ছুটির দিনে কুতুবদিয়া দ্বীপে

কুতুবদিয়া দ্বীপে সূর্যাস্ত
ছবি: লেখক

আমরা কজন স্বপ্ন দেখি ব্যস্ত শহর ছেড়ে দুঃখ ভুলে একদিন ছুটিতে ঘুরতে যাব এক নির্জন দ্বীপে। যেখানে থাকবে চিকচিক বালু, চারদিকে নীল জলরাশি, ঢেউয়ের গর্জনে উত্তাল সমুদ্দুর, পাখির ডাকে ভোরের সোনালি রোদ্দুর, সাদা আর নীলাকাশের বিশালতা, গায়ে চাদর জড়িয়ে দেবে বাতাসের মমতা।

অবশেষে একদিন আমরা ছুটিতে বেরিয়ে পড়লাম সেই কাঙ্ক্ষিত দ্বীপের উদ্দেশে। যার নাম কুতুবদিয়া দ্বীপ। সঙ্গে নিলাম ব্যাগভর্তি পোশাক-পরিচ্ছদ, খাবারদাবার, ক্যামেরা, মুঠোফোন, হেডফোন, চার্জার, ওষুধপত্রসহ প্রয়োজনীয় জিনিস। বন্ধুরা সবাই মিলে ঢাকার চিটাগাং রোড থেকে রিজার্ভ করে নিলাম একটা মাইক্রোবাস।

বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র
ছবি: লেখক

রাত ১১টার দিকে উঠে পড়লাম মাইক্রোবাসে। সারা রাত জার্নি করে সকাল ছয়টায় পৌঁছালাম কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার মগনামা ঘাটে। ঘুমের ঘোরে আলতো আলতো চোখে হিমেল হাওয়ায় নজরে পড়ল পশ্চিমে বিশাল নদী কর্ণফুলী। অপর প্রান্তে সমুদ্রের বুকে ভেসে আছে এক টুকরা জেগে ওঠা দ্বীপ ‘বাতিঘর’–খ্যাত কুতুবদিয়া। খুশিতে ঝলমল যেন চক্ষু যুগল। এরপর জেটির প্রবেশমুখে পাঁচ টাকা জেটি ভাড়া দিয়ে ছোট ছোট স্পিডবোটে উঠে পড়লাম কুতুবদিয়ার দরবার ঘাটের গন্তব্যে। ঢেউয়ের সঙ্গে ঝাপটাতে ঝাপটাতে স্পিডবোট পৌঁছাল পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে অপর প্রান্তে দরবার ঘাটে। এরপর আবারও পাঁচ টাকা জেটি ভাড়া দিয়ে কুতুবদিয়া দ্বীপের বিখ্যাত বুজুর্গ মালেক শাহ হুজুরের দরগা জিয়ারতের উদ্দেশে ছুটলাম। মাজার জিয়ারত শেষে ছোট্ট একটা চায়ের দোকান কুলিং কর্নার থেকে নাশতা সেরে নিলাম। ওখানে বিশ্রাম নিলাম কয়েক ঘণ্টা।

বিশ্রাম শেষে আমাদের গন্তব্য কুতুবদিয়া দ্বীপের প্রাণ বাতিঘর। সিএনজিযোগে আধা ঘণ্টা জার্নি শেষে পৌঁছালাম সেখানে। দেখলাম বিশাল আকাশের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বাতিঘর। পশ্চিমে বিশাল সমুদ্র বঙ্গোপসাগর। চিকচিক বালুতীরের কাছাকাছি থেকে পানির ওপর উড়ছে সাদা পায়রা ও অতিথি পাখি। এরা সাধারণ আসে শীতকালে সুদূর উত্তর মেরু থেকে। নজর কাড়ল সূর্যের রক্তিম আলোর কিরণ ঝুঁকে পড়েছে বাতিঘরের উঁচুশিরে। দেখতে কী যে ভালো লাগছে! বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এল কুতুবদিয়ার বুকে। জ্বলে উঠল বাতিঘরের বাতি। এ বাতির বিশেষত্ব সম্পর্কে জানা যায়, সমুদ্রের বিভিন্ন জাহাজকে সচেতন করা। বাতির আলোয় ঝলমলে হয়ে উঠল দ্বীপের চর। মাঝে মাঝে আলো ছড়াচ্ছে জোনাক পোকা ও পূর্ণিমার চাঁদ। তারা গুনতে গুনতে আমরা দ্বীপের চরে সমুদ্রতীরের কাছাকাছি ঝাউগাছের নিচে টেনে ফেললাম একটা তাঁবু। ইট দিয়ে ব্যবস্থা করলাম একটা চুলা। বন্ধুরা সবাই মিলে একে অপরের সহযোগিতায় লাকড়ি সংগ্রহ করে কফি বানিয়ে নিলাম। সমুদ্রতীরে বালুর ওপর বসে হাওয়া খেলাম প্রাণভরে। দেখলাম সমুদ্রে কিছুক্ষণ পরপর জাহাজ আর মাছ ধরার নৌকা চলাচল করছে।

কুতুবদিয়া দ্বীপের রাতের সৌন্দর্য
ছবি: লেখক

এ দ্বীপের মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটে সমুদ্রের মাছ দিয়ে। রাত গভীর হলে আমরা গান আর আড্ডা শেষে ঘুমিয়ে পড়লাম তাঁবুতে। ভোরে ঘোর ভাঙল পাখির ডাকে। পূর্ব দিকে নতুন সূর্য উদিত হচ্ছে দ্বীপের বুকে। যেন নতুন স্বপ্ন ও সুন্দর দিন নিয়ে। চিকচিক করছে বালু, গর্জন দিচ্ছে সমুদ্রের ঢেউ। কিছুক্ষণ তীরে হাঁটাহাঁটি করলাম। সমুদ্রের জলে পা ভেজালাম। এরপর ইটের চুলা আর লাকড়ি জ্বালিয়ে তৈরি করলাম সকালের নাশতা। নাশতা খেয়ে আর তাঁবু ভেঙে হাঁটা ধরলাম নতুন গন্তব্যে।

এবারের গন্তব্য বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র। কুতুবদিয়া দ্বীপে বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হয় ১৯৯৬ সালে। আধা ঘণ্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের জার্নিতে দুইটা গাড়ি পাল্টিয়ে পৌঁছালাম সেখানে। দেখলাম উঁচু উঁচু টাওয়ারে বড় বড় পাখা রয়েছে। যে পাখাগুলো থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। এ পাখা থেকেই তারের মাধ্যমে জ্বলে ওঠে দ্বীপ এবং মানুষের ঘর। এই দ্বীপের মানুষের মন প্রকৃতির মতোই সুন্দর, নির্মল ও উজ্জ্বল। যা সহজেই যেকোনো মানুষকে মুগ্ধ করে। যেমন মুগ্ধ করেছে দ্বীপের প্রকৃতি, সকাল ও সমুদ্দুর।

বন্ধু, কক্সবাজার বন্ধুসভা