বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থার ছবি ‘নয়নমনি’

নয়নমনি চলচ্চিত্রে ফারুকের সঙ্গে ববিতাছবি: সংগৃহীত

হতে পারত নয়ন আর মনি নামের গ্রাম্য দুই যুবক-যুবতীর অমর প্রেমের কাহিনি ‘নয়নমনি’। কিন্তু পরিচালক আমজাদ হোসেন তা না করে চলচ্চিত্রটিকে করে তুললেন সমাজ বদলের হাতিয়ার, বিদ্রোহের একটা ছবি। নিজের রচিত সুসাহিত্য ‘নিরক্ষর স্বর্গে’ কাহিনি অবলম্বনে তাঁর এই চলচ্চিত্র। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বাংলাদেশের কিংবদন্তি এই পরিচালকের দার্শনিক, সমাজ ভাবনার প্রতিফলন শুধু নয়, গোটা চলচ্চিত্রের পরতে পরতে শৈল্পিক নিপুণ বুননের প্রতিচ্ছবি রয়েছে।

এই চলচ্চিত্রের বিখ্যাত একটি গান সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে ‘নানি গো নানি..’ আমার মাকেও মাঝেমধ্যে উৎফুল্ল চিত্তে গুন গুন করতে দেখতাম। নানী চরিত্রে অভিনয় করেছেন কিংবদন্তি রওশন জামিল। ১৯৭৬ সালে চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। বাংলাদেশের অসংখ্য তরুণ প্রাণকে জাদুর ছোঁয়ায় মুগ্ধ করে রাখতে পেরেছিলেন পরিচালক। বড় হওয়ার পর আমাদেরও কানে, মনেপ্রাণে থেকে গিয়েছে এই গান, সুর। চলচ্চিত্রের সুরকার সত্য সাহা হলেও আমরা জানি আমজাদ হোসেন ছিলেন একজন গান এবং সুরেরও জাদুকর। শুরু থেকেই গ্রামবাংলার মেঠো সুরের ছবির শীর্ষ সূচনা সুর কানের, প্রাণের আরাম দেয়। বুকে দোলা লাগে।

ছবিতে এক পাড়া গাঁয়ের বাউল, গায়েন আছে। অভিনয়ে সৈয়দ হাসান ইমাম। পড়শি এক শিশুকে নিজের ঘর আলো করে পেয়ে বিখ্যাত গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা কথায় নূপুর পায়ে নাচতে নাচতে সে যখন গেয়ে ওঠে ‘অনাথিনীর বুকের মানিক বল আমারে বল রে /ছায়া নিলি কোন ভরসায় মরা গাছের তলে রে, নানা হে..’ অপূর্ব সেই দৃশ্য। আমরাও যেন গায়েনের তালে তালে শৈশবের দোলনায় দোল খেতে থাকি। জন্ম মুখে শিশুর ঘরে আগুন লেগেছে, বাণিজ্যে অনৈতিক কাজের অপরাধে পুলিশ তার পিতাকে ধরে নিয়ে যায়। আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামবাসী সবকিছুর জন্য অলুক্ষণে এক রত্তি শিশুকে দায়ী করে বসে। এই শিশুটিই হবে নয়ন। নয়নও বাউলের ঘরে নিজের বিতাড়িত মাসহ প্রতিপালিত হয়। কৈশোরে দুষ্টুমির বশে প্রিয় সঙ্গিনীকে গুলতি দিয়ে মারার অপরাধে মোড়ল তাকে গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার নিদান দেয়। এই সঙ্গিনীই হলো মনি। কৈশোরে মনির চরিত্রে অভিনয় করে শিশুশিল্পী তারানা। পরবর্তী সময়ে যিনি হন চলচ্চিত্র জগতের তারকা তারানা হালিম। আর মনি বড় হয়ে গেলে সেই চরিত্রে দেখা যায় ববিতাকে।

অন্ধকারে নিমজ্জিত সমাজের কুসংস্কার, ধর্মীয় মৌলবাদ এবং চিরাচরিত আগ্রাসী প্রভুত্ববাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামী মানুষের লড়াই করে টিকে থাকার ইতিহাসকে শিল্পায়িত করা হয়েছে এখানে। কিশোর নয়ন বড় হয়ে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়। সেই চরিত্র হলেন ফারুক। ফারুকের পাশে থাকে গোলাপ আলী চরিত্রে টেলি সামাদসহ অনেকে।

কুসংস্কার ছড়িয়ে মানুষকে অন্ধ করে রাখার মধ্যে প্রভুত্ববাদের রাজনীতি আছে। এখানে যেমন মনিকে বিয়ে করতে চায় বুড়ো মোড়ল। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় দাপটের আড়ালে ঘরে তার আরও দুটি বিবি আছে। পানের মধ্যে বড়ি মিশিয়ে দিয়ে সে জোর করে মনিকে খাওয়ায় আর মনির মানসিক অসুখ দেখা দেয়। বটগাছের ওপর ওঠে আবোল তাবোল বকে। গ্রামের মানুষ ভাবে, এটা বটগাছের জিন।

নয়নমনি চলচ্চিত্রে ফারুকের সঙ্গে ববিতা

জিনের উৎপাত বন্ধ করতে নয়ন এসে গোটা গাছটা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। ব্যক্তির প্রতিবাদ ধীরে ধীরে সমষ্টির রূপ নেয়। মোড়লের অত্যাচার এমনই, নিদান না দিলে মৃত মানুষের সৎকার পর্যন্ত হয় না। নয়ন এসে সেখানেও মানবিকতার পরিচয় দেয়। বিদ্রোহ ঘোষণা করে। গ্রামের পদ্ম কাকী অভিনয়ে আনোয়ারা, নয়নকে ছোটবেলায় ভাত খাইয়ে দিত। নিঃসন্তান এই নারী নিজের গয়না তুলে দেয় নয়নকে দোকান দেওয়ার জন্য। পেটের নাড়ি ছেঁড়া ধনের বাইরেও যে হৃদয়ের টানের সম্পর্ক হয়, গ্রামীণ সহজসরল মানুষের জীবন থেকে উঠে আসে। আবার আনোয়ারার মধ্যে মাতা যশোধাসুলভ যে মাতৃত্ব, আমজাদ তা–ও ধরে রাখতে পেরেছেন। নিজের সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গত রেখে চরিত্র নির্বাচনেও পরিচালক ছিলেন একেবারে পাকা জহুরী।

ধর্মান্ধ মোড়লের চোখে নয়ন ততদিনে হয়ে উঠেছে কমিউনিস্ট। অচলায়তন জীর্ণ পুরাতন সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে নতুন সমাজ গড়তে চায় যে কমিউনিস্ট আদর্শের বিপ্লবীরা, উগ্র মৌলবাদীরা তাদের যে শত্রু ভাববে সেটাই স্বাভাবিক। গ্রামে যাত্রাপালার আসর বসে; নয়ন তার পালক গুরু গায়েনের সঙ্গে গান ধরে, ‘কোন কিতাবে লেখা আছে হারাম বাজনা গান…’ শুনে মোড়ল চটে যায়। গানের কোনো যুক্তি ওরা মেনে নেবে না। লোক পাঠিয়ে নয়নের দোকানের সবকিছু চুরি করা হয়। গায়েন চরিত্রের সঙ্গে তরুণ গায়েন নয়নের রূপসজ্জা, সাজসজ্জার মিলও চোখে পড়ার মতো। আমজাদ একজন দক্ষ শিল্পনির্দেশকও বটে। এ ধরনের দৃশ্যের উপযুক্ত পৌরাণিক বা লোকায়ত চলচ্চিত্রের সঙ্গে কাজ করতে গবেষণামূলক গানও সংগ্রহ করেছেন গোটা বাংলাদেশ থেকে।

চলচ্চিত্রের কঠিন বক্তব্য, দার্শনিক ভাবনাকে একদিকে সহজসরল ভাবে উপস্থাপন করার গুণাবলি, সঙ্গে কাঠিন্যকে সরল করে দর্শকের মনোরঞ্জন করার শৈল্পিক ভাবনায় দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরের বৈচিত্র্যও লক্ষণীয়। নয়ন আর মনির প্রণয়ের দৃশ্যে সাবিনা ইয়াসমিন এবং সৈয়দ আব্দুল হাদীর কণ্ঠের ‘আমি কোথায় বলো কোথায় থাকিরে বটগাছের পাতা নাইরে..’ সুন্দর গানটিও যথেষ্ট উপভোগ্য। এ রকম লোকজ সুরের সুন্দর গানগুলো আসল বাংলাদেশের পরিচয় বহন করে। কিংবদন্তি ফেরদৌসী রহমান, ইন্দ্র মোহন রাজবংশী এবং চিত্রা সুলতানাও অন্য গানে কণ্ঠ দিয়েছেন।

ছোট্ট নয়নকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল বাবা নইমুদ্দি। মোড়লের বিচারসভায় কিশোর নয়নকেও নিদান স্বরূপ জুতো মেরে গ্রাম থেকে তাড়িয়েছিল। সেই মোড়লের চক্রান্ত এবার নইমুদ্দিকে চোর সাজিয়ে হাজির করে নয়নের সামনে। নয়ন ভুল বুঝে পিতাকে আঘাত করে। শেষ দৃশ্যে এসে সবকিছুর ফয়সালা হয়, মোড়লের বাইশ গ্রামের লাঠিয়ালের সঙ্গে নয়নের প্রতিরোধ বাহিনীর সম্মুখ সমরে পিতাও লাঠি ধরে ছুটে এসে সন্তানের পক্ষ নেয়। এই তেজী লাঠিয়ালদেরও আমরা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে দেখেছি। কিংবদন্তি আনোয়ার হোসেন নইমুদ্দি চরিত্রে অসাধারণ।

মোড়ল চরিত্রে অভিনয়জগতের ইতিহাস-পুরুষ এ টি এম শামসুজ্জামান অনন্য। মোড়ল যখন মনিকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে, প্রতিরোধ বাহিনীর রক্তে তখন আগুন, হাতে মশাল। নয়ন এসে অত্যাচারী মোড়লকে বধ করে, প্রাণপ্রিয়াকে উদ্ধার করে। বিদ্রোহের আগুন আর প্রেমের মিলনের নিদারুণ লগ্নও বটে এই মুহূর্ত। প্রতিবাদী কণ্ঠ বলে ওঠে, মশাল নিভতে দেওয়া যাবে না। কারণ, একজন মোড়কের মৃত্যুতে এই আগ্রাসী সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন হবে না। অসংখ্য মোড়ল সমাজের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন বুনেছেন আমজাদ। আজকের বাংলাদেশের পরিস্থিতির সঙ্গেও তা কেমন প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত