সংসারে পুরোপুরি প্রবেশ করার সামাজিক অনুষ্ঠান হলো বিয়ে। পাত্র-পাত্রী তাদের পরিচিত সবার উপস্থিতিতে ধর্মীয় রীতি মেনে একে অপরকে জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করে। দিন যত বদলায়, বিয়ের এসব রীতিনীতি কমে আসে, পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে পছন্দ আর নির্বাচনের ক্ষেত্রে। অদেখা কোনো মানুষকে জীবনসঙ্গী করার সময় আমরা পার করে এসেছি বহু বছর আগে। যুগের হাওয়া বদলে এখন বিয়ে নামক উৎসবেও পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তনের ছোঁয়া যতই আসুক, ভারতীয় উপমহাদেশসহ বিশ্বের সব দেশে বিয়ের মৌলিক বিষয়গুলো এখনো দেশ আর সংস্কৃতিভেদে ভিন্ন ভিন্ন রয়ে গেছে।
তবু তো বিয়ে, চার দেয়ালের ভেতর রচিত হয় নানা খুনসুটির গল্প। চার হাত একত্রিত করার সময় মানুষটা স্বল্প কিংবা দীর্ঘ যত সময়ের জন্যই পরিচিত হোক না কেন, সংসারে সে পুরোপুরি একজন নতুন মানুষ। অদল–বদলের এই পরিবর্তন মেনেই সংসার নামক রাজ্যে সবাই বসবাস করে। কিন্তু এই বিশ্বসংসারে এমনও কিছু পরিবর্তন হয়ে যায়, যা মানুষের চিন্তার বাইরে হলেও অবাস্তব নয়। মানুষ একসময় মেনে নিতে পারলেও সমাজে নানা প্রশ্ন ওঠে, বিতর্কের জন্ম হয়, মনের টানাপোড়েনে সম্পর্কের মোড় ঘুরে যায় কয়েক সেকেন্ডেই। যেখানে মানুষের কিছু করার না থাকলেও প্রকৃতি তার নিজ দায়িত্বে সেখানে নতুন পথের সৃষ্টি করে দেয়, যা মেনে নেওয়া ছাড়া মানুষের বিকল্প থাকে না।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নৌকাডুবি’ এমনই একটি উপন্যাস, যেখানে মানুষ সমাজ ও পারিবারিক বাধ্যবাধকতায় অনেক কিছু মেনে নিলেও প্রকৃতির খেলার মধ্যে ভিন্নতার রূপে আটকে যায়। প্রাকৃতিক এই বেড়াজালে বন্দী হয়ে অনেক মানুষের মতো রমেশ, কমলা, হেমনলিনী, নলিনাক্ষসহ অনেকের জীবনের পথচলাটাই যেন নতুন নতুন পথ ও গল্পের সৃষ্টি করে দেয়। নিজস্ব চিন্তা আর বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে মানুষ যতই গল্প রচনা করুক না কেন, প্রকৃতির এই নিয়মের কাছে সবই একসময় তুচ্ছ হয়ে যায়।
অজপাড়াগাঁ থেকে কলকাতা গিয়ে আইন পড়া রমেশও নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে শিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী ও উন্নত চিন্তার অধিকারী হেমনলিনীকে কল্পনা করেছিল। কিন্তু বাবার আদেশ কিংবা নিয়তির খেলায় দ্রুত সময়ের সিদ্ধান্তে অন্য একজনকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে ধর্মীয় সব বিধি মেনে। রমেশের জীবনের আকস্মিকতা এইটুকু হলেও হয়তো গল্পটা ভিন্ন না হয়ে সরল হতো। কিন্তু ওই যে প্রকৃতি, তার খেলার খবর কিংবা ইশারা বোঝার ক্ষমতা কতজন রাখে! না, কেউ রাখে না, রাখা সম্ভব হয় না।
