আমার শাড়ি পরা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দিনক্ষণ ঠিক মনে পড়ে না। তখন ক্লাস নাইন বা টেনে পড়ি। একদিন সকালবেলা একটা পার্সেল আসে, মেজো ভাইয়ের নামে। কলকাতা থেকে। ব্রাউন পেপারে মোড়ানো প্যাকেট। মা প্যাকেটটি একটা উঁচু সেলফে তুলে রাখেন। সবার হাতের নাগালের বাইরে। মা যেখানেই রাখেন না কেন, আমার উৎসুক চোখ ঐদিকে! কী আছে ওই প্যাকেটে!

উচ্চতায় ছোট হওয়ায় আমার সাধ্য ছিল না প্যাকেটটা নামিয়ে দেখার। যাই হোক, চেষ্টা করতে ক্ষতি কি! পরিকল্পনা শুরু করলাম। চেয়ারের উপর টুল, টুলের ওপর বালিশ দিয়ে দাঁড়িয়ে ছুঁতে পারলাম ঠিকই, কিন্তু ছিদ্র করতে পারলাম না। এবার ছিদ্র করার টার্গেট। মুহূর্তেই সব নিয়ে পড়লাম নিচে! জোরে শব্দ! মা দৌড়ে আসার পর আরেক শব্দ। থাপ্পড় খাওয়ার শব্দ! গালে হাত দিয়ে একটু জ্বালা পোড়াটা কমাচ্ছি, কিন্তু আমার চোখ ওই প্যাকেটে!

মা বলল, আয় খুলি! চোখ আমার চকচক করছিল। কী আছে ভেতরে! কলকাতা থেকে এসেছে। মানে বিদেশ থেকে! হাস্যকর লাগতে পারে আপনাদের কাছে। তবে আমার কাছে তখন ওইটাই অনেক দূরের!

হাত দুটো নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল। কোথায় রাখব? আঁচল ধরব নাকি ব্যাগ ধরব? মনে হচ্ছিল পড়ে না যাই আবার।

যাহোক, প্যাকেট খোলা হলো! হতাশ হলাম। ভেতর থেকে বের হলো খবরের কাগজে মোড়ানো একটা শাড়ি! অনেক সু্ন্দর। পুরো জমিনটা লাল, মেরুন আর সবুজ রং-এর বুটির পাড়। মানে চুন্দ্রির শাড়ি। চিকন পাড়। কি দারুণ! শাড়িটা অনেক মোলায়েম, সিল্কের। কেমন আদর আদর স্পর্শ! আমার মায়ের গায়ের রং কাঁচা হলুদ। সুন্দরী একজন মহিলা। মাকে খুব সুন্দর মানাবে। ওনাকে বললাম, তোমার শাড়ি!

ভাইয়া বাসায় ফিরল, অন্যদিকে আমি রুমে এসে আয়নার সামনে বসে গালটা দেখছি। কী আর করব। শুনছি মা ভাইকে বলছে, শাড়িটা সুন্দর হইছে। কানে আমার নামটাও শুনতে পেলাম। দৌড়ে বের হয়ে এলাম। মনে স্বপ্ন। হয়তো কিছু আছে আমার জন্য। আবার থাপ্পড় আরও একটা পরতে পারে! সামনে এসে একটু দূরে দাঁড়ালাম। ভাইয়া বলল, ‘আম্মা, শাড়িটা বুশরার জন্য এনেছি।’ আমি কানটা আরও পরিষ্কার করে শোনার চেষ্টা করলাম। আরে ভাই তো আমার কথাই বলল! দৌড়ে আবার আয়নার সামনে গেলাম নিজেকে দেখতে। এই কথা শুনে আমাকে কেমন লাগছে! আরে আমি তো দেখি খুশি। এই শাড়ি আমার! আমি কি বড় হয়ে গেছি? আয়নার সামনে ঘুরে ঘুরে নিজেকে বারবার দেখতে লাগলাম। আসলে কি বড় হয়ে গেছি? এখন যে ব্লাউজ পরতে হবে!

না বাবা, আমি এসব আজেবাজে জিনিস পরতে পারব না। মানুষ কী বলবে! কেমন করে তাকাবে। কী আজব, পেটও খোলা থাকবে! নাহ্ এই জিনিস পরা যাবে না।

আয়নার আরেকটু কাছে গিয়ে শাড়িটা গায়ে ধরলাম। ভালোই তো লাগছে! শাড়িটা আমার আলমারিতে রাখলাম। সুযোগ পেলেই খুলে দেখতাম। আর খেয়াল করা শুরু করলাম, কে কীভাবে শাড়ি পরে। নাটকে, খবরে খেয়াল রাখতাম। পছন্দ হলো আফসানা মিমি আর ত্রপা মজুমদারের শাড়ি পরা।

সামনেই আমার স্কুলের ফেয়ারওয়েল। সবাই শাড়ি পরবে। আমাকেও পরতে হবে। আমি আফসানা মিমির মতো পরতে চাই। লাগবে কিছু কাঁচের চুড়ি, একটা ঝোলা ব্যাগ, কাঁধে ঝুলানোর জন্য। আর একটা ছোট টিপ, লিপস্টিক। কেনার জন্য মাকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম। ঝামেলা হলো ব্লাউজ নিয়ে। কীভাবে এটা পরব! এটা তো অনেক ছোট! মানুষ কী বলবে! আর আমি তো বড় হইনি এখনো। মনে মনে বললাম, আমার ক্লাসের মেয়েদের কাজ নাই, তাই শাড়ি পরতে চায়। এমন ছোট ব্লাউজ কীভাবে পরে! কী আর করা। মা নিজের হাতে সেলাই করে দিলেন ব্লাউজ। মাপ আরও লম্বা, আরও লম্বা বলতে বলতে মায়ের হাতে দু-চারটা চড়ও খেতে হয়েছে।

রাতে ঘুম হলো না। ভোরে উঠেই মায়ের পেছনে ঘুরছি। যেদিক যায়, ঐদিকে যাই। যাকে বলে পায়ে পায়ে ঘোরা। আম্মা শাড়ি পরাতে গিয়ে তিনবার খুলতে হলো। এভাবে না, ওভাবে! আমার ইচ্ছার শেষ নাই। রাগ হয়ে মা বলল, যা আমি পারব না। কোথায় থেকে পরবি, পরে আয়। কান্না করে চোখ মুছে ভূতের বাচ্চা হয়ে গেলাম। অবশেষে পাশের বাসার এক বড় আপু আর আম্মা মিলে পরাতে সক্ষম হলো। আয়নায় নিজেকে দেখতে লজ্জা লাগছিল!

শাড়ির আঁচলটা ছেড়ে চুলগুলো খোলা রাখলাম। কাঁধে ঝুলানো একটা পাটের ব্যাগ। আর কপালে ছোট একটা মেরুন টিপ। দারুণ লাগছিল নিজেকে।

বাসা থেকে বের হতেই মনে হলো, সব মানুষ যেন আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আদৌ কেউ দেখছিল না। আমার মনের চিন্তা আসলে। আমার হাত দুটো নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল। কোথায় রাখব? আঁচল ধরব নাকি ব্যাগ ধরব? মনে হচ্ছিল পড়ে না যাই আবার।

স্কুলে প্রবেশের পর সবাই বলছিল সুন্দর লাগছে। তখন সবার কাছ থেকে শুনতে ভালোই লাগছিল। আর সুযোগ পেলেই কমনরুমে গিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখছিলাম। পুলকিত, রোমাঞ্চ এবং একইসঙ্গে লজ্জা অনুভব করছিলাম। বাসায় ফেরার সময় মনে হচ্ছিল, এত বড় কেন শাড়িটা? আর একটু ছোট হলেই কি এমন ক্ষতি হতো! শেষপর্যন্ত মোটামুটি পরনের শাড়িটা হাতে নিয়েই বাসায় ঢুকলাম।

এখনো আমি ঠিক ওইভাবেই শাড়ি পরি। শাড়ি আমার ভীষণ পছন্দের পোশাক। সাদামাটা সাজগোজ। আঁচলটা ছেড়ে দিয়ে। আমি যেহেতু হোস্টেলে একা থাকি, রুমমেটদের জ্বালাতন করি, শাড়ি পরার সময়। সেটা আবার একজন নয়। যে যখন রুমমেট থাকে, তাঁকে।

সাইকোথেরাপিস্ট কনসালট্যান্ট এবং সহসভাপতি, ঢাকা মহানগর বন্ধুসভা