নতুন গবেষকদের জন্য ‘গবেষণার হাতেখড়ি’

রাগিব হাসানের ‘গবেষণার হাতেখড়ি’ছবি: সংগৃহীত

প্রাণিকুলের মধ্যে মানুষের বিশেষত্ব হলো, তারা সভ্যতা গঠনে ক্ষমতা রাখেন। সভ্যতাকে প্রতিনিয়ত অগ্রগতির সোপানে আরোহণ করাতে পারে কেবলই মানুষ। আর সভ্যতার এই উৎকর্ষ সাধনের পেছনে কারিগর হিসেবে ভূমিকা পালন করেন গবেষকেরা। পৃথিবীর গতিপথ রচনার মতো মহা গুরুত্ববহ কাজে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন গবেষণায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা।

কিন্তু গবেষণা আসলে কী? গবেষণা কেন করতে হয়? গবেষণা কীভাবে করতে হয়? শুরুর পাঠগুলোই–বা কী? এ ধরনের নানা প্রশ্ন তরুণ মস্তিষ্কে বারবার উদয় হয়। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের মতো দেশের শিক্ষার্থীদের অনেকেই গবেষণায় বেশ উৎসাহ বোধ করেন। কিন্তু এই অভেদ্য প্রশ্নগুলোর বোধগম্য কোনো জবাব না পেয়ে একসময় দমে যান অথবা প্রাথমিক পাঠ জানা না থাকায় অনুসরণ করতে থাকেন ভুল পন্থা।

বাংলাদেশের এমন উৎসুক শিক্ষার্থী ও তরুণ গবেষকদের জন্য গবেষণায় শুরুর দিকের কর্তব্য ও গবেষণা আদ্যোপান্ত নিয়ে ‘গবেষণার হাতেখড়ি’ বইটি রচনা করেছেন ইউনিভার্সিটি অব আলাবামা, বার্মিংহামে কম্পিউটার বিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক রাগিব হাসান। সাধারণ পাঠকের উপযোগী করে অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় লেখক গবেষণার আদ্যোপান্ত ধারাবাহিকভাবে এই বইয়ে উপস্থাপন করেছেন। আলোচনার সুবিধার্থে লেখক বইটি সাজিয়েছেন ছয়টি বড় অধ্যায়ের অধীনে এবং প্রতিটি অধ্যায়ের কলেবরে রয়েছে একই বিষয়ে একাধিক পরিচ্ছদ।

এক.
গবেষণার জগৎ: পর্যায় ও প্রাথমিক প্রস্তুতি অধ্যায়ে লেখক শুরুতেই গবেষণা ধারণাটি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। গবেষণার নানা ধরন সম্পর্কে আলোচনার পাশাপাশি এর প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেছেন। আমাদের ধারণা, গবেষণা একটি সহজাত বা প্রাকৃতিক বিষয়। কিন্তু লেখক বলেছেন ভিন্ন কথা। তিনি জিনিসটাকে হাতেকলমে শেখার বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করেছেন এবং এর জন্য প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ধাপগুলো বর্ণনা করেছেন।

গবেষণার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা রয়েছে, সেটি অনুসরণ ছাড়া সফল গবেষণা আদৌ সম্ভব নয়। তাই লেখক প্রথম অধ্যায়েই সেই কর্মপন্থা উল্লেখ করেছেন। প্রথম অধ্যায়ের ইতি টেনেছেন জরুরি একটি বিষয়ের অবতারণা করে, তা হলো গবেষণার জগতে প্রবেশের শুরুতে যে কাজ বা দক্ষতা অর্জন করা বাধ্যতামূলক, সেটির উল্লেখ।

দুই.
কোনো বিষয়ে গবেষণার প্রথম কাজ হচ্ছে সেই বিষয়ে আগে যেসব গবেষণা করা হয়েছে বা গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে, সে সম্পর্কে জানা, যাকে লিটারেচার রিভিউ বলা হয়। লেখক লিটারেচার রিভিউ সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ে রিসার্চ পেপার পড়া, রিসার্চ পেপার রিভিউ করা ও সার্ভে বা রিভিউ আর্টিকেল লেখার পদ্ধতি সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন।

