ফুটবল
নরক থেকে থিয়েটার অব ড্রিমসে
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও ব্রাজিল জাতীয় ফুটবল দলের ফরোয়ার্ড অ্যান্টনি ম্যাথিউস ডস সান্তোস। অ্যান্টনি নামেই বেশি পরিচিত। দ্য প্লেয়ার্স ট্রিবিউনে শুনিয়েছেন নিজের জীবনের গল্প। সেটিরই কিছু অংশ পাঠকদের জন্য অনুবাদ করা হলো।
আমার জন্ম হয়েছিল নরকে। মজা করছি না কিন্তু। সাও পাওলোর ফাভেলা, যেখানে বেড়ে ওঠেছি, সেটিকে নরকের একটি অংশ বলে ডাকা হয়।
যদি আমাকে ব্যক্তি হিসেবে সত্যিই বুঝতে চান, তাহলে আগে আমি কোথা থেকে এসেছি, সেটা বুঝতে হবে। আমার ইতিহাস, আমার শিকড়।
এটি একটি অখ্যাত জায়গা। আমাদের বাড়ির ১৫ কদম দূরে সব সময় মাদক কারবারিদের আনাগোনা থাকত। তারা তাদের ব্যবসা করত, হাতে হাতে সামগ্রী আদান-প্রদান করত। জানালায় দাঁড়ালেই সব সময় মাদকের ঘ্রাণ পাওয়া যেত। প্রতিদিন গোলাগুলি দেখায় এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে বন্দুক দেখলে আর ভয় লাগত না। তবে পুলিশকে ভয় পেতাম। একবার তারা এক লোককে খুঁজতে আমাদের বাড়িতে হানা দেয়। তারা কিছুই পায়নি। কিন্তু যখন আপনি অল্পবয়সী হবেন, এই ব্যাপারগুলো মনের মধ্যে গেঁথে যায়।
ছোটবেলায় এমন কিছু দেখেছি, কেবল তাঁরাই বুঝতে পারবেন, যাঁরা এই পরিস্থিতিতে বসবাস করেছেন। তখন বয়স ৮ কি ৯ বছর হবে। এক সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে রাস্তায় শুয়ে থাকা এক মানুষের ওপর দিয়ে যাই। লোকটি নড়াচড়া করছিলেন না। কাছাকাছি যাওয়ার পর বুঝতে পারলাম, তিনি মৃত। ফাভেলাতে এই ব্যাপারগুলো সাধারণ। আমাকে স্কুলে যেতেই হবে। তাই চোখ দুটি বন্ধ করে মৃত দেহের ওপর দিয়ে স্কুলে চলে যাই।
আমি বলছি না যে এটি কঠিন কিছু। তবে এটাই আমার বাস্তবতা ছিল। এমনকি সব সময় বলি, ছোটবেলায় আমি খুবই সৌভাগ্যবান ছিলাম। স্বর্গ থেকে আমার জন্য উপহার ছিল। ফুটবল ছিল আমার রক্ষাকারী। ফাভেলাতে ক্রিসমাসের সময় খেলনাসামগ্রী আমাদের এত টানত না। পায়ের মধ্যে কেবল ফুটবল হলেই হতো।
প্রতিদিন আমার বড় ভাই আমাকে খেলতে নিয়ে যেত। ফাভেলাতে সবাই ফুটবল খেলত। শিশু, বৃদ্ধ, শিক্ষক, নির্মাণশ্রমিক, বাস ড্রাইভার, মাদক কারবারি, গ্যাংস্টার—ফুটবল মাঠে সবাই সমান ছিল। শুরুর দিকে খালি পায়ে খেলতাম। পায়ে রক্তপাত হতো। ফুটবল জুতা কেনার জন্য অর্থ ছিল না। ছোট হলেও আমি প্রচুর ড্রিবলিং করতাম। এটি এমন কিছু, যা সব সময় আমার ভেতরে ছিল। পায়ে বল থাকলে কোনো ভয় আমাকে কাবু করতে পারত না।
কিংবদন্তিদের কাছ থেকে আমি সব ট্যাকনিক আয়ত্ত করি। রোনালদিনহো, নেইমার, ক্রিস্টিয়ানো—ইউটিউবে তাঁদের দেখতাম। এ জন্য আঙ্কেল টনিলোকে ধন্যবাদ। তিনি আমার রক্তের সম্পর্কের আঙ্কেল ছিলেন না, প্রতিবেশী ছিলেন। তিনি আমাকে পরিবারের সদস্য মনে করতেন। তাঁর ওয়াই–ফাই ব্যবহার করে ইউটিউব দেখে ফুটবল শিখতাম। আমার প্রথম ভিডিও গেমও তিনিই দিয়েছিলেন। যদি টনিলোর কাছে দুটি রুটি থাকত, একটি আমাকে দিতেন।
সব সময় বলি, আমি ভুল জায়গায় জন্মগ্রহণ করেছি; তবে সঠিক মানুষদের সঙ্গে। যখন আমার আট বছর বয়স, প্রথমবার কোনো ফেরেশতা আমার জীবনে আসে। গ্যাংস্টারদের বিপক্ষে খেলার সময় বৃদ্ধ লোকটি আমার ড্রিবলিং, ট্যাকলিং এসব দেখে। সে অন্য লোকদের জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এই ছোট্ট বাচ্চাটি কে?’
লোকটি ছিল গ্রেমিও বারোইরির পরিচালক। তিনিই আমাকে প্রথমবার বস্তি থেকে বের হয়ে আসা এবং তাঁর ফুটসাল টিমে খেলার সুযোগ দেন। তারপর আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। এখনো মনে আছে, একদিন মায়ের সঙ্গে হাঁটছিলাম; তখন বাড়ির পাশেই একটি লাল রঙের গাড়ি দেখতে পাই। এটি ছিল রেঞ্জ রোভার। তবে আমার কাছে এটি ছিল ফেরারি দেখার মতো। সবাই গাড়িটির দিকে তাকাচ্ছিল। আমি মাকে বললাম, ‘একদিন যখন আমি ফুটবলার হব, আমি এই গাড়ি কিনব।’
মা হেসেছিলেন। তবে আমি খুবই সিরিয়াস ছিলাম। বলেছিলাম, ‘চিন্তা কোরো না, তোমাকেও চালাতে দেব।’
ওই সময় মা-বাবার মাঝখানে একই বিছানায় ঘুমাতাম। আমার জন্য আলাদা বিছানা কেনার অর্থ ছিল না। প্রতি রাতে ঘুমানোর সময় একপাশে ফিরলে দেখতাম বাবাকে, অন্যপাশে ফিরলে দেখতাম মাকে। আমরা খুবই কাছাকাছি ছিলাম, যা আমাদের বেঁচে থাকতে সহায়তা করত। তারপর একদিন এমন কিছু ঘটে, যা আমাদের জীবনকে পরিবর্তন করে দেয়।
যখন আমার বয়স ১১, মা–বাবার মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। এটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়। তবে এ সময় আমাকে অনেক অনুপ্রেরণাও জুগিয়েছে। চোখ বন্ধ করে নিজেই নিজেকে বলতাম, ‘এই অবস্থা থেকে আমাকে বের হয়ে আসতে হবে।’
আমার বাবা ভোর পাঁচটায় কাজের জন্য বের হয়ে যেত। ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বাজত। আমি তাকে বলতাম, ‘এখন তুমি আমার জন্য দৌড়াচ্ছ। শিগগিরই আমি তোমার জন্য দৌড়াব।’
আপনি যদি মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেন, দেখবেন, তারা সব সময় আপনার স্বপ্ন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে। চ্যাম্পিয়নস লিগ? বিশ্বকাপ? ব্যালন ডি’অর?
এগুলো স্বপ্ন নয়, এগুলো লক্ষ্য। আমার একমাত্র স্বপ্ন ছিল ফাভেলা থেকে মা-বাবাকে বের করে নিয়ে আসা। কোনো দ্বিতীয় পরিকল্পনা ছিল না। হয় আমাকে এটি বাস্তবায়ন করতে হবে অথবা মরতে হবে।
মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে আমি বস্তি থেকে এজাক্স হয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে আসি। মানুষ আমাকে জিজ্ঞেস করে, কীভাবে এত দ্রুত পরিবর্তন করলাম?
১৪ বছর বয়সে সাও পাওলো এফসিতে খেলার সুযোগ পাই। প্রতিদিন স্কুলের পর খালি পেটে একাডেমিতে যেতাম। মাঝেমধ্যে যদি ভালো দিন হতো, সতীর্থরা মিলে বিস্কুট কিনে খেতাম। অনুপ্রেরণার জন্য আমাকে না খেয়ে থাকতে হতো না। ক্ষুধা ছিল সত্যিকারের।
আমার ভেতরে একধরনের অনুভূতি রয়েছে, আপনি এটিকে রাগ বলতে পারেন। এই অনুভূতি নিয়ে আমিও সমস্যা ফিল করি। তিনবার ভিন্ন সময়ে ক্লাব থেকে প্রায় বাদ পড়তে যাচ্ছিলাম। ক্লাব থেকে ছাঁটাইয়ের তালিকায় ছিলাম। তিনবারই ক্লাবের কেউ একজন আমার পাশে দাঁড়ায় এবং ছাঁটাই হওয়া থেকে রক্ষা করে। এটি সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা ছিল।
মানুষ মনে করে, আমি তাঁদের মিথ্যা বলছি। সাও পাওলোর হয়ে যখন আমার পেশাদার ফুটবলে অভিষেক হয়, তখনো আমি ফাভেলাতে বসবাস করি। এটাই সত্য। ১৮ বছর বয়সেও আমি বাবার সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমাতাম। আমাদের অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। এমনকি ২০১৯ সালে যখন আমি পাওলিস্টা ফাইনালে করিন্থিয়ান্সের বিপক্ষে গোল করি এবং রাতে বাড়িতে ফিরি, প্রতিবেশীরা আমাকে রাস্তায় দেখে চিনতে পারে। তারা বলছিল, ‘মাত্রই তোমাকে টিভিতে দেখলাম। এখানে কী করছ?’ জবাবে বলেছিলাম, ‘আমি এখানে বাস করি।’ কেউই বিশ্বাস করেনি, সবাই হেসেছিল।
এক বছর পর আমি এজাক্সে ছিলাম, চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলছিলাম। সবকিছু কত দ্রুত বদলে যায়। কেবল আমার আলাদা বিছানা হয়নি, মায়ের চালানোর জন্য একটি রেঞ্জ রোভারও কিনি। মাকে বলেছি, ‘দেখো, তোমাকে বলেছিলাম—আমি জয় করব। আমি জয় করেছি।’
১০ বছর বয়সে যখন আমি এ কথা বলেছিলাম, তিনি হেসেছিলেন। আর এখন যখন বলছি, তিনি কান্না করছিলেন।
মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে আমি বস্তি থেকে এজাক্স হয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে আসি। মানুষ আমাকে জিজ্ঞেস করে, কীভাবে এত দ্রুত পরিবর্তন করলাম? সত্যি বলতে এর কারণ, ফুটবল মাঠে আমি কোনো চাপ অনুভব করি না। কিসের ভয়? যখন আপনি মৃতদেহের ওপর দিয়ে স্কুলে যেতে পারেন, তখন ফুটবলে কোনো কিছুকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।
জীবনে আমরা অনেক কষ্ট করি, অনেক ভয় পাই, অনেক কান্না করি। কিন্তু ফুটবলে? যখন আপনার পায়ে একটি বল থাকবে, আপনি আনন্দ অনুভব করবেন। আমি জন্মগতভাবে ড্রিবলার। এটি আমার শিকড়ের অংশ। এটি সেই উপহার, যেটি আমাকে বস্তি থেকে থিয়েটার অব ড্রিমসে (ওল্ড ট্রাফোর্ড—ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হোম ভেন্যু) নিয়ে এসেছে। আমি কখনোই আমার খেলার ধরন পরিবর্তন করব না। কারণ, এটি কোনো স্টাইল নয়, এটিই আমি। এটি আমার একটি অংশ। ব্রাজিলীয়দের গল্পের একটি অংশ।