মুখের ওপর মুখের ছাপচিত্র

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সেলিম মামার দোকানে বসে দুই গ্লাস পানি পান করলাম। শুকনা গলায় পানি পড়তেই বেশ ভালো লাগছে। মনের অবস্থা ভালো নেই। চোখের কোণে নোনাজলের তুমুল উৎপাত। যেন চোখ থেকে গড়িয়ে পড়তে পারলেই বাঁচে।
‘কিছু অইছে, মামা? কিমুন যেন ফ্যাকাইশ্যা লাগতাছে আপনেরে!’—সেলিম মামার গলা শুনে স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগে আমার। আশপাশে তাকাই। না, কেউ নেই। এ গল্প ক্যাম্পাসে ভাইরাল হওয়ার সুযোগ কম। ঈদের ছুটিতে সবাই বাড়ি চলে গেছে। হল বন্ধ হয়েছে আরও তিন দিন আগে। এখন হলে আছি আমি আর সেলিম মামা।

সেলিম মামা ঢাকাতে ঈদ করেন। ঢাকাইয়া এক মেয়েকে পটিয়ে ঘরজামাই হয়েছেন। সেই দুর্ধর্ষ প্রেমের গল্প খুব ক্ষীণগলায় একদিন আমাকে বলেছিলেন। মামার শ্বশুর অবস্থাশালী লোক। নিউমার্কেটে কাপড়ের দোকান। সেই দোকানে মামা কাজ করতেন। সে সূত্রে মামিদের বাসায় মামার প্রতিদিন আসা–যাওয়া। গুল্লু মার্কা চেহারা ছিল মামার। দুধে আলতা রঙের না হলেও বেশ ভালো লাগত দেখতে। তাগড়া যুবক। কী যে মায়ার চেহারা ছিল তাঁর। মামি তখন ক্লাস নাইনের শিক্ষার্থী। সেলিম মামার প্রেমের গল্প আমার মুখস্থ।

‘মামা, আজ টিউশনির টাকাটা পেয়েছিলাম। কিন্তু পকেটমার আমার পকেট কাইট্টা নিয়া গেছে। কন, এখন বাড়িত যামু কেমনে? ঈদে বাড়ি গেলে ছোট বোনটা আমার হাতের দিকে তাকাইয়া থাকে। চাইছিলাম বাজানের লাইগ্যা একখান পাঞ্জাবি কিনমু। মায়ের লাইগ্যা একখান টাঙ্গাইল্লা শাড়ি কিনমু। কিন্তু কিছুই হইল না। দেন, এক কাপ চা দেন। মাথাডা খুব ধরছে।’
মাটির দিকে তাকিয়ে চা খাচ্ছি। আনমনে অঙ্ক কষছি মাটিতে। নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেদের বাড়িতে লেখার কাগজ না থাকলেও মাটির বুক খোলা থাকে সব সময়। সেখানে ইচ্ছেমতো লেখা যায়। বাঘবন্দী খেলা যায়। পাঁচ ঘুঁটি খেলা যায়। চোখের জল ফেলা যায়। অনেকক্ষণ আমি আনমনে আমাদের জলেশ্বরী গ্রাম ঘুরে ঘুরে দেখছি। সাপের মতো আঁকাবাঁকা মেঠো পথ। সারি সারি তালগাছ। উত্তরের হাওয়ায় দোল খাওয়া বাবুই পাখির বাসা। হলুদ সন্ধ্যা গুলিয়ে যায় নদীর টলটলে জল। চোখের সামনে এক পা, দুই পা করে হাঁটছে ঘুঘু দম্পতি। কাসেম চাচার টংদোকানে বসেছে বৈশ্বিক সংলাপ। বিবিসি বাংলা পরিক্রমা। ওই তো পথের ওপর ছোট বোন পরী দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় ঘোমটা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে অপেক্ষা করছে আমার মা। বাবা আজ মাঠের কাজ আগেভাগে সেরে বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করছে।

আচমকা আমার কাঁধের ওপর একটা হাত। ঘুরে দেখি সেলিম মামা।
—মামা, উঠেন তো। বাইত যান। কাল বাদে ঈদ। বাড়ির মানুষ আপনের লাইগ্যা অপেক্ষা করতাছে।
—না, মামা। বাইত আর যামু না। আপনের দোকান বাকিও পরের মাসের টাকা পাইলে দিতে অইব। কিচ্ছু মনে কইরেন না।
—দূর, মামা। বাকির ট্যাকা লইয়া আপনের চিন্তা করোন লাগত না। এহন না পারলে পরে দিবেন। তা–ও না পারলে চাকরি পাইলে দিবেন। সমস্যা নাই। যান, বাড়িত যান। ঈদের খুশি বেকতের লগে ভাগাভাগি কইরেন।
আসার সময় সেলিম মামা আমার হাতের মুঠোয় ৫০০ টাকার তিনটা নোট গুঁজে দিলেন। টাকাগুলো দেখেই ছলকে উঠল আমার দুই চোখ। নিম্নমধ্যবিত্ত ছেলের চোখের জলও মাটি দ্রুত শুষে নেয়। আড়াল করে রাখে আমাদের নিরেট বেদনার দাগ। সেলিম মামাকে জড়িয়ে ধরি।
—এখন বাড়িত যান তো, মামা। ওহ, যাওনের সময় ছুডু বইনের লাইগ্যা একখান লাল টুকটুকে জামা লইয়া যাইয়েন। এই লন ৫০০ ট্যাকা।

বাস হাওয়ার বেগে ছুটছে। চলন্ত বাসে বসে আমি আনমনে দেখতে পাচ্ছি সেলিম মামার মুখ। কী নিখুঁত ও সুস্পষ্ট তাঁর মুখের ছবি! আমি এখন আমার গ্রাম দেখছি না। মা–বোনের ছবি মনে করতে পারছি না। বারবার শুধু সেলিম মামার মুখটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি। দেখতে দেখতে ক্রমেই আমার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে...।