একজন গবেষকের নিত্যদিনের কাজ হলো গবেষণাপত্র পড়া। গবেষণাপত্র ক্ষেত্র বিশেষে ২–৩ পৃষ্ঠা থেকে ১৫-২০ পর্যন্ত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে কীভাবে কম সময়ক্ষেপণ করে অধিক দক্ষতার সঙ্গে পড়ে তার মর্মোদ্‌ঘাটন করা যায়, সেই বিষয়ে বিস্তারিত দিকনির্দেশনা রয়েছে এই অধ্যায়ে। একইসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ চারটি ধাপ; যার সাহায্যে সহজে গবেষণাপত্র পড়ে উপকৃত হওয়া যায়, তা উল্লেখ করেছেন। একটি গবেষণাপত্র পড়ার পরই সেটির ওপর একটা রিভিউ লিখলে তা পরবর্তী সময়ে অনেক কাজে লাগে। তাই কীভাবে রিভিউ করতে হয় তা-ও লেখক এই অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন।

তিন.
গবেষণার একটা বড় জায়গা হলো নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে কাজ করা। নতুন আইডিয়া জেনারেট করার প্রতিষ্ঠিত মাধ্যম হচ্ছে ‘ব্রেনস্টর্ম’ করা। লেখক এই অধ্যায়ে ‘ব্রেনস্টর্ম’–এর সঠিক ধাপ কী কী এবং এটি কীভাবে নতুন আইডিয়া সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে, তার উদাহরণসহ ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। একইসঙ্গে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে কীভাবে সেই আইডিয়াকে যাচাই, পরীক্ষা এবং এর সামঞ্জস্যপূর্ণ সমাধান বের করা যায়, তা-ও বলে দিয়েছেন। পাশাপাশি চিত্তাকর্ষকভাবে আইডিয়াকে উপস্থাপন করে কাউকে বোঝানোর কায়দা শিখিয়ে দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে স্ট্যানফোর্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআরআই) সহজ পদ্ধতি NABC (N=Need, A= Approach, B=Benefit, C=Competition) তুলে ধরেছেন।

চার.
লেখক গবেষণার ফলাফল প্রকাশের ওপর বৃহৎ কলেবরে আলোচনা উপস্থাপন করেছেন। ফলাফল প্রকাশের মূল মাধ্যম হচ্ছে গবেষণাপত্র। আর এটা প্রকাশ করতে হয় কনফারেন্স বা জার্নালে। তার আগের কাজ হচ্ছে গবেষণাপত্র লেখা। লেখার সুনির্দিষ্ট কিছু পদ্ধতি আছে, যেগুলো অনুসরণ না করলে সেটা প্রকাশের অযোগ্য হয়ে পড়ে। তাই অধ্যায়ের শুরুতেই রিসার্চ পেপার লেখার প্রক্রিয়া এবং কোন কোন অংশ কীভাবে লিখতে হয়, তা হাতেকলমে শিখিয়ে দিয়েছেন।

জার্নাল পেপার প্রকাশ করার আগে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে জার্নাল নির্বাচন এবং সেটির নিয়মকানুন সম্পর্কে সম্যক অবগত থাকা। সে জন্য লেখক জার্নাল নির্বাচন থেকে শুরু করে জার্নালে লেখা প্রকাশ এবং প্রকাশ–পরবর্তী গবেষকের কাজ সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন এই অধ্যায়ে। এ ছাড়া কনফারেন্সে গবেষণার ফলাফল উপস্থাপনের স্লাইড রেডি করা, টাইম ম্যানেজমেন্ট, স্লাইডের সাইজ, ফন্ট, ছবি কেমন হওয়া উচিত তার খুঁটিনাটি ব্যাখা করেছেন। ফলাফল উপস্থাপনের সময় গবেষকের অবশ্যই বক্তৃতা প্রদান করতে হয়। সে ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয় পরিহার করা কর্তব্য তা উল্লেখ করেছেন। এ অধ্যায়টি শেষ করেছেন গবেষণাপত্র লেখার ক্ষেত্রে লেখার মান কীভাবে আরও শাণিত করা যায়, সেই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরামর্শ প্রদান করার মাধ্যমে।

পাঁচ.
গবেষণার আনুষঙ্গিক বিষয় অধ্যায়ে লেখক গবেষণার নৈতিকতা, কুম্ভীলকবৃত্তি সম্পর্কে সচেতন করেছেন। গবেষণা জার্নালের প্রভাব ফ্যাক্টর, কনফারেন্সের স্বীকৃতি হার এবং গবেষকের H-index ও i10 index–ভিত্তিক হিসাবগুলো ব্যাখ্যা করেছেন। এ ছাড়া গবেষণার ফান্ডিং কীভাবে পাওয়া যাবে, কোন সোর্স থেকে ফান্ডিং সুযোগ দেওয়া হয়; সর্বোপরি গবেষণার অর্থায়নের আদ্যোপান্ত বর্ণনা করেছেন।

একজন গবেষক হিসেবে গবেষণার কাজের পাশাপাশি যে অভ্যাসগুলো গড়ে তোলা আবশ্যক, তার একটি রূপরেখা উপস্থাপন করেছেন। একজন গবেষক হিসেবে দৈনন্দিন সময়গুলো কীভাবে সুশৃঙ্খলভাবে সংরক্ষণ করতে হয়, গবেষণার প্রতিবন্ধকতাগুলো কীভাবে সফলভাবে উত্তরণ করা যায়, সে সংক্রান্ত আলোচনাও করেছেন। গবেষক হিসেবে নিজের কাজগুলো অন্য গবেষকদের সঙ্গে পরিচিত করানো এবং নিজের গবেষক পরিচয়কে প্রকাশিত করার জন্য কী কী পন্থা অনুসরণ করা যায়, তা উল্লেখ করেছেন। এ ক্ষেত্রে গবেষণা-সংক্রান্ত আলাপ করার আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি (ই–মেইল, ওয়েবসাইট ইত্যাদি) সম্পর্কে আলোচনা উপস্থাপন করেছেন। লেখক অধ্যায়টির সমাপ্তি টেনেছেন পিএইচডি ডিগ্রির রোডম্যাপ এবং খুদে গবেষকদের জন্য একটি স্বচ্ছ রূপরেখা উল্লেখের মাধ্যমে।

ছয়.
এই বইয়ের অন্যতম বিশেষত্ব হচ্ছে, লেখক গবেষণা বিষয়ে শুধু তথ্য এবং পরামর্শ প্রদান করেই ক্ষান্ত থাকেননি। পাশাপাশি একজন শিক্ষার্থীকে গবেষক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য বইয়ের শেষে দিয়েছেন প্র্যাকটিক্যাল কেস-স্টাডি। পুরো বইয়ে উপস্থাপিত বিষয়কে সংক্ষেপণ করে লেখক শেষে উল্লেখ করেছেন একজন নবীন গবেষক হিসেবে দৈনন্দিন বাড়ির কাজ কী হওয়া উচিত, তা ছক আকারে উল্লেখ করেছেন। যাতে এই বই পাঠান্তে যেকোনো শিক্ষার্থী খাতা-কলমে গুছিয়ে গবেষণার কাজ শুরু করে দিতে পারেন।

পরিশেষে বাংলাভাষী পাঠকের কাছে এই বই গবেষণা জগতের নতুন দুয়ার উন্মোচন করবে। গবেষণা করতে অভিলাষী যেসব শিক্ষার্থী সঠিক দিকনির্দেশনা ও পরামর্শের অভাবে তাঁদের ইচ্ছাকে নিজ হাতে প্রায় হত্যা করছে, তাঁরা আশার আলো দেখতে পাবে। ইংরেজি ভাষায় কাঁড়ি কাঁড়ি বইয়ের হদিস পাওয়া গেলেও বাংলা ভাষায় গবেষণা-সংক্রান্ত বই সম্ভবত এটাই প্রথম। বাংলা ভাষাভাষী শিক্ষার্থীদের হৃদয়ের গভীরের রোনাজারি নিশ্চিতই লেখকের কর্ণ ভেদ করে হৃদয়ে আঘাত করেছে। লেখকের কাছে আমার মতোই হয়তো সহস্র তরুণ গবেষণা-অভিলাষী শিক্ষার্থী কৃতজ্ঞ।

বাংলাভাষী প্রত্যেক শিক্ষার্থীর টেবিলে এই বই স্থান পাওয়া উচিত। যাঁরা গবেষণা করতে ইচ্ছুক, তাঁরা গবেষণার সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত হতে পারবেন। আর যাঁরা গবেষণাকে অতি মানবিক বিষয় মনে করে সাহস করে উঠতে পারেন না, তাঁরাও এই বই পাঠে নতুনভাবে গবেষণার প্রতি উৎসাহ বোধ করবেন বলে আশা করি।

শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়