আত্মদহনে সুগন্ধ বিলিয়ে যাওয়া এক নারীর গল্প ‘রজনীগন্ধা’

‘রজনীগন্ধা’ চলচ্চিত্রের পোস্টারসংগৃহীত

স্নিগ্ধ এবং সতেজ পারিবারিক বন্ধনের সুবাস ‘রজনীগন্ধা’। ধূপকাঠির মতো নিজেকে পুড়িয়ে আত্মদহনে সুগন্ধ বিলিয়ে যাওয়া এক নারীর গল্প ‘রজনীগন্ধা’। ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’ প্রবাদবাক্যটি যুগ যুগ ধরে সত্য প্রমাণিত হয়ে এসেছে আমাদের জীবনে। সেই সত্যেরই একটি আক্ষরিক রূপ ১৯৮২ সালে মুক্তি পাওয়া কামাল আহমেদের চলচ্চিত্র ‘রজনীগন্ধা’। হঠাৎ দ্রুতগতিতে পাল্টে যাওয়া সমাজব্যবস্থায়, রাতের গহিন অন্ধকারে ভোগবাদী মত্তবিলাসী কীটেরা যখন সমাজ-পরিবার, রাজনীতি, রাষ্ট্রব্যবস্থা সবকিছুকে গ্রাস করে ফেলতে উদ্যত; এই প্রবল পরাক্রমী স্রোতের বিরুদ্ধে হেঁটে ফুল্লোলিত জ্যোৎস্নার মতো আত্মমর্যাদায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা, এক সাহসী নারীর কাহিনি এটি। চলচ্চিত্রের নিপুণ এই কাহিনি, চিত্রনাট্য, সংলাপ বুনেছেন ইসমাইল মোহাম্মদ।

সমাজের পাশাপাশি দুটি শ্রেণিকে রেখে অবক্ষয়ের মধ্যে এক শ্রেণি থেকে অন্য শ্রেণিতে উত্তরণ এবং একটা মূল্যবোধের দৃষ্টান্ত স্থাপন করার চেষ্টা করেছেন পরিচালক। শ্রেণি তো সামাজিক, অর্থনৈতিক একটা বিভাজন। মানুষকে মানুষের থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এই বৃত্ত ব্যবধান। ১৮ বছর আগে তপন এবং সুধাদের দুটি মধ্যবিত্ত পরিবার প্রতিবেশী ছিল। সুধার বাবা চিরকাল অধ্যাপনা করে এসেছেন। তপনের ব্যবসায়ী বাবা কর্মবীর। ছোট ব্যবসাকে নিরলস পরিশ্রমে বড় ব্যবসায় রূপান্তরিত করেন। একটা ইন্ডাস্ট্রি থেকে দুটি ইন্ডাস্ট্রি, ক্রমে গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করার নেশা পেয়ে বসে। এভাবে অর্থ ও প্রতিপত্তির নেশা পেয়ে বসাতে, প্রতিযোগিতায় দৌড়াতে দৌড়াতে অগাধ সম্পত্তি রেখে অকালে হারিয়ে গেলেন। নিজে কিন্তু কিছু ভোগ করে যেতে পারলেন না। নিজের শরীর, স্বাস্থ্যের দিকেও নজর দিতে পারেননি। এখানেও সমাজের চিরাচরিত প্রতিফলন, আমরণ পরিশ্রমে একজন শুধু তৈরি করে যান, অন্যজন এসে ভোগ করেন। পৈতৃক সম্পত্তি ভোগ করা এই পরবর্তী প্রজন্ম, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় নিজেরা নতুন তেমন কিছু তৈরি করে যেতেও পারেন না। বাপের হোটেলে পায়ের ওপর পা তুলে বসে খেয়ে শুধু সম্পত্তি ধ্বংস করেন। বিলেতফেরত ওয়াহিদ মল্লিক তপন এই কাহিনির তেমন ধারার একজন ভোগবিলাসী সন্তান।

রাজ্জাক-শাবানা, অঞ্জনা-আলমগীর—এই দুটি জুটি এভাবে চলচ্চিত্রে সুন্দর পাখনা মেলে। যে সুধাকে নিয়ে মূল কাহিনির বিস্তার, তিনি যে শাবানা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

তপনদের পরিবারের সঙ্গে সুধাদের পরিবারের সুন্দর সম্পর্ক থাকলেও ১৮ বছরে বিরাট একটা সামাজিক ব্যবধান তৈরি হয়ে গেছে। তপন এবং তপনের বোন বহ্নি উচ্চবিত্ত, অভিজাত পরিবারের বা সমাজের সংস্কৃতিজাত সন্তান হলেও তপনের মা কিন্তু মধ্যবিত্ত সংস্কৃতিমনস্ক সুশিক্ষিত বাঙালি ঘরানার প্রতিনিধি। শিক্ষক কন্যা সুধাকে পুত্রবধূ করে ঘরে আনতে চান। সুধার বাবার মনে সংশয় জাগে, এই উচ্চবিত্ত পরিবারে গিয়ে কন্যা কি ঠাঁই পাবে? সামাজিক ব্যবধান ঘোচাতে পারবে?

সুধা জানায়, মা–বাবার ইচ্ছাই তার ইচ্ছা। বাবা তাই মনের তীব্র সংশয়ের মধ্যেও বিয়েতে রাজি হয়। মেয়েকে পরামর্শ দেয়, স্বামীর সংসারে মেয়েদের পূর্ণ বিকাশ ঘটে। ওই সংসারটাই মেয়েদের আসল সংসার। আমাদের দেশে একটা কথা প্রচলিত আছে, স্বামীর পায়ের তলায় স্ত্রীর বেহেশত। সামনে যত সমস্যাই আসুক, মেয়ে যেন এই বন্ধনের মর্যাদা রাখেন। সুধা বলে, আজীবন মা–বাবার কাছে যে শিক্ষা সে পেয়েছে, সেই শিক্ষার মান আপ্রাণ রাখার চেষ্টা করে যাবে।

তপন কিন্তু মায়ের ইচ্ছেমতো পাত্রী গছানো বিয়েতে রাজি নয়। কখনো যাকে চোখে দেখেনি, যার সঙ্গে মেলামেশা হয়নি, তেমন একজন অচেনা মানুষকে এখন কেউ মা–বাবার ইচ্ছায় এভাবে বিয়ে করে নেয় না। সে ভালোবাসে কেটী নামের এক অভিজাত শ্রেণির মেয়েকে। কেটী অভিজাত মানুষের ক্লাবে এসে সবার সঙ্গে মদ্যপান করতে পারে, তপনের সঙ্গে অনায়াসে শারীরিক সম্পর্কে মেতে উঠতে পারে। তার চলনবলন, কথা বলার ধরন তপনের সমগোত্রীয়।

সিদ্ধান্তে অটল মায়ের ইচ্ছায় তপনকে তবু সুধাকে বিয়ে করতে হয়। বাসররাতে সুধাকে ছেড়ে সে কেটীর কাছে চলে যায়। রোজ রাতে মদ্যপান করে এসে সুধাকে অপমান করে। কথায় কথায় সুধার প্রতি ঘৃণা, অবহেলা, তাচ্ছিল্যের মনোভাব বুঝিয়ে দেয়। স্বামীর সব অপমান, অবহেলা, অনাদর মুখ বুজে সহ্য করেও সুধা মস্ত জাহাজের মতো সংসারের হাল ধরে। শাশুড়ি, ননদ, কর্মচারী সবার মন জয় করে নেয়। অধিকাংশ পরিবারে শাশুড়ি বউমার ওপরে অত্যাচার করছে অভিযোগ ওঠে, এ ক্ষেত্রে দেখা যায় মনের মতো বউ পেয়ে শাশুড়ি শুধু সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব নয়, সব সম্পত্তির দায়িত্বও বউমার হাতে তুলে দিয়েছে।

এদিকে ননদ বহ্নি অন্য একটি বিপ্লব ঘটিয়ে বসে। দীর্ঘদিন যার সঙ্গে প্রেম করেছিল, সেই আসাদকে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করে ফেলে। মা, মেয়েকে তাড়িয়ে দিতে চাইলে সুধা এসে মায়ের কাছে বহ্নির হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে ননদের বিয়ের স্বীকৃতি দেয়। আসাদ ছেলেটিও ভালো। বহ্নির উপযুক্ত। রাজ্জাক-শাবানা, অঞ্জনা-আলমগীর—এই দুটি জুটি এভাবে চলচ্চিত্রে সুন্দর পাখনা মেলে। যে সুধাকে নিয়ে মূল কাহিনির বিস্তার, তিনি যে শাবানা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সমান্তরাল দুটি প্রেমকাহিনি, প্রেম এবং পরিবারের ভাঙন, জোড়া লাগা—এই দুই জুটিতে মিলে প্রাণবন্ত করে তুলেছে।

শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে বহ্নির বিপ্লবে কিন্তু ফাটল ধরে। শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে বনিবনা হয় না। আলাদা ঘরে ভাড়া থাকতে যায়। স্বামীকে ভুল বুঝে বহ্নি আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে যায়। এ ক্ষেত্রেও সুধা এসে সর্বক্ষণ বহ্নিকে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে। একদিকে উচ্চবিত্ত পরিবারের কন্যার মধ্যবিত্ত পরিবারে এসে নাজেহাল অবস্থা, টিকে থাকার লড়াই, অন্যদিকে মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উচ্চবিত্ত পরিবারে গিয়ে হাল ধরার লড়াই। পরিবার গঠনের মধ্য দিয়ে বৃহত্তর অর্থে সমাজ রাষ্ট্র বদলেরও ইঙ্গিত দিয়ে যায় পরিচালক।

হঠাৎ মায়ের মৃত্যু তপনের জীবনে একটা বড় ধাক্কা হয়ে আসে। তপনকে আমূল বদলে দেয়। অফিস, নাইট ক্লাব, কেটীর সংসর্গ সবকিছু থেকে দূরত্ব তৈরি করে সে ঘরবন্দী হয়। স্বামীর এমন পরিণতি ভালো লাগে না সুধার। স্বামীকে নিজের জগতে ফিরিয়ে দিতে বাড়ির মধ্যে পার্টির আয়োজন করে সে।

কেটী যে অর্থবিত্তের লোভে তপনের পাশে এসেছে, মিথ্যা ভালোবাসার ছলনা করেছে, তপন ঘুণাক্ষরেও তা কখনো বুঝতে পারেনি। ক্লাবের সুহৃদ বন্ধু তালুকদার গোপন চিঠি পাঠিয়ে তপনকে সব জানিয়ে দেয়। কেটী আসলে অন্যের বিবাহিত স্ত্রী। মিছে প্রেম এবং শরীরের ফাঁদে ফেলে ধনী পরিবারের সন্তানদের কাছ থেকে সব আত্মসাৎ করা, ব্ল্যাকমেল করা এই দম্পতির কাজ।

তপনের চোখ খুলে যায়। পার্টির মনোরম সন্ধ্যায় সুধা গান ধরে, ‘আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো গন্ধ বিলিয়ে যাই/ আমি মেঘে ঢাকা চাঁদের মতো জোছনা ঝরিয়ে যাই/ আমি গানে গানে প্রাণের যত/ বেদনা লুকাতে চাই...।’ সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠে মাসুদ করিমের লেখা আলম খানের সুর করা গানটি অসাধারণ। এই গীতিকার এবং সুরকার জুটির অন্য গানগুলোও বেশ ভালো লাগে। সাবিনা ছাড়াও গানে কণ্ঠ দিয়েছেন রুনা লায়লা, কাদেরী কিবরিয়া।

বাড়ির পার্টিতে কেটীর আসল রূপ তপন সবার সামনে উন্মোচিত করে দেয়। কেটীকে ধিক্কার জানিয়ে তাড়িয়ে দেয়। গৃহকর্ত্রী সুধার পাশে এসে দাঁড়ায়। ভালোবাসার কাছে আশ্রয় চায়। সুন্দর মধুরেণ সমাপয়েৎ। ‘রজনীগন্ধা’ সুন্দর একটি ভালো বাসা এবং ভালোবাসার ছায়াছবি।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত