মুক্তিযুদ্ধেও একা গিয়েছিলাম, এখানেও একাই এসেছি

মুক্তিযুদ্ধ ছিল সর্বাত্মক জনযুদ্ধ। যুদ্ধের অবকাশে ঢাকার দোহারে মুক্তিযোদ্ধারা, ১৯৭১ছবি: আনোয়ার হোসেন

প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে এসেছি। ডাক্তার কয়েকটি পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষা করাতে সে এখন একটি কক্ষের ভেতরে। আমি করিডরে বসে অপেক্ষা করছি। এমন সময় এক ভদ্রলোক এসে আমার পাশের সিটে বসলেন। ওনার হাত-পা কাঁপছিল। তোতলাতে তোতলাতে বললেন, ‘মা, এখানে বসছি যে আপনার সমস্যা হবে না তো?’
আমি বললাম, ‘কোনো সমস্যা হবে না। আপনি বসুন।’ জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনিই রোগী?’
‘হ্যাঁ।’
‘সঙ্গে কাউকে আনেননি?’
‘আমি মুক্তিযুদ্ধেও একা গিয়েছিলাম, এখানেও একাই এসেছি,’ নির্বিকারভাবে বললেন।

খানিকটা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। কিছুক্ষণ পর টেস্ট ল্যাব থেকে সিরিয়ালের একজন এসে ওনাকে একটা স্লিপ দিয়ে বললেন, ক্যাশ কাউন্টারে গিয়ে ইইজির স্লিপ নিয়ে আসতে হবে। আমি বয়ের হাত থেকে স্লিপটা নিয়ে গেলাম ক্যাশ কাউন্টারে। ৮০-৯০ জনের লম্বা সিরিয়াল। দাঁড়ালাম গিয়ে সবার পেছনে।
যখন সিরিয়ালে দাঁড়াতে যাচ্ছিলাম, উনি বললেন, ‘মা, আপনি পারবেন?’

ক্যাশ কাউন্টারের সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে ওনার মুখটা চেহারার সামনে ভাসছিল। কতটা নির্বিকারভাবে বললেন, ‘আমি যুদ্ধেও একা গিয়েছিলাম, এখানেও একাই এসেছি!’
পরে কথা বলে জানতে পারি, ওনার স্ত্রী নেই। অনেক আগেই মারা গেছেন। ছেলেমেয়েরা দেশের বাইরে পরিবার নিয়ে থাকেন। ঢাকায় তিনি একাই বসবাস করেন। দেশের মাটি ছেড়ে যেতে চান না।

লম্বা সিরিয়াল একটা সময় শেষ হয়। ওনার স্লিপ ক্যাশ কাউন্টারে জমা দিয়ে আসি। অন্যদিকে আমার বিশেষ মানুষটিরও এরই মধ্যে পরীক্ষা করানো শেষ হয়ে যায়। বাসায় ফেরার পালা। হঠাৎ পেছন থেকে লোকটি আমাকে ডাক দিলেন। বললেন, ‘মা, আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেললাম তাই না?’ জবাবে বললাম, ‘আপনি আমাদের জন্য পুরো দেশটা এনে দিয়েছেন, আর আমি আপনার জন্য এটুকু কষ্ট করতে পারব না!’

বাসায় ফেরার সময় পুরো রাস্তাজুড়ে ওনার একটা কথাই বারবার মনে পড়ছিল, ‘যুদ্ধেও একাই গিয়েছিলাম...।’

পাঠচক্র ও পাঠাগার সম্পাদক, অতীশ দীপঙ্কর ইউনিভার্সিটি বন্ধুসভা