিও তাদের ব্যবহার করা, তবু তিথিদের কাছে এটা নতুন আর বাড়ির সবচেয়ে ভালো কম্বল।
১২ বছরের মেয়ের দায়িত্ববোধ দেখে বরাবরই অবাক হন রাজিয়া বেগম। জল চলে আসে চোখে। একটু বুঝতে শেখার পর থেকেই মেয়েটা এমন।
মেহমান এলে এটাই দেওয়া হয়। তাই তিথি সবার আগে কম্বলটা নেওয়ার চেষ্টা করছে। কম্বলটা হাত দিয়ে কাঁধে তুলে নিয়ে যাওয়ার মতো বড় এখনো সে হয়নি। তবু চেষ্টা করছে। দৌড়ে ঘরে ঢুকে চেয়ার নিয়ে এল। চেয়ারে দাঁড়িয়ে কোনো রকম কম্বলটা কাঁধে নিল তিথি। ততক্ষণে কম্বল অনেকটা ভিজে গেছে।
এই যা! চালের ওপর থেকে তো বরইগুলো নামানো হয়নি। দৌড়ে গিয়ে বরইগুলো নামাল চেয়ারে দাঁড়িয়ে।
বরইগুলো তো আজ মা বিক্রি করতে পাঠাবে বলছিল বাজারে। ভিজে গেলে আর রক্ষা নেই। বাড়িতে কোনো বাজার নেই। এগুলো বিক্রি করেই তেল-পেঁয়াজ আর ওর জন্য খাতা-কলম আনাবে বলেছিল।
বরইগুলো প্রায় ভিজে গেছে।
উনুনের ওপর লাকড়ি রাখার যেই মাচাংটা আছে, সেখানে বরইগুলো রাখল তিথি। যাতে উনুনের তাপে একটু শুকায়।
তিথির কাপড় ভিজে গেছে। উষ্কু-অপরিষ্কার চুলগুলো ভিজে আরও আঠালো হয়ে গেছে। একটা ছেঁড়া পুরোনো ওড়না নিয়ে মাথাটা মুছে নিল।
দৌড়ে বাড়ি ঢুকলেন রাজিয়া বেগম। সারা শরীর ভিজে গেছে। বাড়ির পেছনের ডোবা থেকে মাছ ধরতে নেমেছিলেন। মাছের সঙ্গে কিছু কচুর লতিও তুলে এনেছেন রাতে রান্না করবেন বলে।
‘তিথি, কই গেলি মা? আমার জন্য একটা শুকনা কাপড় নিয়ে আয়।’
‘এক্ষুনি আনছি মা।’
তিথি সবখানে খুঁজে কোথাও মায়ের জন্য একটা শুকনা কাপড় পেল না।
‘মা, কোথাও পাচ্ছি না তোমার শাড়ি।’
ভেজা কাপড়ের পানিটা ঝেড়ে নিজেই গেলেন শাড়ি খুঁজতে। মনে পড়ল শুকনা কাপড় আর নেই।
একটা সকালে ধুয়ে দিয়েছিলেন, অন্যটা পরনে। আরেকটা নতুন শাড়ি আছে, যেটা কোথাও গেলে পরা হয়। অবশেষে স্বামীর একটা লুঙ্গি পরে ওড়না দিয়ে শরীরটা ঢেকে নিলেন।
‘তিথি, কম্বলটা কি তোর বাবা ঢুকিয়েছে?’
‘না, মা। বাবাতো সেই সকাল থেকে দোকানে কেরাম খেলছে, এখনো আসেনি।’
‘কম্বল, কাঁথা, কাপড়, বরই—সব আমি তো ঢুকাইলাম মা। বরইগুলো ভিজে গেছে, মাচাঙে শুকাতে দিয়েছি।’
১২ বছরের মেয়ের দায়িত্ববোধ দেখে বরাবরই অবাক হন রাজিয়া বেগম। জল চলে আসে চোখে। একটু বুঝতে শেখার পর থেকেই মেয়েটা এমন। মাঝেমধ্যে ভাবে, মেয়েটিও হয়তো তার মতোই সংগ্রামী হবে। কিন্তু রাজিয়া চান না, মেয়ে তারই মতো সংগ্রাম করুক সংসারে। তিনি চান মেয়েটা পড়াশোনা করে অনেক বড় হবে।
রাজিয়া বেগম রান্না করতে গেলেন। ছোট বোন তিনা ঘুম থেকে উঠলে তিথি তাকে কোলে নিয়ে খেলছে। মায়ের কাজ করতে হয়। তাই স্কুল থেকে এসেই সারা দিন বোনকে সামলায় সে। খাইয়ে দেয়, গোসল করিয়ে দেয়, ঘুম পাড়িয়ে দেয়—এমনকি খেলতে গেলেও তিনাকে সঙ্গে রাখে।
সকাল থেকেই তিথি ছোট বোনকে নিয়ে মিজ্জি বাড়ির উঠানে খেলছে। আজ মিজ্জি বাড়ির ছোট ছেলের বিয়ে।
সারা দিনের গরমে শরীর থেকে খুব বিশ্রী গন্ধ আসছে। ধু ধু মরুভূমির মতো চুল। অসহ্য গরম লাগছে। গোসল করবে ভেবেছিল, কিন্তু পেটে খিদে অনেক। ওদিকে, কিছুক্ষণ পর পর তিনা খাওয়ার জন্য কান্না করছে। মাংস রান্নার সুগন্ধে চারপাশ মুখর। তিথি বুঝতে পারছে খাবার দিতে আর বেশি দেরি নেই, এখন কিছুতেই বাড়ি যাওয়া যাবে না।
মিজ্জি বাড়ির পেছনে আছে বড় মাঠ। পাশেই বেয়ে গেছে ছোট্ট শাখা নদী ‘মৌরি’। গতকালকের ভারী বর্ষণে পানি অনেক বেড়েছে নদীতে।
পাড়ার সব ছেলেমেয়ে মিলে কানামাছি খেলার জন্য জড়ো হয়েছে এই মাঠে। তিথিরও খুব খেলতে ইচ্ছে করছে। বোনকে পাশেই একটা জায়গায় বসিয়ে দিয়ে খেলায় যোগ দিল সে।
দলপতি শুরুতেই সেতুর চোখ বেঁধে দিল। সবাই ভালো করে পরখ করে দেখল কাপড়ের ভেতর থেকে দেখা যাচ্ছে কি না! নিশ্চিত হয়ে খেলা শুরু হলো। সবাই সেতুর চারপাশে ঘুরছে। মাঝেমধ্যে কেউ হালকা ধাক্কা দিচ্ছে। কেউ টোকা দিয়ে দৌড়! আবার কেউ কেউ সামনে এসে গলার আওয়াজ শুনিয়ে ছুঁয়ে দেওয়ার আগেই দৌড় দিচ্ছে।
তিনা কান্না করছিল বলে কোলে তুলে নিয়েছে তিথি। ভালো করে দৌড়াতে পারছে না এখন। ধরা পড়ার ভয়ে দূরে দূরেই থাকছে।
তিনা আধো আধো বুলিতে ভূ, ভূ, তা, তা...এসব বলছিল। সেতু কখন যে তিনার কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে তিথিকে ধরে ফেলল, সেটা বুঝতেই পারেনি।
যথারীতি দলপতি তিথির চোখ বাঁধার জন্য ডাকল। চোখ বাঁধার আগে সে বোনের হাতে একটি প্লাস্টিকের খেলনা দিয়ে একপাশে বসিয়ে দিল।
‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ যাকে পাবি তাকে ছোঁ’। সবার হইহুল্লোড়ে খেলা বেশ জমে উঠেছে। তিনা তার ছোট ছোট পায়ে হেঁটে নদীর পানির কাছাকাছি গেল। হাত থেকে ফসকে খেলনাটি পানিতে পড়ে গেল। খেলনাটি নেওয়ার চেষ্টা করল সে। কিন্তু সেটি ততক্ষণে পানিতে ভেসে যায়। অবুঝ তিনা খেলনাটি নিতে পানিতে নেমে গেল!
