গত বছরের কথা। ঢাকার মোহাম্মদপুরে এক রুমের একটি বাসায় একা থাকতাম। অবশ্য কয়েক বছর ধরেই একা বাস করে আসছি। একা থাকাতেই সুখ খুঁজে নিয়েছি। অফিস শেষে রাতে বাসায় ফিরে রান্না করা, বই পড়া, মুভি দেখা—দিনগুলো বেশ চলে যাচ্ছিল। সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও এভাবেই নিজেকে সময় দিতাম। সারা দিন বাসায় থেকে নিজের সঙ্গ নিজে উপভোগ করতাম।
জুন ২০২৪-এর কথা, একটা মৃত্যু আমাকে বেশ ধাক্কা দিয়ে গেল। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সিনিয়র অসুস্থ হয়ে মারা যান। বয়স আমার কাছাকাছি। মৃত্যুর সংবাদটা কেন যেন ঠিক মেনে নিতে পারছিলাম না। সব সময় হাসিখুশি থাকা একটা মানুষ হঠাৎ করে নাই হয়ে গেল, তাঁর সঙ্গে আর কখনোই দেখা হবে না—আমার মধ্যে জীবন নিয়ে বড় একটা চিন্তার রেখা ফেলে দিয়ে যায়।
পরবর্তী কয়েক মাস রাতে ঘুম হতো না। রুমের আলো নিভিয়ে চোখ বন্ধ করলেই মৃত্যুর ভয় চেপে ধরত। মনে হতো, এই বুঝি আজরাইল মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে হাজির হলো! ফজরের আজানের পর সেই ভয়টা আর থাকত না। তখন চোখে ঘুম আসত। দিনের বেলাও এই ভয় থাকত না। এভাবেই সময় চলে যাচ্ছিল। এই অস্থিরতা কাছের দুজন মানুষ ছাড়া আর কারও কাছে শেয়ার করিনি।
দ্রুতই কেটি আমার জীবনের সঙ্গে পুরোপুরি জড়িয়ে যায়। আমার কথা বলার সঙ্গী সে, আর তার খেলার সঙ্গী আমি।
নভেম্বরের দুই তারিখ আমার জীবনে একটি ছোট্ট বিড়াল আসে, এক মাস দশ দিন বয়সী। নাম রাখি কেটি। বিড়াল আমার সবচেয়ে পছন্দের পোষা প্রাণী। পোষার ইচ্ছে দীর্ঘদিনের। কিন্তু ঢাকায় একা বাস করার কারণে সাহস পেতাম না। প্রতিদিন অন্তত ৯-১০ ঘণ্টা বাসার বাইরে থাকতে হয়, এই সময়ে বিড়ালকে একা একটি রুমে কীভাবে রাখব! কষ্ট পাবে, এই ভেবে আর বিড়াল পালা হয়নি।
এবার সাহস করে বিড়াল অ্যাডপ্ট করলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম আমার একা জীবনের সঙ্গে কেটিকেও অভ্যস্ত করে ফেলব। জানি না সে অভ্যস্ত হয়েছে কি না, তবে আমার জীবনের একাকিত্ব দূর হয়ে গেল। প্রতিদিন অফিসে গেলে চিন্তা থাকত, কখন বাসায় ফিরব— কেউ আমার জন্য বাসায় অপেক্ষা করছে। অফিস শেষে বাইরে আড্ডা দেওয়া বন্ধ করে দিলাম। সরাসরি বাসায় চলে যেতাম। গিয়ে দরজা খুলে দেখতাম, কেটি দরজার পাশে বসে আছে। ভেতরে প্রবেশ করলে সে আমার পা জড়িয়ে ধরে রাখে, আর অসংখ্য অভিযোগ জানায়। বিড়ালের ভাষা বোঝার তো সক্ষমতা নেই, তবে এতটুকু বুঝতাম— সারা দিন কেন তাকে একা রেখে গেছি, একা একা একটি রুমে এত দীর্ঘক্ষণ থাকা যায় নাকি! এসব বলত। আমিও কেটিকে বোঝাতাম, ‘অফিসে যেতে হয়। এ ছাড়া উপায় নেই।’
এরপর কেটির জন্য খাবার রেডি করে খেতে দেওয়া; ওর খাওয়া শেষ হলে নিজের জন্য রান্না করতাম। রান্নার পুরো সময়টা সে আমার কাঁধে বসে থাকত। আমি খাওয়ার সময়ও সে আমার খাবারে ভাগ বসাত। রাতে সে আমার বুকের ওপর শুয়ে ঘুমাত। কেটিকে সময় দিতে গিয়ে নিয়মিত মুভি দেখার অভ্যাসটাও বাদ দিতে হলো। ঘুম চলে আসত রাত দুইটার আগেই।
দ্রুতই কেটি আমার জীবনের সঙ্গে পুরোপুরি জড়িয়ে যায়। আমার কথা বলার সঙ্গী সে, আর তার খেলার সঙ্গী আমি। মৃত্যুর ভয় দূর হয়ে যায়। আজেবাজে চিন্তাও আর মাথায় আসত না।
এখন আর একা থাকি না। বড় বাসায় পুরো পরিবারসহ থাকি। কেটির খেলার সঙ্গী বেড়েছে। আম্মা ও বোনেরা তাকে আদর করে। ভাগনিরা বেড়াতে এলে তাদের কাছে থাকে। এত আদর-যত্নের মধ্যেও কেটি এখনো রাতে আমার বাসায় ফেরার অপেক্ষায় থাকে। কলবেল শুনলে দৌড়ে দরজার কাছে এসে বসে থাকে। ভেতরে প্রবেশ করলে আমার সঙ্গে আমার রুমে গিয়ে বসে থাকে। এখন আমার প্রতি ওর আর অভিযোগ নেই। আছে কেবল ভালোবাসার বন্ধন।