লোককথা, লোকগাথা, লোকগল্প, লোকগীতি বাংলাদেশের প্রাণ। গ্রামীণ জনজীবনের ভেতর থেকে উঠে আসা লোকগল্পের মধ্যেই আবহমানকালের বঙ্গসংস্কৃতির রসদ। ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক এই লোককথার নির্মাণ-পুনর্নির্মাণের মধ্যেই বাংলাদেশের জাগরণ–পুনর্জাগরণ। নদীমাতৃক গ্রামবাংলার তেমনই এক মাঝিকেন্দ্রিক জীবনের গল্প নতুন রূপে, নতুন বুননে নির্মাণ করলেন বর্ষীয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝন্টু। তাঁর কাহিনি–চিত্রনাট্যে সুজন মাঝি প্রকৃত দর্শনে জীবননদীর ভাঙাগড়ার খেলার কান্ডারি এবং বাংলার মাঝি হয়ে উঠল।
নিজের অস্তিত্ব অক্ষত রেখেও বাংলার গ্রাম আজ ভুবন গ্রামের অংশ। নৌকার মাঝি সুজনের পকেটে তাই মুঠোফোন থাকে। গ্রামের পাকা রাস্তায় যন্ত্রচালিত ছোট ছোট যাত্রীযান চলে। সুজন মাঝির ঘরবাড়ি বাঁশ আর টিন দিয়ে গড়া হলেও গ্রামের রক্তচোষা সুদখোর মহাজন সরকারের বাড়ির প্রবেশদ্বার, বাড়ির সুসজ্জিত অন্দরমহল একেবারে ঢাকা শহরের ধনী মানুষের অভিজাত বাড়ির মতো।
গরিব অশিক্ষিত সুজন মাঝি বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী ভাইকে ডাক্তার বানাবে বলে নিজে পড়াশোনা করেনি। নৌকা চালিয়ে ভাই আপনকে শহরে পড়াশোনা করিয়ে ডাক্তার বানিয়েছে। ব্যক্তিমানুষের এই লড়াইয়ের গল্পগুলো বাস্তবে অমিল নয়।
ডাক্তার ভাই গ্রামে এসে একজনের প্রেমে পড়ে। সেই মেয়ে যাকে বাবা বলে ডাকে, সেই বাবা আসলে সুজন–আপনের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিভ্রষ্ট বাবা রমজান মিয়া। এই শহুরে পাস করা ডাক্তার আর গ্রামীণ ‘কচুপাতার ডাক্তার’ পরস্পরকে প্রেম নিবেদনে, গ্রামীণ প্রকৃতির সান্নিধ্যে যখন নেচে বেড়ায়, গানের দৃশ্যে দুজনের পরনে থাকে শহুরে নায়ক–নায়িকার পোশাক—এই বিষয়গুলো শুধু বাণিজ্যিক সিনেমার উপকরণ নয়, সাংকেতিক অর্থবহ।
গ্রামের ছেলেমেয়েরা কখনো কারও হাত-পা সামান্য কেটে গিয়ে রক্ত বেরোলে তৎক্ষণাৎ দুই হাতে গাঁদা ফুলের পাতা কচলে বা কচুপাতার রস বের করে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে রক্ত বন্ধের টোটকা, উপশম হিসেবে ব্যবহার করে। ডাক্তারের ফেটে যাওয়া কপালে গ্রাম্য কন্যাও কচুপাতার রস লাগায়। অশিক্ষিত সুজন একবর্ণও ইংরেজি বোঝে না। গান শুনে তার প্রেমে পড়ে বিলাতফেরত উচ্চশিক্ষিত কন্যা পারুল। অশিক্ষিত মাঝিমাল্লাদের এই লোকগানের মধ্যে এমন একধরনের জাদু আছে, দেশ-বিদেশ ঘোরা মানুষকেও মোহিত করে। নিয়তির পরিহাস, এই কন্যা আবার গ্রামের সেই মোড়ল মাতব্বর সরকারের মেয়ে।
এই প্রেম, সম্পর্ক নিয়ে সুজনের মনে অনেক সংশয়। পারুল নিজে কিন্তু বলে, ভালোবাসা মানুষের মন থেকে হয়, ধনী–গরিবের সম্পদ দিয়ে নয়। সুজনের হৃদয়ের স্পর্শ পেতে পারুল মরিয়া। পারুলের জন্য সুজন গামছায় মুড়ে সাজগোজের অনেক প্রসাধনী কিনে আনে। নিজের মনের মতো করে পারুলকে সাজিয়ে তুলতে চায়। এই যে অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যবোধ, এগুলোই তো শিল্পীর প্রকৃত পরিচয়। লাখো কোটি টাকার সম্পদ দিয়েও ছোট ছোট মানুষের এমন বড় অনুভবগুলো পাওয়া যায় না। সুজনের গালে পারুল চুমু খেলে আত্মভোলা সুজন আবেগে–আহ্লাদে শিশুর মতো হয়ে যায়।
লোককথার সঙ্গে লোকজীবনের সুর এসে মেশে। এই চলচ্চিত্রে ‘সুজন মাঝি রে জীবনের এই নৌকা চলে রে…’ দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর লেখা, আনোয়ার জাহান নান্টুর সুর করা, তারেক আর শম্পা কাওসারের কণ্ঠে অসাধারণ গানটা ঘুরেফিরে প্রতিফলিত হয়।
এভাবে ক্ষুদ্র গ্রামের সঙ্গে আজকের বৃহত্তর ভুবন গ্রাম এসে মেশে। শিক্ষিতের সঙ্গে স্বশিক্ষিতের, ধনীর সঙ্গে গরিবের, লোকগল্পের সঙ্গে বর্তমান সমাজবাস্তবতার মিলনে, মানুষে মানুষে সামাজিক বিভাজন ঘোচাতে, অত্যাচারীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সরব সোচ্চার প্রতিবাদ হয়ে চিরকালীন শোষিত–লাঞ্ছিত লোকব্যথার মুক্তির পুনর্নির্মাণ ঘটে।
