স্বপ্নপূরণ

অলংকরণ: আরাফাত করিম

তখন মধ্যদুপুর, আকাশে কিঞ্চিৎ মেঘ করেছে। তবে বৃষ্টি আসবে বলে মনে হয় না। বৃষ্টি এলেই কী আর না এলেই-বা কী, আমিনুলকে প্রতিদিনই বের হতে হয় তার জীবিকার একমাত্র সম্বল রিকশা নিয়ে।

অন্য দিনের মতো আজও আমিনুল রিকশা নিয়ে বের হয়েছে। আজকের দিনটি একটু অন্য রকম। আজ ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস। সকাল থেকে সারা শহরের অলিতে-গলিতে বঙ্গবন্ধুর সেই কালজয়ী ভাষণটি মাইকে বাজানো হচ্ছে। এ ভাষণ আমিনুলের খুবই পরিচিত। অলস দুপুরে যখন খালি রিকশায় একটুখানি ঝিমাচ্ছিল, তখন বারবার কানে ভেসে আসতে লাগল ভাষণটি। এমন ভাষণে কার না রক্ত গরম হয়, কার না সাধ জাগে দেশমাতৃকাকে ভালোবেসে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে! ফাঁকা রিকশায় একাকী বসে এসব ভাবতে থাকে আমিনুল।

‘এই মামা যাবেন’, হঠাৎ পেছন থেকে ডাক দেয় দুজন যুবক-যুবতী।
‘কই যাবেন মামা?’ আমিনুল জানতে চায়।
‘এই তো টিএসসির দিকে’, ছেলেটির উত্তর।
‘চলেন।’
‘ভাড়া কত?’
‘মামা, আজ স্বাধীনতা দিবস, ভাড়া আফনেরা ইনসাফ মতোই দিয়েন।’

দুজনে রিকশায় উঠে বসে। ওদের নিয়ে আমিনুলের পথচলা শুরু হয়। একজনের নাম ঐশী, অপরজন সাফাত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। রিকশা চলছে টিএসসির দিকে, আর কানে বারবার ভেসে আসছে সেই ভাষণ। ভাষণ শুনতে শুনতে হঠাৎ আমিনুল ‘জয় বাংলা’ বলে জোরে চিৎকার করে ওঠে। ঐশী আর সাফাত অবাক হয়ে যায়, সামান্য ভয়ও পায়।

‘মামা, এভাবে চিৎকার করলেন কেন?’ ঐশী জানতে চায়।
‘কিছু না, মা। একটা পুরান কথা মনে পইড়া গেল তো, তাই আরকি।’
‘সেই কথাটা কি আমরা জানতে পারি?’ প্রশ্ন করে সাফাত।
‘হুনবেন আফনেরা, তয় হুনেন। বাপজান আফনেগো মতো আমারও সংসার আছিল, আমিও বহুত সুখে আছিলাম। গোলাভর্তি ধান, উঠানে গরু, বেবাক আছিল। বউ আর মাইয়া লইয়া খুব ভালো আছিলাম।’
‘তারা কোথায় এখন?’
‘অনেক কথা, মামা। আমার মাইয়াডার বিয়ার বয়স হইয়া গেছিল, কথাও হইতাছিল। কিন্তু একদিন দ্যাশে যুদ্ধ শুরু হইল, আমাগো গেরামের সবাই যুদ্ধে গেল, দু-একজন ছাড়া। হেগো দেইখ্যা আমারও মনে কইল যাইতে। একদিন বউরে কইলাম, যুদ্ধে যামু, আমার দ্যাশ মারে বাঁচামু। আমার বউডা খুবই ভালা, আমারে যাইতে দিল। যুদ্ধ করলাম, আফনেগো লাইগা দ্যাশ স্বাধীন করলাম, আমার একটা চোখও হারাইলাম, এক চোখ লইয়া অহন রিশকা চালাই। কিন্তু যুদ্ধ শেষে যখন বাড়িতে গেলাম, যাইয়া দেহি আমার ঘরবাড়ি কিছুই নাই। মাইনষে কইল, সব মিলিটারি জ্বালাইয়া দিছে, আমার বউ আর ফুটফুটে মাইয়াডারে ওরা পশুর মতো শেষ করছে।’ বুকফাটা আর্তনাদ করে ওঠে আমিনুল।

‘তার মানে, আপনি মুক্তিযোদ্ধা। রিকশা থামান মামা।’ বলে রিকশা থেকে নেমে যায় দুজন। ‘আপনার আজ এ অবস্থা কেন?’ ওরা জানতে চায়।
‘ভাইগ্য মামা ভাইগ্য। আজ আমার কিছু নাই, দুঃখও নাই, দ্যাশ তো পাইছি। তয় মামা আমি খোয়াব দেহি আফনেগো লইয়া, আফনেরা এই দ্যাশটারে অনেক দূরে লইয়া যাইয়েন। আমাগো আশাডা পুরাইয়েন।’

ঐশী আর সাফাত আমিনুলকে এক হাজার টাকার একটি নোট দিয়ে বলে, ‘এটা আপনার স্বাধীনতা দিবসের উপহার।’ কিন্তু আমিনুল নিতে চায় না। বলে, ‘ট্যাহা লাগব না, আমাগো স্বপ্নডা পুরাইয়েন, দ্যাশটারে দুর্নীতিমুক্ত কইরেন। তাইলেই আমার উপহার হইয়া যাইব।’

শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়