দিন শেষে প্রতিটি মানুষ একা। চৈত্রের মধ্য দুপুরের মতো, কনকনে শীতের রাতের মতো একা। মানুষে মানুষে যতটুকু সম্পর্ক, বন্ধুত্ব, মায়া, ভালোবাসা—সবটাই ক্ষণিকের। বেলা শেষে মানুষ মূলত একা। যতই আমরা অন্যদের সঙ্গে সময় কাটাই, সম্পর্কের সেতু গড়ি, একে অপরকে পাশে পাই, সেগুলো একটা সময় মলিন হয়ে যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয় দূরত্ব, এক এক করে ভেঙে পড়ে সম্পর্কের সেতু; অনন্তকালের জন্য বিচ্ছিন্ন হয় যোগাযোগ।
দিনের আলো ফুরিয়ে গেলে রাত আসে, ক্লান্ত পাখির দল নীড়ে ফেরে, পাতাঝরা শীতের শেষে আসে সজীব বসন্ত, এভাবেই সময়ের চাকায় যাওয়া-আসা করে ঋতুময় বছর। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া মানুষ—যার গহনে লুকিয়ে থাকত সুখ পাখি, যার ডাকে মন-দরিয়া খুশির ঢেউয়ে উচ্ছল হয়ে উঠত, যার সঙ্গতায় দূর হয়ে যেত মনের যত বিরাগ, যার সঙ্গে ভাগ করা যেত দারুণ সুন্দর মুহূর্ত, যে ভুলিয়ে দিত সজল ভৈরবী—সেই মানুষটি আর কখনোই ফিরে আসে না।
একাকিত্ব আমাদের জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা যতই সম্পর্ক গড়ি, ভালোবাসায় শক্ত করে বাঁধি, একদিন সেই সম্পর্কগুলো ঠিক ভেঙে পড়ে।
যে মানুষটা অহর্নিশ সঙ্গ দেওয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে থাকে, আপনার সামান্য হাঁচি-কাশিতে যার রাতের ঘুম চলে যায়, যার মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে আপনার চিন্তায়, একটিবার আপনার কণ্ঠস্বর শোনার জন্য যার ভেতরটা আঁকুপাঁকু করে, যে বলে আপনাকে ছাড়া এক মুহূর্তও বেঁচে থাকা যায় না—হঠাৎই বদলে যায় সেই মানুষটি। মায়ার টান, আবেগের উত্তাপ, অনুরাগের অনুভূতি কর্পূরের মতো বাতাসে ওড়িয়ে দিয়ে সুখ খুঁজে নেয় বিপরীত ব্যক্তিতে। চেনামুখ, মিষ্টি হাসি, পরিচিত কণ্ঠস্বর, এমনকি গায়ের গন্ধটুকুও তখন অচেনা হয়ে যায়।
এভাবেই ঘটে যায় সঙ্গতার পালাবদল। আমরা নিঃসঙ্গ হতে থাকি মনের অগোচরে। একসময় যাপনের কোলাহল থেমে যায়, উড়ে যায় মুখের হাসি, কথারা হারিয়ে ফেলে খেই; সবকিছুই কেমন নিস্তব্ধ-নির্জীব হয়ে আসে। আমরা হয়ে পড়ি ভীষণ একা।
একই শহরে বাস করে মানুষগুলো; হয়তো পাশের গলিতেই, কিন্তু দেখা হয় না। কফিশপ, ফুলের দোকান, রমনা পার্ক, শাহাবাগ মোড়, বাসস্টপ কোথাও দেখা হয় না। প্রিয় জোছনায় ভেসে যায় সবকিছু, বারান্দায় মুক্তোদানার মতো আছড়ে পড়ে বৃষ্টি কণা; কিন্তু হারিয়ে যাওয়া মানুষ ফিরে আসে না। দিন গড়ায়, মাস গড়ায়, এরপর বছর— শরীরজুড়ে ব্যামোদের মেলা বসে, জ্বরে কপাল পুড়ে যায়, রোগ-শোকে ক্লান্ত হয়ে একাকি বিছানায় ছটফট করেন, তবু সে মানুষটি আর ফিরে আসে না। জীবনের কত চড়াই-উতরাই, ভাঙাগড়া, নৌকাডুবি হয়, এত কিছুর পরেও হারিয়ে যাওয়া মানুষ পেছনে ফিরে দেখে না।
একটা সময় আজীবন আগলে রাখতে চাওয়া মানুষটি এভাবেই আপনাকে একাকী কষ্টের তুষার পাহাড়ে ফেলে নিরুদ্দেশ হয়। এটা নির্মম তবে চিরন্তন সত্য। দিন শেষে আমাদের একমাত্র সঙ্গী আমরা নিজেই। এ ছাড়া আমাদের নিজের বলতে কিছুই নেই, কিছুই থাকে না।
যতই আমরা ব্যস্ত থাকি—কলিগ, সহপাঠী, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠি। যতই মানুষের ভিড়ে নিজেদের জায়গা তৈরি করি, ভার্চ্যুয়াল জগতের সবুজ আলোয় সুখ খুঁজি, দিনশেষে একটি জায়গায় এসে একা হয়ে যেতে হয়। আমরা একা একাই জীবনের পথে হাঁটি, একাই ভাবি, একাই মনের দুঃখ-কষ্টকে অনুভব করি। হৃদয়ের ব্যথায় নিঃসঙ্গ বিছানায় এপাশ-ওপাশ করি, বারান্দায় ফুরিয়ে যায় নির্ঘুম রাত। কত না বলা কথা গলা অব্দি এসে ধোঁয়া হয়ে উড়ে যায় আকাশে, কত অশ্রু গিলে খায় মাথার তলার বালিশ, এসব খবর কেউ রাখে না, কেউ জানে না। মানুষ যতই মিশে যাক সবার সঙ্গে, নিজেকে মেলে ধরুক, আঁকড়ে রাখুক, জড়িয়ে থাকুক—একসময় তাকে একা হয়ে যেতেই হয়।
মানুষের জীবন মূলত ট্রেন স্টেশনের মতো। এখানে রোজ ট্রেন থামে, নানা মানুষের হইচই আর পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে হৃদয় প্রাঙ্গণ। কেউ শুরুতেই চলে যায়, কেউ ক্লান্তি নিয়ে বসে হৃদয়ের বৈঠকখানায়। গল্প হয়, মায়া জন্মায় এরপর অচেনা পথের বাঁকে উধাও হয়।
একাকিত্ব আমাদের জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা যতই সম্পর্ক গড়ি, ভালোবাসায় শক্ত করে বাঁধি, একদিন সেই সম্পর্কগুলো ঠিক ভেঙে পড়ে। মানুষ একা পৃথিবীতে আসে এবং একাই তাকে চলে যেতে হয়। মাঝখানে সম্পর্কগুলো তাকে একে অপরের সঙ্গে বাঁধে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত শোক, দুঃখ, বেদনা—এইসব কিছু একাই বয়ে বেড়ায় জীবনভর!
বনশ্রী, ঢাকা