এই চলচ্চিত্রে গল্পের চাবিকাঠি একটি স্যান্ডেলে। সুজনের মা আয়েশাকে একসময় কুপ্রস্তাব দিয়েছিল মাতব্বর সরকার। রাজি না হলে ভিটামাটিছাড়া করবে বলেছিল। আয়েশা নিজের চপ্পল ছুড়ে মেরেছে। লোভী, অসৎ, সুদখোর, কামুক মাতব্বর সেই চপ্পল দিয়ে ছোট দুই সন্তানের সামনে আয়েশাকে মেরেছে। বড় সন্তান সুজন সেদিন মায়ের অপমানের যোগ্য জবাব দেবে বলে সেই চপ্পল সযত্নে বুকে তুলে রেখেছিল।
সময়ের পরিক্রমায় সেই অত্যাচারীর কন্যা সুজনের প্রেমে পড়ল। আর সুজন বুকের ভেতর পুষে রাখা প্রতিশোধের আগুন সেই চপ্পল দিয়ে সরকারকে মারবে। গ্রামের সহজ–সরল মানুষ যে এভাবেই চিরকাল ভেবে এসেছে। কিন্তু আমরা যারা চিরকাল কোনো না কোনোভাবে কারও দ্বারা অত্যাচারিত–অপমানিত–লাঞ্ছিত হই, চপ্পলের বদলা চপ্পল না হলেও সরবে বা নীরবে দিনের পর দিন কঠিন পরিশ্রমে নিজেকে তৈরি করে যোগ্য জবাব ফিরিয়ে দিতে প্রস্তুত হতে থাকি।
লোককথার সঙ্গে লোকজীবনের সুর এসে মেশে। এই চলচ্চিত্রে ‘সুজন মাঝি রে জীবনের এই নৌকা চলে রে…’ দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর লেখা, আনোয়ার জাহান নান্টুর সুর করা, তারেক আর শম্পা কাওসারের কণ্ঠে অসাধারণ গানটা ঘুরেফিরে প্রতিফলিত হয়। রমজানের কণ্ঠের গান সন্তান সুজনের কণ্ঠে ফিরে আসে। সুজনের কণ্ঠের গান পারুলের হৃদয়ে পাক খায়। পারুলের গান সুজনকে বিদ্ধ করে। সুজনের কণ্ঠে নিজের গান শুনে, নিজের হারিয়ে যাওয়া জীবনের নৌকা দেখে স্মৃতিভ্রষ্ট রমজানের স্মৃতি ফিরে আসার উপক্রম হয়।
ছবির প্রযোজক আবু সায়েদ খান এই সিনেমার জন্য গান লিখেছেন, ‘আমার অন্ধ চোখের নিন্দা কোরো না…’। সুজন আর আপন ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে যখন বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে, একজন অন্ধ বৃদ্ধের কণ্ঠে এই গান ব্যবহার করা হয়েছে। গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন অন্ধ শিল্পী রাসেল নূরী। মনের আলোয় গান করে তিনি লাখ লাখ মানুষের হৃদয় আলোকিত করে চলেছেন। বাস্তব আর শিল্পমাধ্যম এভাবেই হাত ধরাধরি করে চলে। আবার পুরোনো সৃষ্টি ঐতিহ্যের পুনরাবৃত্তি, পুনর্নির্মাণে এন্ড্রু কিশোর ও সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠে ঝিনুকমালা ছবির কালজয়ী গান ‘তুমি আমার মনের মাঝি আমার পরান পাখি/ আমার বাড়ি যাইও দিমু ভালোবাসা’ এই চলচ্চিত্রে নতুনভাবে চিত্রায়িত হয়েছে।
সুজন চরিত্রে ফেরদৌস নিজের শিল্পীসত্তার শতভাগ উজাড় করে দিয়েছেন। পারুল চরিত্রে ফেরদৌসের যোগ্য জুটি নিপুণ। অসম্ভব আশার আলোর প্রতিভাময়ী এক দ্যুতি। রাতুল খান, রূপকথা, কাজী হায়াৎ, সেলিম, সিয়াম খান, গাঙ্গুয়া, তিথি, শিউলি আক্তার—প্রত্যেকেই নিজ নিজ চরিত্রে সুন্দর। তবে শিউলিকে মায়ের চরিত্রে আরও একটু ভাঙতে হতো। বঙ্গজননীরা চিরকালই ভঙ্গুরপ্রাণ। নৌকা মানুষকে বয়ে নিয়ে যায়। অসুস্থ স্বামীকে বাঁচাতে সেই নৌকা দড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে স্ত্রী—এই অনুভূতি, দৃশ্য অসাধারণ।
ছবির কারিগরি প্রতিটি দিক ভালো। গ্রামের মানুষের ভাষা, স্বপ্ন, লড়াই, অনালোকিত দিক ঝন্টুর মতো এত ভালো আর কেউ তুলে আনতে পারেন না। গ্রামের ধানকলের শ্রমিক বউকে নিয়ে বৃহস্পতিবার বা শুক্রবার বিকেলে গ্রামীণ হাটের ছোট্ট সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখবেন বলে ঝন্টু সিনেমা বানান। শহুরে শিক্ষিত বোদ্ধাকেও অক্সিজেন নিতে গ্রামে ফিরে যেতে হয়। মাটির টানে এ ধরনের ছবি তাঁদেরও প্রাণসঞ্চার করে।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত