মানুষ চা খেয়ে দোকানে কাপ রেখে দেয়। কেউ কেউ আবার প্লাস্টিকের কাপে করে নিয়ে আসে। এটা স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু কেউ চা খেতে খেতে কাপ নিয়ে চলে আসে—এমন ঘটনা আগে ঘটেছে কি না, সেটা মনে করতে পারছে না আনিস। বাসে প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আনিস চিন্তা করছে গোটা ব্যাপারটা নিয়ে। ঘটনা ঘটেছে সম্পূর্ণ দিনের আলোতে।
আজ তিতলির সঙ্গে দেখা করার কথা। রাস্তায় প্রচুর জ্যাম থাকাতে মাঝরাস্তায় নেমে গেল সে। রাস্তার পাশের একটা দোকান থেকে এক কাপ চা নিল। আয়েশ করে চা খাচ্ছিল সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে। হঠাৎ জ্যাম ছেড়ে দেওয়ায় কাপসহ আবার বাসে উঠে গেল। বাসে উঠে মনে হলো চায়ের বিল দেওয়া হয়নি। শুধু বিল দেয়নি তা নয়, কাপ নিয়েও চলে এসেছে। বাসও ছেড়ে দিয়েছে। যে ভিড়ের মধ্যে ঢুকেছে, সেখান থেকে বের হওয়াও সম্ভব না। উপায়ান্তর না দেখে হাতের কনুই বাঁকিয়ে কোনোমতে কাপটা পাঞ্জাবির পকেটে রাখল। হাতে থাকলে ব্যাপারটা কেমন দেখায়। কাপটা কি করা যায়, তা নিয়ে এক মহাচিন্তা।
বাস থেকে নেমে কাপ হাতে লেকের দিকে হাঁটতে থাকল। পকেটে থাকলে একপাশ ভারী হয়ে পাঞ্জাবি নিচের দিকে চলে যায়। বাসে ভিড়ের মধ্যে ব্যাপারটা ঠিক থাকলেও এখানে সম্পূর্ণ বিদঘুটে। মনে হয় যেন পকেটে ভারী পাথর রাখা হয়েছে। তিতলি তখনো আসেনি। বসে বসে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই এখন। তিতলি সাধারণত দেরি করে না। আজকে করছে। ফোনে কথা হয়েছে, তার এক মামা এসেছেন। আসতে পারবে কি না, নিশ্চিত করেনি। অবশ্য আনিসকে চলে যাওয়ার জন্য বলেছে। কিন্তু বেকার মানুষের বাসায় গিয়েই আর কি এমন কাজ। তার চেয়ে বসে বসে অপেক্ষা করা মন্দ না।
- মামা চা লাগবে?
- হ্যাঁ, এই কাপে দিন।
চাওয়ালা কাপ দেখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। মুখ ফুটে কিছু বলেনি। চা দিয়ে টাকা নিয়ে চলে গেল।
আনিস মনে মনে ভাবল, যাক কাপটাকে তো কাজে লাগান গেল। আনিস হাঁটছে আর চা খেতে খেতে মানুষ দেখে বেড়াচ্ছে। কাপটাকে এখন মানিয়ে নিয়েছে নিজের সঙ্গে। একটা মুঠোফোন কিংবা হাতঘড়িকে মানুষ যেভাবে মানিয়ে নেয়, সেভাবেই মানিয়ে নিয়েছে। এটাকে এখন আর ঝামেলা মনে হচ্ছে না।
তিতলি আর আসেনি। আনিস সন্ধ্যায় বাসায় ফিরল। ফেরার পথে চায়ের পাতা আর চিনিও নিয়ে এসেছে। কাপটাকে কাজে লাগাতে চায় পুরোপুরি। যখন ইচ্ছা পাতিলে চা বানিয়ে কাপে নিয়ে খাচ্ছে। যেন এই কাপটার জন্যই নতুন করে চায়ের অভ্যাসটা প্রখর হতে শুরু করল। তিতলির সঙ্গে পরের সপ্তাহে দেখা করার কথা। ওইদিনও কাপটাকে সঙ্গে নিয়ে গেল সে। তা দেখে তিতলির রক্তচক্ষু,
- আনিস তুমি চায়ের কাপ নিয়ে ঘুরছ কেন?
- সে এক লম্বা কাহিনি।
- লম্বা কাহিনি মানে? তুমি দোকান থেকে না বলে কাপ নিয়ে এসেছ?
- হ্যাঁ, বিষয়টা এমনই। তবে ভুল করে।
- ফেরত দিয়ে আসনি কেন? যাও ফেরত দিয়ে এসো।
- ফেরত তো দেওয়া যাবে না।
- যাবে না মানে? দোকান চেন না?
- না। সেটাই তো সমস্যা।
- তো কী করার পরিকল্পনা তোমার?
- কিছুই না। কাপটা ফেরত দেওয়ার চেষ্টায় আছি। যদি দোকানটা চিনতে পারি ফেরত দিয়ে আসব। তত দিন আমার কাছেই রাখব।
- রাখব মানে কী? এক্ষুনি ফেলে দাও। দোকান চিনতে পারলে ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিয়ো।
- এটা অবশ্য মন্দ বলোনি। কিন্তু একটা ভালো কাপ ফেলে দেওয়া কি উচিত হবে?
- হবে কি হবে না জানি না। তোমাকে আর এই কাপের সঙ্গে দেখতে চাই না। আমি এখন উঠছি। বাসায় কাজ আছে।
- আরেকটু সময় থেকে গেলে কী হয়?
- ঢং কোরো না। আমি কিসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি তুমি ভালো করেই জান।
- আচ্ছা, এসো।
তিতলিকে একটা রিকশায় তুলে দেয় সে। রাতে তিতলি ফোন দেয়।
- আনিস, কী করছ?
- চা খাচ্ছি।
- ভালো কথা। কাপটা দিয়ে আসছ?
- না। সেটা দিয়েই তো চা খাচ্ছি।
- মানে কী? এটা না ফেরত দিয়ে আসতে বলেছিলাম অথবা ফেলে দিতে বলেছিলাম। যাও এক্ষুনি গিয়ে ফেরত দিয়ে আসো।
- চা শেষ করে যাচ্ছি। মাত্রই শুরু করলাম খাওয়া।
- আমি ফোন রাখছি। তুমি এই কাপের একটা ব্যবস্থা করে তারপর আমায় ফোন দেবে।
ওপাশ থেকে ফোনের লাইন কেটে গেল। আনিস চা খেতে খেতে চিন্তা করছে। আজকে এটার ব্যবস্থা না করলে তিতলির অভিমান বাড়বে। মেয়েটা হয়তো আর কথাই বলবে না তাঁর সঙ্গে। একটা উপায় বের করতেই হবে। চাইলেই তো চায়ের কাপ রাস্তায় ফেলে দেওয়া যায় না। হঠাৎ একটা নতুন ভাবনা খেলে যায় মাথায়। চা শেষ করার পর কাপটা ভালো করে ধুয়ে কাগজ দিয়ে সুন্দর করে মুড়িয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায় আনিস।
পরদিন বিকেলে তিতলির ফোন,
- আনিস, তুমি কোথায় আছ? এক্ষুনি আমার সঙ্গে দেখা করো।
- এখন তো আসতে পারব না। আমি ট্রেনে। গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি। ঢাকায় এসে দেখা করব।
তিতলি রাগে গজগজ করতে করতে ফোন কেটে দেয়। তাঁর সামনে চায়ের কাপটা পরে থাকে, যেটা গতকাল আনিস কুরিয়ার করে পাঠিয়েছে।
সাবেক সহসভাপতি, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা