জীবনের সমৃদ্ধি ও উৎকর্ষের জন্য চাই পাঠচক্র

শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্যান্য বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে ভৈরব বন্ধুসভা উপজেলার বিভিন্ন স্কুলে পাঠচক্রের আসর বসায়ছবি: বন্ধুসভা

পাঠচক্র কী

সপ্তাহ বা পক্ষ বা মাসের নির্ধারিত দিনে ও সময়ে সুন্দর একটি পঠিত বই কিংবা বিষয়ে একদল মানুষের উষ্ণ, উত্তপ্ত ও আনন্দমুখর আলোচনা। এই দলে ১০ থেকে শুরু করে অধিক মানুষ থাকতে পারেন। যেখানে পাঠক বা অংশগ্রহণকারীরা উদ্দীপ্তভাবে নানা দিক থেকে বইটি বা বিষয়ের ওপর আলো ফেলেন; তর্কে, বাদানুবাদে সরগরম হয়ে ওঠেন। এখানে বই নিয়ে করা পাঠচক্রের কথাই বলব। একটি রুচিশীল ও সুনির্বাচিত বইয়ের চলমান পাঠচক্র শুধু পাঠকের মনোজগতের নয়, সামগ্রিক জীবনবিকাশের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়।

পাঠচক্রের উদ্দেশ্য

প্রাথমিক ধারণায় জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার লক্ষ্য নিয়েই পাঠচক্রের শুরু হয়। অংশগ্রহণকারীরা একসঙ্গে বসে নানাবিধ বিষয়ের জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে নিজেকে আবিষ্কার করবেন। যুক্তিতর্ক হবে, জ্ঞানের আদান-প্রদান হবে। আলোচনায় পঠিত বইটির নানা উজ্জ্বল ও বলীয়ান দিকগুলোকে প্রাণবন্তভাবে তুলে ধরা। বইটির স্বপ্ন, দীপ্তি আর আনন্দের ভুবনের ভেতর নিজেদের আনন্দময় ভাব জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা এবং আরও বেশি বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করা। একজন পাঠক চিন্তাশীল ও মননশীল মানুষ। সভ্যতার পথিকৃৎ।

পাঠচক্রের মাধ্যমে অনেকগুলো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ও প্রতিভাবান মানুষের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এই কার্যক্রম আলোকিত, মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন ও কার্যকর মানুষদের শক্তিশালী ও সংঘবদ্ধ করে তোলে।

বইয়ের তালিকা তৈরি

এমন বই নির্বাচন করতে হবে; যা মানুষকে ভাবায়, তাঁকে তাঁর চেয়ে বড় করে তোলে। বই পড়ার ভেতর দিয়ে মনকে উন্নত ও ঐশ্বর্যময় করে তোলা যায়। দেশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বা লাইব্রেরিকেন্দ্রিক পাঠচক্র চালু রয়েছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বইয়ের তালিকা নেওয়া যায়। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বহু বছর ধরে নানা বিষয়ে পাঠচক্র পরিচালনা করছে। সেখান থেকে তালিকা সংগ্রহ করা যায়। বিশেষ কোনো বিষয়ে পাঠচক্র করতে চাইলে, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনা করা যায়। সারা বছরের তালিকায় নানা ধরনের বই রাখলে আরও ভালো।

চাই একজন সমন্বয়কারী বা সংগঠক

পাঠকদের পাঠের জগতে, জানার জগতের আনন্দে অংশ নিতে যিনি ডাক দিতে পারবেন, তিনিই হবেন সমন্বয়কারী। যিনি অংশগ্রহণকারীদের ভেতরের সুপ্ত প্রাণটুকু জাগানোর সক্ষমতাসম্পন্ন সংস্কৃতিমনা মানুষ। উদ্যমশীল তাঁকে হতেই হবে। না হলে ভেঙে পরবে উদ্যোগ। কোনো প্রতিষ্ঠান বা লাইব্রেরির তত্ত্বাবধানে হলেও একজন সমন্বয়কারী বা সংগঠক এর ভিত্তি।

ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার পাঠচক্র
ছবি: অদিত আল নাফিউ

কীভাবে পাঠচক্র সংগঠিত হয়

পাঠচক্র হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি। বইয়ের তালিকার ওপর ভিত্তি করে প্রথমেই তা ঠিক করে নিতে হবে; আলোচনা সাপ্তাহিক নাকি পাক্ষিক হবে। তবে সাপ্তাহিক হলে ভালো। আবার নানা কারণে প্রতি সপ্তাহে পাঠচক্র করা সম্ভব হবে না। সদস্য যাঁরা থাকবেন, তাঁরা বই কোথায় পাবেন? কারও কাছে থাকলে ভালো, আর নয়তো কিনে কিংবা কোনো লাইব্রেরি থেকে সংগ্রহ করা যায়। বই আলোচনার জন্য একটি স্থান নির্ধারণ করতে হবে। স্থানীয় পাবলিক লাইব্রেরিগুলোকে এ কাজে যুক্ত করতে পারলে ভালো হয়। কোনো ক্লাব বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্লাসরুম অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা যায়। অথবা কোনো খোলা জায়গায়ও হতে পারে।

প্রতি সপ্তাহে একটি বই পড়ে সেই বইয়ের লেখক, বিষয়বস্তু, চরিত্র, দর্শন, চেতনা নিয়ে চক্রের সবাই পর্যায়ক্রমে আলোচনা করবেন। বইটির ওপর বিশেষ দখল থাকা একজনকে মুখ্য আলোচক হিসেবে বা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির সঙ্গে পাঠচক্রের সদস্যরা নিজেদের কৌতূহলী বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলার সুযোগ পান। এতে তাঁরা আলোচক হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ পান।

সুফল ও প্রভাব

পাঠচক্রের সুবিধা হলো নিজেদের শিক্ষণীয় জ্ঞান ও ভাবনার বিষয় সবার সঙ্গে সহজেই আদান-প্রদান করা যায়। পঠিত বিষয়ের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করার ক্ষমতা তৈরি হয়। পরস্পরের মধ্যে মানসিক নৈকট্য বাড়ে। গড়ে ওঠে সমভাবাপন্নদের সংঘ। একটি পাঠচক্রের মাধ্যমে অনেকগুলো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ও প্রতিভাবান মানুষের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এই কার্যক্রম আলোকিত, মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন ও কার্যকর মানুষদের শক্তিশালী ও সংঘবদ্ধ করে তোলে।

যুগ্ম পরিচালক, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র