হঠাৎ অস্থির লাগছে তিথির। অনেক চেষ্টা করেও কাউকে ধরতে পারছে না। কেমন যেন দুর্বল লাগছে। খেলার প্রতি অনীহা কাজ করছে। ইচ্ছে করেই চোখের বাঁধনটা খুলে ফেলল।
‘কী সমস্যা তিথি, চোখ খুললি কেন? এই জন্য তোরে খেলাই নিতে চাই না। সব সময় তোর বোনের চিন্তা। এ জন্য বারবার তুই খেলার মাঝখানে এমন করিস।’ একনাগাড়ে কথাগুলো বলল জুঁই।
সেসব কথায় পাত্তা না দিয়ে তিথি ছোট বোন তিনাকে খোঁজার চেষ্টা করে। কোথায় গেল তিনা!
কোথাও তিনাকে দেখা যাচ্ছে না। কলিজায় মোচড় দিয়ে উঠল তিথির।
‘তিনা, তিনা’ বলে ডাকতে ডাকতে নদীর পাড়ে গেল। কিছু দূরে তিনার খেলনাটা একটা বাঁশঝাড়ে আটকে আছে। এক দৌড়ে ঝাঁপ দিল পানিতে। সাঁতার না জানায় সে প্রায় ডুবে যাচ্ছিল। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় সেতুর বড় ভাই মিজান তা খেয়াল করে পানিতে নেমে তিথিকে তুলে আনল। জ্ঞান নেই তিথির। পেটে চাপ দিয়ে পানি বের করার একটু পর চোখ খুলল। প্রথমেই সে বোনের খোঁজ করল।
নদীর দিকে আরেকবার সবাই তাকাল। অনেক দূরে লাল জামার মতো কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। দৌড়ে গেল সেতু। তিথি শূন্য চোখে পলকহীন চেয়ে আছে লাল জামাটার দিকে। ওর মন যেন পুরো ঘটনা বুঝে গেল।
‘এ তো তিনা!’ সেতুর চিৎকার।
‘ভাইয়া’ বলে ডাক দিল সেতু। সবাই তিনার নিথর দেহটা নিয়ে এল। বাক্রুদ্ধ তিথি জানে না মায়ের সামনে কীভাবে যাবে? মায়ের এমনিতেই কত কষ্ট, আর আজ যখন দেখবে তিনা...! ভাবতে পারছে না সে।
তিনা নেই আজ দশটা বছর হয়ে গেল। ওই ঘটনার দুই বছর পরই মা জেদ করে তিথির বিয়ে দেয়। ওর প্রতি মায়ের সব মনোভাব বদলে গেছে। তিথি বিয়ে করতে চায়নি। রাজিয়া বেগম শুধু বলেছিলেন, ‘এবার আমারে, এই সংসারটারে একটু মুক্তি দে।’
এরপর তিথি আর কিছুই বলেনি মাকে।
তিথির বিয়ে হয়েছে, সংসার হয়েছে, জীবন বদলে গেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু নেই তিনা। নেই মায়ের আদর। ফোটেনি মায়ের মুখে আজও হাসি। শুধু থামেনি মায়ের জীবনযুদ্ধ। বাবাও ঠিক আগের মতোই আছে। মায়ের পাশে থাকার মতো কেউ নেই। তিনা বেঁচে থাকলে হয়তো থাকত। অন্তত তিথি-তিনাকে ঘিরে মায়ের হাসিটা থাকত।
নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয় তিথির। আজও মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে না। বড্ড অপরাধবোধ জাগে। ইচ্ছে করে মায়ের বুকে মুখ গুঁজে চিৎকার করে কাঁদতে।
পাঠাগার ও পাঠচক্র সম্পাদক, কক্সবাজার বন্ধুসভা