সালমান শাহর জন্য স্মরণীয়–বরণীয় ‘আনন্দ অশ্রু’

একটি সিনেমার দৃশ্যে সালমান শাহ ও শাবনুরছবি:সংগৃহীত

একটি খাঁটি বিশুদ্ধ ভরপুর আবেগের ছবির নাম ‘আনন্দ অশ্রু’। এমন মনমাতানো হৃদয় দগ্ধ করা খাঁটি বিশুদ্ধ প্রেমের ছবি কখনো কখনো উঠে আসে সৃষ্টিকর্তাদের হাত থেকে। বাংলা চলচ্চিত্র জগতে কিছু কিছু বাণিজ্যিক ধারার ছবি যেভাবে গণমানুষের মুখের ভাষায় সুপার–ডুপার হিট হয়ে ওঠে, এই ছবিও সেই ধারার। পরিচালক শিবলী সাদিক ছবির মাত্রা বেঁধে দিয়েছেন বিশুদ্ধ আবেগে ভর করে। ছবির সংলাপ, চিত্রনাট্য, দৃশ্য ধারণ, ঘটনা বুনন—সব কিছুতেই পরিশীলিত ধ্রুপদী ঘরানার ছাপ। ছবির সৃজনশীল বৌদ্ধিক মাত্রা আগাগোড়া বাঁধা পড়েছে আবেগ আর প্রণয়ের মিলমিশে, মনন আর বুনোনের বাহুডোরে। এমন নিখাদ প্রেম খাঁটি সোনার থেকেও খাঁটি। বাংলাদেশের মাটির সম্পদ।

একটি নির্ভেজাল সৃষ্টির সঙ্গে কিছু কিছু বাস্তব ঘটনা জুড়ে গিয়ে মানুষের আবেগকে কখনো কখনো আবার সপ্তমে পৌঁছে দেয়। রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ‘ভালো আছি ভালো থেকো /আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো…’ কবিতার কথাগুলো সুরের স্রোতে ভেসে আপামর বাঙালির হৃদয় ছুঁয়েছে, মানুষের নিষ্কলুষ হৃদয় দগ্ধ করে চোখে এনেছে। কারণ, মহৎ সৃষ্টিকে পৃথিবীর মানুষের হাতে তুলে দিয়ে মহান স্রষ্টা অকালে হারিয়ে গিয়েছেন। স্রষ্টার অবচেতন মনেও কি জায়গা করে নিয়েছিল এমনটা হতে পারে? গানটা যখন যারাই করুক গানের মাধ্যমে সবাই আসলে রুদ্রের জন্য কাঁদে। ‘আনন্দ অশ্রু’ চলচ্চিত্রটিও মানুষের জীবনে সালমান শাহের জন্য স্মরণীয়–বরণীয়, দগ্ধ হৃদয় ব্যথায় অশ্রুসজল আবেগধারা হয়ে উঠেছে। অমর প্রেমের কাহিনীগুলো যে চিরকালই এমনই দহন যন্ত্রণার ফসল। আমরা চাই না রুদ্র, সালমান শাহের মতো তরুণ প্রতিভারা পৃথিবীর মাটি ছেড়ে অকালে হারিয়ে যাক। ঘটনা তবু ঘটে আর সারা জীবন আমাদেরও সংবেদনশীল মন কাঁদে।

একজন দোলা, অন্যজন ভাবনা। দেওয়ান খসরু হলেন সালমান শাহ, দোলা শাবনূর এবং ভাবনা হলেন কাঞ্চি।

এই ছবিতেও মানুষের মুখে মুখে ঘুরে ফেরা জনপ্রিয় একটি গান আছে। ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা /হৃদয়ের সুখের দোলা /নিজেকে আমি ভুলতে পারি / তোমাকে যাবে না ভোলা…’। গানের কথার মধ্যে লুকিয়ে আছে দেওয়ান খসরু নামের প্রেমিকের মানসী প্রতিমা ভালোবাসার দুই নারীর নামও। একজন দোলা, অন্যজন ভাবনা। দেওয়ান খসরু হলেন সালমান শাহ, দোলা শাবনূর এবং ভাবনা হলেন কাঞ্চি। সব মিলিয়ে আমির খসরুর প্রেমের কবিতার মতনই সুন্দর এই ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনি। ১৯৯৭ সালে এই ছবি মুক্তি পায়।

ছবিতে খসরু একজন তরুণ গীতিকার, গান পাগল, শহুরে কলেজ পড়ুয়া সন্তান। প্রকৃতির মধ্যে প্রাণের ভাষা খুঁজে বেড়ানো প্রেমিক কবি। সামনে হাতের নাগালে বারেবারে ধরা দিয়ে যাওয়া ভাবনার মনের কথা সে বি বোঝে? নাকি রক্ত মাংসের সম্পর্কের প্রেমকে ইচ্ছা করেই এড়িয়ে যেতে চায় নিজের সাধনা ভ্রস্ট হবে বলে। বন্ধুদের মধ্যে কিন্তু সে গম্ভীর নয়, সর্বদাই প্রাণ চঞ্চল। সৃষ্টিশীল মানুষ হওয়ার কোনো অহংকার নেই। প্রকৃত সৃষ্টিশীলতা যে এমনই জীবন দাবি করে। আর এই অহংকার, আভিজাত্য বোধ নেই বলেই নিজের গ্রামে গিয়ে সে এক গরিবের মেয়ের প্রেমে পড়ে।

এক চঞ্চলা চপলা সহজ সরল গ্রাম্য কিশোরী তার মনে দোলা দেয়। এমন মনের মানুষের সন্ধানই সৃষ্টিসত্তা চায়। কেউ কেউ পায়, কেউ সারাজীবন খুঁজেও পায় না। এই কাহিনীর বিশেষত্ব এখানেই, মনের মানুষের সন্ধান পেয়েও তাকে হারাতে হয়। সমাজের শ্রেণি বিভাজনের বিরুদ্ধে আপোষহীন লড়াই করতে গিয়েও শিল্পীকে হেরে যেতে হয়। তারই নিজের চাচা, নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ইনজেকশন দিয়ে তাকে পাগল বানিয়ে দেয়। এই প্রেমিক এবং পাগল দুটি চরিত্রেই সালমান শাহ দুনিয়া কাঁপানো অভিনয় করেছেন। তার প্রতিটি সত্তায় দারুণ এবং নিদারুণ সুন্দর।

ছবিতে দোলা বা দুলি রূপী গ্রাম্য পাড়া মাতানো, বাইর চড়ানো, দুরন্ত এবং বোকাসোকা অতি সরল চরিত্রের শাবনূর অনন্যা। তার দুই নয়নের আলো যেমন প্রাণ এবং প্রকৃতিকে আলোকিত করে, তার তিড়িংবিড়িং লাফানো, বেকুব বেকুব হাসি, ভেঙচি কাটা, যমজ পাড়াতুতো পালোয়ান দুই ভাইকে সাগরেদ করে দুষ্টুমি করে চলা, গাছ থেকে পাখির ছানা নামিয়ে আনা, পাখির সন্ধানে উঠে সাপের ছোবল খাওয়া, শহুরে শিল্পীর নজরে এসে প্রেমে ধরা, একসময় ঘটনাক্রমে অজানা জায়গায় এসে নার্স হয়ে ওঠা এবং হারানো বিত্তবান প্রাণপ্রিয়ের উন্মাদ দশা দেখে অনবরত কেঁদে চলা; নিজের ভেতরে খুন হয়ে যাওয়া প্রতিটি দৃশ্যে নিজের ছাপ রেখে যেতে পেরেছেন। সালমান-শাবনূর জুটি এই কারণেই আজও মানুষের মুখে মুখে চর্চা হয়।

ভাবনা চরিত্রে কাঞ্চিও অপরূপা সুন্দরী। তাঁর অভিনয় সত্তাও কম সুন্দর নয়। মহব্বত আলী চরিত্রে দিলদার দিল খুলে অভিনয় করেছেন। অন্যান্য চরিত্রে ডলি জহুর, হুমায়ুন ফরীদি, সাদেক বাচ্চু— সবাইকে ভালো লাগে। মন জয় করা ছবির গীতিকার, সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। গানে কণ্ঠ দিয়েছেন সুবীর নন্দী,এন্ড্রু কিশোর, সালমা জাহান, কনকচাঁপা, দিলরুবা খানম, শাকিলা জাফর, আগুন। নৃত্য পরিচালনা করেছেন ইলিয়াস জাভেদ, আমির হোসেন বাবু, মাসুম বাবুল, ইরান। কাহিনি জামান আখতার।

এটি সুখের ছবি নয়। তবে দুঃখেরও আনন্দ থাকে। তাই দুঃখের শিল্প সৃষ্টি হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ যেমন বহুমাত্রিক, ‘আনন্দ অশ্রু’ নামকরণেও সার্থক।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত