বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব প্রখ্যাত পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, গীতিকার এবং প্রযোজক তারেক মাসুদ। ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ করে বাংলাদেশকে তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যান। গতানুগতিক বাণিজ্যিক ধারার বাইরে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী ছিলেন এবং এ ব্যাপারে বরাবর সচেষ্ট থেকেছেন। বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি প্রবর্তন করেছেন এক নতুন ধারা। দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসার জন্য আমেরিকার বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন। চলচ্চিত্র নির্মাণের কণ্টকাকীর্ণ পথে আমৃত্যু লড়াকু চলচ্চিত্রযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে যুক্ত রাখেন। পর্দায় তিনি সুনিপুণ দক্ষতায় তুলে ধরেছেন সাধারণ মানুষ, তাদের যাপিত জীবন, দ্বন্দ্ব, টানাপোড়েন, সমাজব্যবস্থা, লোকসংস্কৃতি, ধর্ম, তত্ত্ব, মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি, রাষ্ট্র এবং সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের নানান অসংগতি। তিনি অভিধা পেয়েছিলেন ‘বাংলার সত্যজিৎ’ নামে।
তারেক মাসুদের পুরো নাম আবু তারেক মাসুদ। ১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার নূরপুর গ্রামে এক রক্ষণশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর বাবা মশিউর রহমান মাসুদ এবং মা নুরুন নাহার মাসুদ। ভাঙ্গা ঈদগাহ মাদ্রাসায় তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তারেক মাসুদ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শিল্প-সংস্কৃতি চর্চায় নিজেকে যুক্ত করেন। এরপর তিনি ১৯৭৫ সালে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ থেকে ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স শেষ করেন। এরপর তিনি তাঁর প্রথম প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন।
আদম সুরত (১৯৮৯), মুক্তির গান (১৯৯৫), মুক্তির কথা (১৯৯৬), মাটির ময়না (২০০২), অন্তর্যাত্রা (২০০৬), রানওয়ে (২০১০)– এর মতো অসাধারণ সিনেমা নির্মাণ করেন তারেক মাসুদ। বাংলা চলচ্চিত্রে সূচনা করেন এক নবধারা। গুণী এ নির্মাতা চলচ্চিত্রবিষয়ক বিভিন্ন প্রবন্ধও লিখেছেন। বিভিন্ন সময়ে তাঁর লেখা ৩৩টি প্রবন্ধ নিয়ে ২০১২ সালে ‘চলচ্চিত্রযাত্রা’ নামে একটি প্রবন্ধ-গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তারেক মাসুদ ও তাঁর জীবনসঙ্গী ক্যাথরিন মাসুদ মিলে ‘অডিওভিশন’ নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি পরিচিত ছিলেন ‘সিনেমা ফেরিওয়ালা’ নামে। চলচ্চিত্রের বিভিন্ন কাজে ক্যাথরিন মাসুদকে নিয়ে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম–গঞ্জে ঘুরেছেন তারেক মাসুদ।
স্বল্পদৈর্ঘ্য, প্রামাণ্যচিত্র, অ্যানিমেশন ও পূর্ণদৈর্ঘ্য মিলিয়ে মোট ১৬টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন তারেক মাসুদ। ২০০২ সালে তাঁর পরিচালিত ‘মাটির ময়না’ কান চলচ্চিত্র উৎসবে ডিরেক্টরস ফোর্টনাইটসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করে। ‘মাটির ময়না’ বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র যা অস্কার পুরস্কারে সেরা বিদেশি ভাষার ছবি বিভাগে মনোনয়ন পায়।
ক্ষণজন্মা এই ব্যক্তিত্ব ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট তাঁর স্বপ্নের প্রকল্প ‘কাগজের ফুল’ চলচ্চিত্রের শুটিং স্পট নির্বাচন করে ঢাকায় ফেরার পথে মানিকগঞ্জের ঘিওরে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। ২০১২ সালে চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করে।
তারেক মাসুদ আমৃত্যু চলচ্চিত্রকে ভালোবেসে আপন করে নিয়েছিলেন। তাঁর ধ্যান, জ্ঞান, স্বপ্ন, সাধনা, মনন, পঠন-পাঠন ও যাপিত জীবনজুড়ে ছিল চলচ্চিত্র। তরুণ প্রজন্মের তিনি অনুপ্রেরণা। বাংলা চলচ্চিত্রের তারেক মাসুদ মুক্তির গান শুনিয়েছেন, কর্মের জন্য তিনি সতেজ ফুলের মতো সুগন্ধ ছড়াবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। বাংলার সত্যজিৎ তারেক মাসুদ আছেন এবং থাকবেন আমাদের চিন্তা, মনন ও হৃদয়ে।