শহীদ দিবস

গল্পটি ২০২৪ সালের জুনে প্রকাশিত বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের ‘তারুণ্য’ ম্যাগাজিনের দশম সংখ্যা থেকে নেওয়া।

অলংকরণ: অভিনয় আহমেদ

আজ ৮ ফাল্গুন; ২১ ফেব্রুয়ারি। মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

সকাল ৬টা ২০ মিনিটে ঘুম থেকে উঠল আসাদ সাহেব। মনে মনে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করল। আত্মার শান্তি কামনা করল। এরপর বাইরে যাওয়ার জন্য দ্রুত তৈরি হলো। সাততলা ভবনের সবচেয়ে ওপরের তলায় একটি রুমে সপরিবার থাকে সে। পেশায় গত বছর পর্যন্ত স্কুলশিক্ষক ছিল।

বাইরে বের হয়ে বেশ অবাক হলো সে। অন্য বছরের মতো এ বছর ২১ ফেব্রুয়ারি পালনের তেমন কোনো আয়োজন চোখে পড়ল না। আজ অনেক কুয়াশা পড়েছে। শরীরে বেশ শীত অনুভূত হচ্ছে। ঋতুরাজ বসন্তের আগমন ধরণিতে হলেও শীতের বিদায়ঘণ্টা এখনো বাজেনি। শীত অনুভূত হচ্ছে মধ্যমাঘের মতোই।

আসাদ সাহেব হাঁটার সময় লক্ষ করল অমর ভাষাসংগীত—‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি।...’ কোথাও সেভাবে বাজানো হচ্ছে না। মহল্লার মোড়ে মোড়ে মাইকের আওয়াজ কানে সুরের হিন্দোল তুলছে না। আসাদ সাহেব গুনগুন করে আপন মনে ভাষাসংগীত গাচ্ছে আর জোরে জোরে হাঁটছে। উদ্দেশ্য শহীদ মিনারে যাওয়া নয়।

বছরগুলোতে সে সাতসকালে উঠেই যেত শহীদ মিনারে। এ বছর যাচ্ছে নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। সরকারি বিদ্যালয়ের ঠিক দক্ষিণ গেটে তার একটা ছোট্ট মুদি ও কনফেকশনারির দোকান আছে। হন্যে হয়ে ছুটছে দোকান খোলার জন্য। শহীদ দিবসে স্কুলে শিক্ষার্থীদের আনাগোনা বেশি হতে পারে। তাই বেচাকেনাও বেশি হতে পারে।

বিদ্যালয়ের উত্তর গেট খোলা থাকায় সে স্কুলের ভেতর দিয়ে দক্ষিণ গেটে যাওয়ার জন্য স্কুল প্রাঙ্গণে প্রবেশ করল। এটি মহল্লার সবচেয়ে বড় ও স্বনামধন্য স্কুল। স্কুলে ঢুকতেই ডান দিকে শহীদ মিনার। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, শহীদ মিনার পরিষ্কার করা হয়েছে।

সারা বছর কেউ তো আর ইচ্ছা করে শহীদ মিনার পরিষ্কার করে না। এই একটা দিনই সবার কেমন জানি ভাষাপ্রীতি বেড়ে যায়।

কাঁটায় সকাল সাতটা বাজে। এখনো কেউ পুষ্পস্তবক অর্পণ করেনি শহীদবেদিতে। বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক-কর্মচারী ফুলের ডালা নিয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত। দুজন শিক্ষক একটা ব্যানার দুই পাশে ধরে রেখেছে। ‘শহীদ দিবস অমর হোক’ ব্যানারের লেখাটি আসাদ সাহেবের মনে ধরল। কিছু স্কাউট ও ক্যাডেট ছাড়া আর কোনো শিক্ষার্থীর উপস্থিতি নেই বললে চলে। মাইকে মৃদু সুরে বাজানো হচ্ছে—‘সালাম সালাম হাজার সালাম...’ গানটি।

সাহেব একপাশে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছিল দৃশ্যটি। এই ভেবে খুশি হলো যে করোনা মহামারির সময়ে স্কুলটি অন্তত তাদের সাধ্যমতো শহীদ দিবস পালন করছে। সবাই কী সুন্দর মাস্ক পরে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অংশগ্রহণ করেছে। আসাদ সাহেব মনে মনে বলল, ‘শহীদ দিবস অমর হোক।’

বছর এই দিনে সে নিজেই কত ব্যস্ত সময় পার করেছে। কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্কুলের জন্য ফুলের ডালা গোছানো, স্কুলের শিশুদের জন্য নাশতা আনা। তারপর শিশুদের সারবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে নগ্ন পায়ে শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাওয়া।

অনেক বড় আয়োজন ছিল। মাইকে স্কুলের নাম ঘোষণা করা হয়েছিল—‘এবার শহীদ মিনারে ফুল দিতে ধীরপায়ে এগিয়ে আসছে...ইন্টান্যাশনাল স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা।’ গর্বে বুক ভরে উঠত আসাদ স্যারের। তার নিজের হাতে গড়া এই স্কুল। তিল তিল করে গড়ে তোলা। একুশের মতোই এই স্কুল তার গর্ব, তার অহংকার।

এক বছরের ব্যবধানে সে স্কুলের পরিচালক থেকে দোকানদার বনে গেছে। আজ তার স্কুলের প্রাণ নেই, কেবল অস্তিত্বটুকু টিকে আছে। করোনা গ্রাস করেছে সন্তানতুল্য স্কুলটিকে। আসাদ সাহেবের মন হঠাৎ কালো মেঘে ঢেকে গেল। চোখের কোনায় বৃষ্টির ফোঁটার মতো অশ্রু জমল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বলল, ‘আমি সত্যিই আজ দোকানদার।’

দক্ষিণ গেট দিয়ে বের হয়ে দোকানে এল। দোকান খুলে ধোয়ামোছা করে বসল ক্লান্ত ভঙিতে। কোনো ক্রেতা নেই। একেবারে ক্রেতাশূন্য। এই ভয়াল দিনে কেই–বা বের হবে। বাসাতেই অনেকে নিরাপদে নেই। তাই বাইরের জনসমাগম এড়িয়ে চলছে সবাই। চেয়ার নিয়ে সে দোকানের বাইরে বসল, যাতে দু–একজন পথচারী অন্তত দেখা যায় সেই প্রত্যাশায়।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশা কেটে যাচ্ছে। মহল্লার কিছু বাসিন্দা তাদের শিশুদের নিয়ে বের হয়েছে। তাদের অনেকেই যাচ্ছে শহীদ মিনারে ফুল দিতে। শিশুদের হাতে দামি ফুলের তোড়া। দেশি গাঁদা ফুল আর দেখা যায় না। সবার হাতে দামি গোলাপ ও ডালিয়া। কেউ কেউ দোকানে এল। দেশি পণ্য কিনতে নয়, বিদেশি পণ্য খুঁজতে। একজন তার সন্তানকে সান্ত্বনা দিল এই বলে, ‘বাবা এগুলো পচা, কম দামি। এগুলো খেলে পেটে ব্যথা করবে। আমি বাইরে থেকে চকলেট এনে দেব, চলো।’

চলে গেল শিশুর হাত ধরে এটা–ওটা মিথ্যা বোঝাতে বোঝাতে। আসাদ সাহেব পণ্যটি ভালো করে নেড়েচেড়ে দেখল, সত্যিই পচা কি না বোঝার জন্য। পণ্যটির গায়ে লেখা—‘একটি বাংলাদেশি পণ্য।’ গর্ব হলো, অহংকার হলো পণ্যটি দেশি বলে। কিন্তু খুব খারাপ লাগল ভদ্রলোকের জন্য, যে দেশি পণ্য রেখে বিদেশি পণ্য খুঁজছিল। ‘আমরা আজও বিদেশি পণ্য খুঁজি। আসলেই কি স্বাধীন-স্বনির্ভর আমরা!’ মনে মনে নিজেকে জিজ্ঞেস করল আসাদ সাহেব।

স্কুলের ভেতর থেকে উনার একজন পরিচিত ছাত্র বের হলো। নাম ধরে ডাকল। মারুফ, এদিকে আস।

বড় ভালো ছেলে মারুফ। চেহারাটা বেশ মিষ্টি। একটা মায়া লেগে থাকে সব সময়। মারুফ প্লে ও নার্সারি দুই বছর পড়েছিল আসাদ সাহেবের স্কুলে। এখন হয়তো তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। মারুফ সালাম দিল স্যারকে। জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন আছেন স্যার?’ সালামের উত্তর দিয়ে আসাদ সাহেব মারুফের একটি হাত ধরে বলল,

- কোথায় গিয়েছিলি?

- স্কুলে গিয়েছিলাম স্যার।

- ফুল দিছিস শহীদ মিনারে?

- না স্যার, দিইনি।

- কেন?

- ফুল বড়লোকেরা দেয় স্যার। ফুলের অনেক দাম। আমরা তো গরিব; ফুল কেনার এত টাকা পাব কই?

আসাদ সাহেব ভাবলেন কথাগুলো সত্য। ফুলের অনেক দাম। বিশেষ করে কোনো উপলক্ষ এলে তো কথা নেই; ১০ টাকার ফুল ১০০ টাকা হয়। আসাদ সাহেব মারুফের হাত দুটো শক্ত করে ধরে বলল, ‘তোর কি ফুল দিতে ইচ্ছে হয়?’ ‘হয় স্যার, খুব ইচ্ছে হয়। আমি টাকা গোচ্ছাছি। আব্বার কাছ থেকে প্রতিদিন ১০ টাকা করে নিয়ে জমাই। জমাতে জমাতে একদিন আমার অনেক টাকা হবে। অনেক বড়লোক হব। তখন আমিও ফুল দিতে পারব।’

কী কঠিন কথা কত সহজ করে বলে গেল সে। আসাদ সাহেব চুপচাপ ওর হাত দুটো ধরে রাখল। কিছুক্ষণ পর হাত দুটো আস্তে করে ছেড়ে দিল। মারুফ চলে গেল। সে চেয়ে রইল ওর যাওয়ার পথের দিকে।

চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু বিসর্জিত হলো। সিক্ত হলো মৃত্তিকা। দেশমাতৃকাকে এ ছাড়া যে আর কিছুই দেওয়ার নেই তার। মনে মনে বলল, ‘হে শহীদ, এই অশ্রুটুকু শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করো।’

সহকারী শিক্ষক, পাতড়াখোলা আরশাদ আলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, শ্যামনগর, সাতক্ষীরা