বাবা ঘাটে দাঁড়িয়ে রইলেন

বাবা ঘাটে দাঁড়িয়ে রইলেনছবি: সংগৃহীত

খুব জেদ করেই ডায়েরি আর কলমটা নিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে বসলাম। ভোর হয়ে আসছে, পাখিরা ডাকছে। আষাঢ়ের আকাশজুড়ে কালো মেঘেরা ভাসছে আপন খেয়ালে। এই বুঝি ঝুম বৃষ্টি নামবে। আহ্ কী সুন্দর দৃশ্য! কী অপরূপ লাগছে দেখতে!

হঠাৎ মনে পড়ল সেদিনের কথা। এ রকম একটা ভোররাতে আম্মুর ডাক, ‘লিজা, লিজা, ওঠো মা, দেরি হয়ে যাচ্ছে।’ খুব আগ্রহের সঙ্গে উঠে আম্মুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সকাল হয়েছে?’ তিনি বললেন, ‘বাইরে গিয়ে দেখো তো, অন্ধকার দেখতে পাও কি না?’ তাড়াহুড়া করে বাইরে এসে দেখি, অন্ধকার দেখা যাচ্ছে না। তার মানে সকাল হয়েছে।

আমি আর দেরি না করে হাতমুখ ধুয়ে অজু করে নামাজ পড়লাম। নামাজ শেষে দাদির কাছে গেলাম, সকালের বাতাস শরীরে লাগানোর জন্য। দাদি প্রতিদিন সকালে নামাজ শেষে বাড়ির সামনে একটু হাঁটাচলা করেন। এতে নাকি শরীর সুস্থ থাকে।

দাদি আর আমি হাঁটছি, গল্প করছি। বাবার ছোটবেলার গল্প। দাদি বললেন, ‘জানিস লিজা, তোর বাবা যখন ছোট ছিল, তখন সেও আমার সঙ্গে এ রকম হাঁটত।’
কিছুক্ষণ পরই বাবার ডাক, ‘মনা...লিজা মনা…’।
‘জি বাবা আসছি’।
ঘরে গিয়ে দেখি, বাবা বসে টিভি দেখছেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘এই যে মা, তোমার প্রিয় টিভি, তুমি না থাকলে কে দেখবে টিভি?’ বাবার কণ্ঠ ভারী লাগছিল। আমি অবশ্য সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে টিভির পর্দায় চোখ রাখলাম।

বাবা তো সত্যি কথাই বলেছেন। আমি না থাকলে কে দেখবে টিভি? কার সঙ্গে বসে বাবা টিভি দেখবেন আর কফি খাবেন, কার সঙ্গেই বা খেলা নিয়ে ঝগড়া করবেন!
নানা রকম চিন্তায় যখন আমার মুখে অমাবস্যার ছাপ, বাবা তখনই হাত টেনে পাশে বসিয়ে বললেন, ‘পাগলি মেয়ে, তুমি কি একেবারের জন্য যাচ্ছ? কদিন পরই তো চলে আসবে। ভালোভাবে পরীক্ষা দাও। পরীক্ষার পরদিনই তোমাকে নিয়ে আসব। তারপর বাপ–মেয়ে একসঙ্গে কফি খেতে খেতে মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখব!’

বাবার কথা শেষ হতে না হতেই আম্মু এসে বললেন, ‘বাবা-মেয়ের কথা শেষ হয়ে থাকলে চলো গিয়ে খেয়ে নাও, দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
বাবা আর আমি খেতে বসলাম। আমার খেতে ইচ্ছা করছে না। স্বভাবতই এত সকালে খেতে ভালো লাগে না। বাবা আমার খাবারের অরুচি দেখে আম্মুকে বললেন, ‘মেয়ে খেতে পারছে না, খাইয়ে দাও।’
আম্মু পেয়ে গেলেন সুযোগ। মনে হচ্ছিল, যদি পারতেন পুরো গামলাভর্তি ভাত একসঙ্গে খাইয়ে দিতেন।

সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। আমি তৈরি হচ্ছি। দরজার দিকে চোখ পড়তেই দেখি দাদি দাঁড়িয়ে আছেন। ‘কিছু বলবে দাদি?’
‘না, কিছু বলব না। তুই রেডি হ আর শোন, মাটির দিকে নজর করে পড়বি কেমন!’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, মাটির দিকেই তাকাব, বইয়ের দিকে তাকাব না!’ দাদি হাসছেন, আমিও হাসছি, পাশের ঘর থেকে বাবা আর আম্মুও হাসছেন।

আমার যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। বাবা বললেন, ‘তোমার দাদা আর কাকাকে সালাম করে এসো।’ তাদের সালাম করে দরজার সামনে আসতেই দেখি, ব্যাগ হাতে আম্মু দাঁড়িয়ে। চোখে টলমল করছে পানি। বাবা লাগেজ নিয়ে রিকশা খোঁজায় ব্যস্ত।

আম্মুর চোখে পানি দেখে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলাম না। আমাদের কান্নায় আশপাশের অনেক লোক জড়ো হয়ে যায়। কেউ কেউ আবার বললেন, ‘মেয়েকে বাইরে পাঠিয়ে পড়ানোর কী দরকার?’ বাবা সেসব তোয়াক্কা করেন না। আম্মু আর দাদিকে বিদায় জানিয়ে আমাকে নিয়ে রিকশায় উঠলেন।

রিকশা আমার ভীষণ প্রিয়। তাই দেরি হবে জেনেও বাবা ইচ্ছা করেই রিকশা নিয়েছেন। গন্তব্য ফুলছড়ি লঞ্চঘাট। খেয়াল করলাম, বাবার দিকে তাকাতেই মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন। টিস্যু দিয়ে চোখ মুছে তারপর আমার দিকে তাকাচ্ছেন। ওনার চোখ লাল হয়ে আছে। কান্না করছেন, কিন্তু আমাকে বুঝতে দিচ্ছেন না। বাবারা হয়তো এভাবেই মুখ লুকিয়ে আড়ালে কাঁদেন।

লঞ্চঘাটে যখন পৌঁছাই, ঘড়িতে তখন সকাল ৯.৪০। ১০টায় নৌকা ছাড়বে। রিকশা থেকে নেমেই বাবা বললেন, ‘মা কিছু খেয়ে নাও, কী খাবে বলো?’
‘না বাবা, কিছু খাব না। মাত্রই তো বাসা থেকে খেয়ে এলাম।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা! আমার পছন্দের চিপস, বিস্কুট, কোমল পানীয় আর হাতে একটা আইসক্রিম ধরিয়ে বাবা বললেন, ‘তুমি এখানে বসো, আমি আসছি।’
একটু পরই বাবা এলেন। ‘আইসক্রিম হাতে নিয়ে বসে আছ কেন মা? খাও।’
—খাব না!
—কেন?
—ভালো লাগছে না!
—ভালো না লাগলেও খেতে হবে। না খেলে তোমার মাথা গরম হয়ে যাবে। খাও মা আমার।
—আগে তুমি একটু খেয়ে তারপর আমাকে দাও।
বাবা একটু খেয়ে আমাকে দিয়ে বললেন, ‘এই নাও এবার তো খাও। আমার জেদি মেয়ে। যা বলে তা–ই।’ বাবা মুচকি হাসছেন।

খেতে খেতে বাবাকে বললাম, ‘আমি চলে যাচ্ছি, তোমার খারাপ লাগছে না?’

বাবা কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। এদিকে, মাঝি নৌকায় ওঠার জন্য ডাকছেন। বাবা আমাকে নিয়ে নৌকায় উঠলেন। ঠিকমতো নৌকায় বসিয়ে আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে আবার নেমে গেলেন। বললেন, ‘সাবধানে যেয়ো মা। ফোনটা হাতে রেখো।’

আমি বসে রইলাম। নৌকা ছেড়ে দিয়েছে। বাবা ঘাটে দাঁড়িয়ে রইলেন। ওনার চোখ লাল। আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলেন না। আমি চুপচাপ বসে রইলাম।

পাঠাগার ও পাঠচক্র সম্পাদক, কিশোরগঞ্জ বন্ধুসভা