বিয়ের পর নদীপথে বাড়ি ফেরার সময় হঠাৎ ঝড় ওঠে। সে ঝড়ে অনেকের মতো ভাগ্যক্রমে রমেশ বেঁচে যায়। কিন্তু তার জীবনে রচিত হয় নতুন গল্পের, যার পটভূমি আর উপসংহার করতে গিয়ে চলে যায় দীর্ঘ সময়। বিয়ের রাতের সেই হঠাৎ ঝড়ের নৌকাডুবি দুটি মানুষের সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকজনের জীবন যুক্ত করে অনেকগুলো ঘটনার জন্ম দেয়, যা নিয়ে রচিত হয় ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসটি।
ঝড়ের বিধ্বস্ত রূপের সঙ্গে মিল রেখে যে স্ত্রীলোকটিকে রমেশ আপনগৃহে নিয়ে যায়, কিছুকাল অতিবাহিত হওয়ার পর সে বুঝতে পারে যে রাতের ঝড় শুধু নৌকাডুবি নয়, তার জীবনেও ঝড় তুলে দিয়েছে। শুধু পার্থক্য রাতের ঝড় স্বল্প সময়ের জন্য ছিল, আর বাস্তবিক ঝড় দীর্ঘ সময়ের জন্য রচিত হয়েছে তার জীবনে।
নিজ গৃহে একসঙ্গে বাস করা অন্যের অচেনা স্ত্রীলোকটি, বয়স আর পড়াশোনায় পার্থক্য থাকা ব্যক্তি কমলাকে যখন রমেশ আবিষ্কার করে, তখন সে নতুন করে জীবন সাজাতে চায়। সহপাঠী যোগেন্দ্রের বন্ধু হয়ে তাদের বাড়ির বৈঠকখানায় প্রবেশ, অন্নদাবাবুর মেয়ে আর যোগেন্দ্রের বোন হেমনলিনীর সঙ্গে চায়ের আড্ডায় তৈরি হওয়া সুন্দর সম্পর্কের গ্রহণযোগ্য পরিণতি দিতে সে নতুন পথ তৈরি করার নানা পরিকল্পনা করে। কমলাকে নিয়েও পরিকল্পনা করে ফেলে। কিন্তু যোগেন্দ্রের আরেক বন্ধু অক্ষয় বিনা পরিশ্রমে নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে রমেশের গোপন পরিকল্পনায় হামলা দিয়ে সবার সামনে রমেশকে নিয়ে বিশ্বাসের দোটানার সৃষ্টি করে। যার ফলে সহজ সমাধান না হয়ে ধীরে ধীরে সেটা জটিল সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরি করে।
উপায়ান্ত না পেয়ে ভাগ্যের ওপর ভর করে বেরিয়ে পড়ে রমেশ কমলাকে নিয়ে। রচিত হয় স্টিমার যাত্রা, যেখানে নতুন চরিত্র যুক্ত হয় উমেশ আর বয়স্ক ত্রৈলোক্য চক্রবর্তী খুড়োমশাই। অনির্ধারিত স্টিমার যাত্রায় খুড়োমশাইয়ের অনুরোধে গাজীপুরে প্রবেশ ও সেখানেই থিতু হওয়ার স্বপ্ন বুনে রমেশ কমলাকে নিয়ে। কিন্তু সুন্দর দিনগুলোর শেষে যখন পরিণত একটা সমাধানে এগিয়ে যাচ্ছিল রমেশ আর কমলার জীবন, তখন একটা চিঠি বদলে দেয় তাদের জীবন, হারিয়ে যায় কমলা।
কাশীতে হাওয়া বদল করতে আসা হেমনলিনী আর তার বাবা অন্নদার সঙ্গে ডাক্তার নলিনাক্ষকে পরিচয় করিয়ে দেয় যোগেন্দ্র, তার বন্ধু অক্ষয়ের পরামর্শে। নতুন চরিত্র নলিনাক্ষের আগমনে ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসের সমাপ্তির শুভসূচনা হয়। ফেরারি হয়ে কমলাকে খোঁজে বেড়ানো রমেশও বন্ধু যোগেন্দ্রের কল্যাণে কাশীতে গমন করে। হেমনলিনীর কাছে নিজের সমস্তটা বলার সুযোগের সঙ্গে সঙ্গে কমলাকে রমেশ খুঁজে পায় সেখানে। আর খুড়োমশাই ও উমেশ খুঁজে পায় কমলা ও তার স্বামী রংপুরের ডাক্তার নলিনাক্ষকে। যে ডাক্তার, না দেখেই মা-বাবাহীন অন্যের আশ্রয়ে সংসারে বোঝা হয়ে থাকা কমলাকে বিয়ে করেছিল এবং নৌকাডুবির পর বেঁচে ফিরে মা ক্ষেমংকরীর শত অনুরোধেও বিয়ে নামক সম্পর্কে জড়ায়নি সে।
অনভিজ্ঞ কমলা গাজীপুরে থাকা অবস্থায় আত্মার সম্পর্কের বোন শৈলের কাছ থেকে স্বামী নামক সম্পর্কের বাস্তব রূপ বুঝতে শিখেছে। স্বামী বিপিনবাবুর ওপর শৈলের যত্ন কমলাকে সংসারে স্বামী আর প্রিয় মানুষের গুরুত্ব শিখিয়েছে। এভাবেই সংসারে মা লক্ষ্মী হয়ে থাকা কমলা একসময় জেনে গেছে লোকসমাজে দৃশ্যমান বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকা দেবতুল্য রমেশ তার স্বামী নয়। যে ব্যক্তি কোনো দিনও চার দেয়ালের ভেতর কিংবা কোনো সুযোগে সত্যিকার স্বামীর অধিকার আদায়ের চেষ্টা করেনি। এসব বিষয় ধীরে ধীরে পরিষ্কার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কমলা চলে যায় অনিশ্চিত পথে নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস করে।
প্রকৃতির খেলা, নিয়তির লেখা কিংবা সবার আশীর্বাদ, যা–ই হোক না কেন, একসময় কমলা তার স্বামীগৃহে প্রবেশ করে। দাপ্তরিক কিংবা সামাজিক স্বীকৃতির অপেক্ষা না করে সে স্বামী ও শাশুড়ির যত্ন নিয়ে সংসারের যাবতীয় কাজের দায়িত্ব পালন করতে থাকে। একসময় কমলার স্বামী ডাক্তার নলিনাক্ষ সব জেনে মেনে নিয়ে আলো আসার পথ দেখিয়ে সামনে এগিয়ে চলার প্রতিশ্রুতি দেয়। এভাবেই পুনঃ স্থাপনের মাধ্যমে সমাপ্ত হয় নৌকাডুবিতে বন্ধন ছেঁড়া সম্পর্কের।
প্রাকৃতিক ঝড় আর মানবসৃষ্ট নৌকায় ভর করে চলা মানুষের জীবনে নৌকাডুবির ঘটনা সাধারণ কোনো বিষয় নয়। নৌকাডুবির মতো এমন নানা ঘটনা অনেক মানুষের জীবনের দৃশ্যপটটাই বদলে দেয়। জীবন থেকে দীর্ঘ সময় হারিয়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে মনের ভেতর গড়ে ওঠা স্বপ্নের বিসর্জনও হয়। হারিয়ে যাওয়া সময় কিংবা ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা নিয়ে সামনে চলা কঠিন হলেও বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষ নতুন করে স্বপ্ন দেখে। এই স্বপ্ন দেখাই হঠাৎ ঝড় আর শত নৌকাডুবির পরেও মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, মানুষ বেঁচে থাকে, থাকতে চায় আমৃত্যু।
হাজীপুর, নরসিংদী