অন্তর্মুখী এক বাঁশরিয়ার চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করে সেই সুরের স্রোতে মাতন লাগিয়ে দিয়েছেন বিশিষ্ট অভিনেতা জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়।
বাংলাদেশের বাঁশির সুরে জাদু আছে। এই পরম সত্য কথাটির একটা আক্ষরিক প্রমাণও ছোটবেলায় পেয়েছিলাম। কিংবদন্তি জাদুসম্রাট জুয়েল আইচ, বাংলাদেশ টেলিভিশনে বিনোদন অনুষ্ঠানে তিনি জাদু পরিবেশন করতেন। একবার কোনো এক উৎসবের বিশেষ বিনোদন অনুষ্ঠানে বিটিভিতে তিনি বাঁশি বাজিয়ে শোনালেন। মন্ত্রমুগ্ধর মতো শুনেছি। নিজের অবাক করে দেওয়া সব জাদু প্রদর্শনের মতো বাঁশিতে সব মায়া, সব জাদু উজাড় করে দিয়ে পল্লিবাংলার মেঠো সুরে নবীন কিশোরটিরও হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন।
‘বৃত্তের বাইরে’ চলচ্চিত্রটিতে মনপ্রাণ আকুল করা বাঁশি বাজিয়েছেন আরেক কিংবদন্তি বাঁশির সুরের জাদুকর মো. মনিরুজ্জামান। পরিচিত কোনো গানের সুরে কেউ বাঁশি বাজালে গানটা মনের মধ্যে বেশি বেশি পাক খেতে থাকে। আর অপরিচিত কোনো সুর ভেসে এলে বাঁশির সুরের মধ্যে আমরা পাক খেতে থাকি। একজন বংশীবাদক সব রকম সুরে মন ভোলাতে পারেন। মনিরুজ্জামানের বাঁশির সুরে অন্তরাত্মার শুদ্ধিকরণ ঘটে। গোটা চলচ্চিত্রজুড়ে ব্যবহৃত তাঁর সুর, শিরায় শিরায় প্রবাহিত হয়েছে। অন্তর্মুখী এক বাঁশরিয়ার চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করে সেই সুরের স্রোতে মাতন লাগিয়ে দিয়েছেন বিশিষ্ট অভিনেতা জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। একজন একনিষ্ঠ শিল্পীর অকৃত্রিম সুর ধারার পট, প্রেক্ষাপট, সাধনার অনুসন্ধান এবং বাইরের পৃথিবীতে কীভাবে তার মূল্যায়ন করা হচ্ছে, সেই বাস্তব কাহিনীতে সংলাপ বুনে, চিত্রনাট্য সাজিয়ে প্রযোজনা, পরিকল্পনা এবং পরিচালনা করেছেন মননশীল পরিচালক গোলাম রাব্বানী বিপ্লব। যদিও বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের মতো কাহিনিতে বলা থাকে সব চরিত্র কাল্পনিক; কিন্তু বাস্তবের দুনিয়াই আমাদের কল্পনাও সচরাচর বাস্তবচ্যুত হয় না।
বাস্তবের ভাঙাচোড়া, মাজাঘষা ছাড়া কল্পনাও দাঁড়ায় না। এই চলচ্চিত্রে অতি বাস্তবিক সুন্দর কাহিনির বিন্যাস করেছেন বাংলা সাহিত্য জগতের অন্য এক জাদুকর কবি ও লেখক আনিসুল হক। সব মিলিয়ে চাঁদের হাটে একটা শৈল্পিক বৃত্ত তৈরি হয়েছে। বিজ্ঞ সব ব্যক্তিবর্গের বৃত্তের পরিমণ্ডলের পরিস্ফুটিত ভাবনা প্রসারিত হয়েছে নিপুণভাবে।
যিনি বাঁশি বাজান, হরিপদ পাল একজন জাতশিল্পী। বাঁশি বাজিয়ে সংসার চলে না। জীবন জীবিকা পেশাস্বরূপ কুমারের মতো মাটির পাত্রও তৈরি করেন। বিবাহিত কন্যা সেই মাটির পাত্রে রং লাগিয়ে দেন। পালিত পুত্র, বাবা আর দিদির তৈরি করা সেই সব মাটির পাত্র আর বাঁশি বিক্রি করে বেড়ায়। গ্রামের দরিদ্র পরিবার হলেও পরিবারটিকে শিল্পমনস্ক বা জীবন শিল্পসাধনার আঁতুড়ঘরও বলা যায়। আমরা শিল্প মনস্ক বলতে শহুরে কিছু প্রচার পাওয়া শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, প্রগতিশীল ধারার মানুষকেই শুধু বুঝি। গ্রামের পরিচয়ের আড়ালে থাকা মানুষদের ভাবতে পারি না।
এই হরিপদ বাঁশরিয়ার সন্ধান পান এক সাংবাদিক। সাংবাদিককে বাঁশরিয়া বলেন, ‘মেয়ের জন্ম দিয়ে মা মারা গেছে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে, কিন্তু সংসার টেকেনি। এখন মেয়ের ঘরে এক আদুরে নাতি আছে। ১৭ বছর আগে পার্বতীপুর মেলা থেকে ছয়-সাত বছরের এক এতিম ছেলে মকবুলকে কুড়িয়ে এনেছিলেন তিনি। সেই সন্তান এখন রক্তের সন্তানের থেকে বেশি আপন।’ যেখানে শহুরে প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত বা অভিজাত মানুষের মধ্যে পর্যন্ত এখনো ধর্ম, জাতি ভেদাভেদ প্রবল; সুযোগ পেলেই একে অন্যের বিরুদ্ধে বিদ্বেষী হয়ে ওঠে, সেখানে গ্রামীণ এক দরিদ্র মানুষ সব বিদ্বেষের বিষবাষ্পকে দূরে ঠেলে দিয়ে এক অনাথ সন্তানকে আপন করে নিয়েছেন। তাই প্রকৃত অর্থে বাঁশরিয়া একজন স্বশিক্ষিত বড় মাপের মানুষও বটে।
গোল বাঁধল, নিজের বৃত্তে ঘুরে বেড়ানো নীরব সাধনার এই শিল্পী যখন বাইরের দুনিয়ায় পা রাখলেন। সাংবাদিককে নিজের মনের কৌতূহল থেকে বলেছিলেন, একবার ঢাকা যেতে চান। জীবনে চাওয়া পাওয়ার চাহিদা তার কম। এমন কোনো সাধ আহ্লাদ নেই, যা পূরণ হয়নি। তবে একবার ঢাকা যাওয়ার ইচ্ছা আছে। রাজধানী শহরের লোকজন কেমন হয়, তা জানার জন্য। আর শহরের কাগজে অজপাড়াগাঁয়ের বাঁশরিয়াকে নিয়ে সেই প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর, শহুরে শিল্পানুরাগী পুঁজিপতিশ্রেণির নজরে পড়ে যায়। তারা তাদের এক কর্মচারীকে গ্রামে পাঠিয়ে বাঁশরিয়াকে শহরে নিয়ে আসে।
প্রকৃত বড় মাপের একজন শিল্পীর মূল সত্তাকে মূল্য দিয়ে কেনা যায় না। আর্থিক মূল্যের বিনিময়ে কিনতে গেলে শিল্পীর মূল্যবোধে গিয়ে তা আঘাত করে। হাতের পাঁচটা আঙুল যেমন সমান নয়, পাঁচজন শিল্পীর ব্যক্তিসত্তা, ব্যক্তিগত মূল্যবোধও আলাদা আলাদা হতে পারে। এখানে গ্রাম থেকে তুলে নিয়ে আসা অপরিচিত শিল্পীকে প্রচার বা সম্মান দেওয়ার নাম করে কীভাবে তার শিল্পীসত্তাকে মুলা-বেগুনের মতো পণ্যে পরিণত করার চেষ্টা হয়েছে— কাহিনির পরতে পরতে তা উঠে এসেছে। আর্ট গ্যালারির এক পরিচালক ছবি ব্যবসায়ী যেমন এক চিত্রশিল্পীকে বলেন, ‘গত প্রদর্শনীতে রইসউদ্দীন স্যারের সব ছবি বিক্রি হয়ে গেছে। দাম তুলনামূলকভাবে কম ছিল।’ সেই কথা শুনে শিল্পী উত্তর দেন, ‘রইসউদ্দীন নিজে ছবি আঁকেন না। ছাত্রদের দিয়ে আঁকিয়ে নিজে শুধু স্বাক্ষর করে দেন। নামের জোরে তাতেই ছবি বিক্রি হয়।’
এই শিল্প ব্যবসায়ীরাই উঠেপড়ে লাগে বাঁশরিয়াকে জনসমক্ষে নিয়ে এসে ব্যবসাতে লাভবান হয়ে উঠতে। আর শিল্প ব্যবসায়ীদের বৃহত্তর এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে কর্পোরেট জগতের বড় পুঁজিপতি ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাংবাদিক, সম্পাদক, কবি, সাহিত্যিক, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, টিভি চ্যানেল এবং বিজ্ঞাপনজগৎ। খবরের কাগজের ভাষায় আমরা অন্ধকার জগতের মাফিয়া চক্রের কথা শুনি। এখানে পরিচালক আমাদের দেখান আলোর জগতের আলোকিত মানুষেরাও কম বড় মাফিয়া নয়। শিক্ষিত এলিট শ্রেণির মাফিয়ারা আরও বেশি শক্তিশালী। বাঁশরিয়ার প্রতিভা এখানে সোনার ডিম পাড়া হাঁস। আর সোনার ডিম বিক্রি করে লাভবান হয়ে উঠবে উচ্চবর্গের বৃহত্তর এই চক্র। সব মিলিয়ে একজন গাঁইয়া শিল্পীকে ঘিরে যেন একটা সার্কাস।
সাংবাদিক সাক্ষাৎকার নিতে এসে বাঁশরিয়াকে যেমন বলেন, ‘কেমন বাঁশি বাজান তা বড় নয়। বড় হচ্ছে কীভাবে আমরা খবর পরিবেশন করছি। তার ওপর সব খ্যাতি, প্রতিপত্তি জনপ্রিয়তা নির্ভর করছে।’ আর সাংবাদিক এই পরিবেশন করতে গিয়ে বাঁশরিয়া যা বলেননি, তাও বানিয়ে বানিয়ে লিখে বাজারে প্রতিবেদন ছেড়ে দেয়। মনগড়া গল্পে বাজারজাত প্রোডাক্ট করে তোলেন। প্রশ্ন এবং উত্তর দুটোই সাপলাই দিয়ে তার সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। এসবের মধ্যে পড়ে গিয়ে কোমলমতি বাঁশরিয়া এবং তার সহজসরল সন্তানের একপ্রকার নাভিশ্বাস ওঠে।
সন্তান মকবুল যেমন বাবাকে বলেন, ‘বাবা এই শহরে কিন্তু চাঁদের আলো নাই।’ বাবা উত্তর দেয়, ‘আছে, চারদিক মেলা আলো তো, তাই বোঝা যায় না।’ সন্তান বলে ওঠে, ‘কিন্তু এই আলোগুলা তো চাঁদের আলোর মতো নরম না। খুব ঝাঁজ।’ বাঁশরিয়া নিজেও ক্রমে সেই ঝাঁজ পেতে শুরু করে। মন দিয়ে বাঁশি বাজাতে পারে না। খবরের কাগজে, টিভি চ্যানেলে তাকে নিয়ে অনবরত খবর আসে, প্রতিবেদন হয়। শহরের রাস্তায় বিলবোর্ডে পর্যন্ত বড় ছবি উঠে আসে। শহরের গণ্যমান্য মানুষের সঙ্গে দেখা হতে থাকে। তাতেও এই গুণী শিল্পীর মন টানে না। বাঁশিতে আগের মতো সুর ওঠে না। জীবনদর্শন ভেতরে বাইরে ক্ষত বিক্ষত হতে হতে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালের বেডে পর্যন্ত তাকে চলে যেতে হয়।
চলচ্চিত্রটির চিত্রগ্রহণ করেছেন মাহফুজ উর রহমান খান। সম্পাদনায় ছিলেন জুনায়েদ হালিম। সংগীত পরিচালনা করেছেন বাপ্পা মজুমদার। শিল্পনির্দেশনায় ছিলেন শহীদ আহমেদ মিঠু, রাশেদুল হুদা, এস এম শরীফুল করিম। শব্দ পরিকল্পনা ও মিশ্রণ অনুপ মুখার্জী, সুজন মাহমুদ এবং জে ডি বাবুর। বাঁশরিয়ার মেয়ের চরিত্রে স্বল্প পরিসরে সুন্দর অভিনয় করেছেন রোকেয়া প্রাচী। এ ছাড়া অভিনয় করেছেন ফিরোজ কবীর ডলার, শহীদুল আলম সাচ্চু, ফজলুর রহমান বাবুসহ অনেকে।
তবে আজকের এই প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা বা শহুরে প্রাতিষ্ঠানিক চক্র একজন শিল্পীকে পুরোপুরি গ্রাস করে নেয়, সৃষ্টিসত্তা নিংড়ে নিয়ে ছিবড়ে করে ছেড়ে দেয়। এ ধরনের একমুখী ধারণার মধ্যেও কিন্তু গলদ আছে। বাংলাদেশের অসংখ্য কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকরা গ্রাম থেকে শহরে এসে অন্ধগলি, কানাগলি তার ভেতরে তস্যগলি সব জায়গায় হাতড়াতে হাতড়াতে লড়াই করে বড় হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান ছোট থেকে লড়াই করতে করতে বড় হয়। তাঁদের ছায়া প্রচুর মানুষের মাথার ওপর এসে পড়ে। প্রতিষ্ঠানে যারা কাজকর্ম করে, বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। একজন শিল্পী যদি নিজের মেরুদণ্ড শক্ত রেখে মূল্যবোধের পথ ধরে চলতে চান, ছোট প্রতিষ্ঠান, বড় প্রতিষ্ঠান, স্বল্প পুঁজি, বৃহৎ পুঁজি—সবাই মিলে তাকে এগিয়ে দিতে সাহায্য করে। নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে হলেও অনেক প্রতিষ্ঠানের ভেতরের মূল্যবোধের শিক্ষাবিস্তারের কার্যক্রম চালু থাকে। মূল কথা হলো, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে মর্যাদা দিতে শেখা। একজন ব্যক্তি মানুষও এভাবেই ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেন।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত