নিখাদ অনুরক্তি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
একমাত্র মা-বাবা তাঁর সন্তানকে জিতিয়ে দেওয়ার জন্য এমন মরিয়া হয়ে উঠতে পারেন, সমুদ্রের অতল গহ্বর থেকে ছিনিয়ে আনতে পারেন প্রাণভোমরা।

মা–বাবা কখনো ছায়াদার বটবৃক্ষ, কখনো আঘাতের বিপরীতে ঢাল। নিকষ আঁধারে আলোর মশাল তাঁরা, বিষাদে স্বস্তির নিশ্বাস, বিপদে পরম আশ্রয়, আবার কখনোবা শত্রুর বিপক্ষে মহাপ্রলয়। বাবা-মায়ের হাতে অদ্ভুত এক ক্ষমতা রয়েছে। কথাটিকে অদ্ভুত না বলে অলৌকিক বলাটা বোধহয় যথাযথ। এই অলৌকিক ক্ষমতাবলে সন্তানের জন্য প্রায় সবকিছুই জয় করে ফেলতে পারেন; যমদূতের দ্বার থেকে ছিনিয়ে আনতে পারেন প্রাণ। যখন পুরো পৃথিবী মুখ ফিরিয়ে নেয়, দুধের মাছি ধরনের মানুষগুলো গা-ঢাকা দেয়; তখনো মা-বাবা ছায়া হয়ে মায়ায় জড়িয়ে রাখেন, আত্মবিশ্বাস জাগান, বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখান। এসব মানুষের সমতুল্য তো দূরের কথা, কার্বনকপিও ভুবনজুড়ে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

আমাদের ঠিক পাশের বাসায় মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোক থাকেন। অফিস ফেরার পথে, বাসার সামনের রাস্তায় প্রায়ই তাঁদের সঙ্গে দেখা হয়। আসলে তাঁরা রোজ সন্ধ্যায় তাঁদের ২০-২২ বছরের ছেলেকে হাঁটতে শেখাতে বের হন। পাখি যেমন ছানাদের একটু একটু করে উড়তে শেখায়, মা-বাবা যেমন ছোট্ট শিশুকে এক-পা, দু-পা করে হাঁটতে শেখান; ঠিক সেই আঙ্গিকে তাঁরা ছেলেকে হাঁটার কৌশল শেখান। শুনে খুব অবাক লাগছে? ভাবছেন, এত বড় ছেলেকে আবার হাঁটার কৌশল শেখানোর কী আছে! প্রথম যেদিন তাঁদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, আমিও বেশ অবাক হয়ে খানিকটা সময় তাকিয়ে ছিলাম। আন্দাজ করার চেষ্টা করছিলাম, দৃশ্যের পেছনের ঘটনা ঠিক কী হতে পারে!

সেদিন আমার আন্দাজের তির খুব গভীরে প্রবেশ করতে না পারলেও এটা ঠিক বুঝতে পারছিলাম যে মানুষ দুজন ছেলেটিকে হাঁটতে শেখাচ্ছেন, তাঁরা মা-বাবা ছাড়া আর কেউ হতেই পারেন না। তাঁদের চোখেমুখে ইচ্ছাশক্তির যে আগ্নেয়গিরি দেখেছি, তা অকস্মাৎ নিভে যাওয়ার মতো নয়; বরং জয় করার নেশায় টগবগ করে ফুটছে। একমাত্র মা-বাবা তাঁর সন্তানকে জিতিয়ে দেওয়ার জন্য এমন মরিয়া হয়ে উঠতে পারেন, সমুদ্রের অতল গহ্বর থেকে ছিনিয়ে আনতে পারেন প্রাণভোমরা।

যেহেতু প্রায়ই তাঁদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, সেই সুবাদে পেছনের গল্প জানার প্রবল আগ্রহ জন্মে। কিন্তু কোনোভাবেই জানার সুযোগ হচ্ছিল না; অন্ততপক্ষে তাঁদের থেকে তো নয়ই। রাস্তা দিয়ে চলার সময় তাঁরা এতটাই হন্তদন্ত থাকেন যে পাশ ফিরে তাকানোর ফুরসত হয় না। এমতাবস্থায় প্রশ্ন করা সমীচীন মনে হয়নি। ভেতরে জানার আগ্রহটা সুপ্তই থেকে গেল; তাঁদের সঙ্গে দেখা হলেই তা নড়েচড়ে ওঠে। বিপরীত পন্থা খুঁজতে শুরু করলাম এবং একটি মাধ্যম পেয়েও গেলাম। সেখানে কথা বলে জানতে পারলাম, ছেলেটি প্রায় দুই বছর আগে পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদ্‌যাপনের জন্য গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে বাইক দুর্ঘটনায় এই করুণ অবস্থায় পতিত হন এবং চলাফেরার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। জানলাম, আমার আন্দাজ ঠিকই আছে; রোজ সন্ধ্যায় যে ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা ছেলেটিকে নিয়ে হাঁটতে বের হন, তাঁরা ছেলেটির মা-বাবা। অবশ্য এখানে আন্দাজের কোনো কৃতিত্ব নেই; পৃথিবীতে এমন কিছু স্বচ্ছ জিনিস আছে, যাতে চোখ পড়লেই ভেতর-বাইরের বার্তা পাওয়া যায়।

জানতে পারলাম, ছেলেটির অবস্থা আরও করুণ ছিল। দিন দিন বাবা-মার অক্লান্ত পরিশ্রম, ভালোবাসা আর সৃষ্টিকর্তার রহমতে সে এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে। ছেলেটিকে স্বাভাবিক করে তুলতে কত সাধ-আহ্লাদ বিসর্জন দিতে হচ্ছে, কত রাত না ঘুমিয়ে কাটাতে হচ্ছে, কত হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হচ্ছে—তার হিসাবে মনে হয় না ফুরোনো রাতের মতোই দীর্ঘ। আমি তো কেবল কয়েকটি সন্ধ্যার সাক্ষী হয়েছি মাত্র। এ রকম অনেক সন্ধ্যা-বিকেল, ভোর–রাত আছে, যার সাক্ষী তাঁরা ছাড়া আর কেউ নেই। এসব হিসাব কষায় তাঁদের কোনো আকুলতাও নেই। ছেলেটিকে স্বাভাবিক দেখার অপেক্ষায় দিন গুনে যাচ্ছেন; দিন গুনে যাচ্ছেন দীর্ঘ তিমির রাত শেষে একটি আলোরাঙা নতুন ভোরের অপেক্ষায়।

মা-বাবা সন্তানদের সক্ষম-অক্ষম, ভালো-মন্দ, ফর্সা-কালোতে মাপেন না। তাঁদের কাছে সন্তানের পরিচয় কেবলই সন্তান, সাত রাজার ধন।

আরেকটি বিষয় খেয়াল করেছি, ভদ্রলোক আর তাঁর ছেলে সমানতালে হেঁটে গেলেও ভদ্রমহিলা তালে ঠিক পেরে ওঠেন না; হাঁপাতে হাঁপাতে খানিকটা পেছনে থেকে হাঁটেন। ভদ্রলোক পেছন ফিরে তাঁকে বাসায় ফিরতে বললেও তিনি ফেরেন না, ওভাবেই হাঁটতে থাকেন। এই হচ্ছেন মা! ফুটফুটে কলিজার টুকরা নাড়িছেঁড়া ধন রেখে বাসায় ফিরতে চান না। অথচ এসব মানুষকে যদি নিজেদের অসুস্থতা কাটিয়ে ওঠার জন্য এভাবে কষ্ট করতে বলা হতো, তাঁরা কখনোই এমন একাগ্রতার সঙ্গে তা করতেন না, যেমনটা ছেলের জন্য করছেন।

মানুষ দুজন শিশু অবস্থায় ছেলেটিকে যে আগ্রহ, ধৈর্য, মায়া আর ভালোবাসায় বড় করে তুলেছেন; এতটুকু আঁচ লাগতে দেননি, এ বয়সেও ঠিক সেভাবেই আগলে রাখছেন। মা-বাবার কাছে সন্তানেরা বড় হয় না। মা-বাবা সন্তানদের সক্ষম-অক্ষম, ভালো-মন্দ, ফর্সা-কালোতে মাপেন না। তাঁদের কাছে সন্তানের পরিচয় কেবলই সন্তান, সাত রাজার ধন। অথচ আমরা সন্তানেরা একটা সময় গিয়ে সব বেমালুম ভুলে যাই!

যাঁরা আমাদের এতগুলো বছর সব আঘাত থেকে আড়াল করে বুকে আগলে রাখেন, তাঁদের বুকেই আঘাত করে দূরে সরে যাই। মা-বাবা সন্তানদের যে অকৃত্রিম ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখে, তার এক ভাগ যদি সন্তানেরা বাসে, তাহলে পৃথিবীতে বৃদ্ধাশ্রম বলে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। টিভি পর্দায় কিংবা নিউজের পাতায় মা-বাবা সন্তানের দ্বারা নিপীড়নের শিকার—এমন নিউজও চোখে পড়বে না। মা-বাবা যে আঙ্গিকে সন্তানকে ভালোবাসেন, সেই ভালোবাসার বিশুদ্ধ বাতাসে পৃথিবীর প্রতিটি সন্তান মহামারির মতো আক্রান্ত হোক। পৃথিবী ছেয়ে যাক ভালোবাসা আর শান্তির দূর্বাঘাসে।

বনশ্রী, ঢাকা