পাড়ভাঙা নদী

মাছ ধরা। প্রতীকীছবি: সাদ্দাম হোসেন

এক.
বেড়িবাঁধের চারকোনা পাথরের ঢালুর ওপরে কালো পলিথিনে মোড়ানো দোচালা বাসা। বাসার একপাশে শ্রীহীন জলচৌকি পাতা, অপর পাশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে বড় বড় বালতি; ঠেলা জাল, মাছের পোনা ধরার জাল, একগাদা জাল ভাসানোর পুলুট। বাতাসে চালের কালো পলিথিন পতপত করে উড়ছে। পচা মাছের গন্ধে বাসার ভেতরের বাতাস ভারী। রমজানের নাকের সঙ্গে পচা গন্ধের সখ্য গড়ে উঠেছে। অভ্যস্ত নাক এসব কিছু ঠাহর করতে পারছে না।

ছিন্নমূল রমজানদের হাতের তালুসম বাঁশের কঞ্চি আর পলিথিনে মোড়ানো বাসাটা কখনো কখনো জোয়ারের পানিতে হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যায়। নদীর বুক ছুঁয়ে আসা ঘূর্ণিবাতাস পলিথিনের ছাউনিটাকে শুকনা পাতার মতো উড়িয়ে নিয়ে যায়। রমজান ও তার বাবা কাদের কুড়িয়ে এনে আবার খুঁটির সঙ্গে গিঁট দেয়। সকাল-সন্ধ্যা পানকৌড়ির মতো পানিতে কাটে তাদের, রাতে মাথা গোঁজার জন্য বাসাটিকে সমাদর করে খুব।

দুই.
কেরোসিনের চুলার ওপরে রাখা পাতিল থেকে ঝোলে–ঝালে দুমুঠো খেয়ে লুঙ্গি গুছিয়ে ছোট ডিঙিটাকে নিয়ে রমজান চলে গেছে চওড়া নদীর ঠিক মাঝখানে। শ্যামবর্ণের কিশোর রমজান যেন ওই নদীর দক্ষ মাঝি। ইঞ্জিনচালিত ডিঙিটাকে ডিমের খোলসের মতো পানির মাথায় করে বেড়ায়। ভয়ডরের বালাই নেই, নদীর বিস্তীর্ণ জলরাশির সঙ্গে ওর যেন জন্ম–জন্মান্তরের মিত্রতা। কখনো কখনো নদীর মাঝখানে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়; রমজান দক্ষ নাবিকের মতো দাঁড় বেয়ে কূলে চলে আসে। কাদের মাঝেমধ্যে ছেলেকে নিয়ে খুবই চিন্তিত হয়। ওইটুকু একটা ছেলের এত দুরন্তপনা! কখন না জানি কী হয়!

রমজানের ছোটবেলায় কাদের মানত করে রেখেছিল, ছেলেকে পড়াশোনা করাবে। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। নদীগর্ভে পৈতৃক ভূমি বিলীন হয়ে যাওয়ায় এখন বাস্তুহারা হয়ে নদীর পাড়েই তাদের অস্থায়ী বসবাস। বছর তিনেক আগে চোখের সামনেই পিতার আমলের বাড়িটি নীরবে নেমে গেল উদ্দাম পানির সঙ্গে। সাজানো ভিটেমাটি, গাছপালার কথা মনে পড়লে কাদের এখনো বুক কিলিয়ে কান্না করে। অদৃষ্টের বিচিত্র খেলায় কাদের হারতে হারতে জীবনের কোনো সাধই মেটাতে পারেনি। একমাত্র ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করবে বলে পণ করেছিল। কিন্তু এখন সংসারের নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। দেখতে দেখতে যখন রমজানও বড় হতে লাগল, তখন কাঁধ মেলাল বাবার সঙ্গে। শুরু করল জীবনযুদ্ধ, সমানতালে টানতে লাগল সংসারে ঘানি। রমজানের বয়সের ছেলেরা লাটাই হাতে ঘুড়ি ওড়ায়, আর সে নৌকার পালের মতো সংসারযুদ্ধের জয়ধ্বনি হয়ে নিজেকে ওড়াচ্ছে বাল্যকাল থেকে।

তিন.
সকাল থেকে আকাশ ভারী। মস্ত মস্ত কুচকুচে কালো মেঘ আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। কালবৈশাখীর প্রবল আশঙ্কা। চতুর্দিকে হইহই রব পড়ে গেল। সবাই জাল গুটিয়ে কূলে চলে আসছে। তড়িঘড়ি করে রমজানের মা–বাবা গেছে পোনাজাল আর কাঁকড়ার চাঁই তুলতে। কাদের একটু দূরে নদীর মোহনায় কাঁকড়ার চাঁই ফেলেছে ভেতরে কুচিয়া মাছ দিয়ে। লাল থামের মতো তাগড়া তাগড়া পায়ের কাঁকড়া চাঁইভর্তি হয়ে কিলবিল করছে। কাদের রমজানের মায়ের কোমরে শক্ত করে বাঁধা ডুলায় সতর্কতার সঙ্গে তুলে নিচ্ছে একটা একটা করে।

রমজান নদীর নৃত্যরত ঢেউগুলো মাড়িয়ে এগিয়ে গেল সামনে। বাতাসে পানির ঢেউ ফুঁসে ফুলে উঠছে। রমজানের ডিঙিটা টলতে টলতে কোনোমতেই জাল তুলতে পারছে না। সে শক্ত করে দাঁড়িয়ে জালের সামনের দিকের মোটা দড়ি ধরে যখন টানতে শুরু করল, জালের ছিদ্র দিয়ে বাতাস অহরহ মৌমাছির মতো শোঁ–শোঁ গান শুরু করেছে। রমজান কাঠের মতো শক্ত হাতে হেঁচকা টান দিলে বাতাস একঝটকায় তাকে ফেলে দিল নদীতে। বাতাসে–ঢেউয়ে নাকানিচুবানি খাচ্ছে সে। ডিঙিটা ঢেউয়ের চোটে পিলপিল করে সরে যাচ্ছে বিপরীত দিকে। পাশের নৌকাটি এসে রমজানকে তুলে নিয়ে বাকি কাজে সাহায্য করল।

বাতাস ও ঢেউয়ের আধিপত্য কমার জন্য রমজান পাশের নৌকায় অপেক্ষা করল কিছুক্ষণ। তাদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল, যেন পূর্বপরিচিত কেউ। এ নৌকার প্রৌঢ়া তার মায়ের মতোই দেখতে, সঙ্গে গোলগাল চেহারার রূপবতী কিশোরীকেও খুব পরিচিত মনে হলো। মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নাম কী?’ সে সলজ্জ উত্তর দিল, ‘আমার নাম বানু।’ মনে মনে রমজান নামটি আওড়াতে লাগল। ঝড়ের ঝাঁজ কমলে তারা রমজানকে ফিরিয়ে দেয় নদীর ওপারে।

চার.
দুয়েক দিনের প্রবল বৃষ্টি ও ঝড়ে কেউ বের হয়নি মাছ ধরতে। নদীর পানিও অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। ঝড়ের পর যখন নদী আবারও যৌবনের কুমারিত্ব ফিরে পেল, মাঝিরা তখন গানের দোহারের মতো একই কলি ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে গাইতে গাইতে কাজ শুরু করল। কাদের ও রমজান রীতিমতো গাড়া জালের লম্বা বাঁশ, জাল ও খালি ড্রাম নিয়ে আগেভাগেই হাজির হলো নদীর ঠিক মাঝদিকটায়। বাবাকে আগেভাগেই ভুলিয়েভালিয়ে নিয়ে এসেছে। ‘বাপজান আজকে জোয়ারের পানি আগে টান দিচ্ছে, জালটা ফেলতে হবে দেরি করা যাবে না,’ বাবাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে গেলেও তখনো বানুদের নৌকা ওপার থেকে আসেনি।

যে কদিন বানুকে দেখেনি, রমজানের অস্বস্তিতে দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা। ঘুমের ঘোরে কতবার যে বানুর নাম আউড়েছে। আড়েঠারে দেখতে লাগল রমজান। সূর্যালোকে পানির চিকচিক প্রতিবিম্ব চোখে অসহ্য লাগে। কপালে ডান হাতের আঙুল ভাঁজ করে রোদের আলো ঠেকিয়ে দেখল, নৌকাটি আসার নামরেশও নেই। বাবার সঙ্গে ধরাধরি করে জাল ফেলল সে। খালি ড্রামগুলো জালের মাথায় বেঁধে দিল, সেগুলো অর্ধনিমজ্জিত হয়ে ভাটার চোটে কাঁপতে কাঁপতে জালটিকে ধরে রেখেছে।

ওদিক থেকে ধীরে ধীরে আসছে বানুদের বড় নৌকাটি। রমজান মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আশ্বস্তের মতো। বানুদের আসতে দেরি হয়েছে; ইদানীং তারা স্থানীয় লোকজনের বাধার সম্মুখীন হচ্ছে বারবার। এই নদীতে মাছ ধরে বাজারে চড়া দামে বিক্রি করলে স্থানীয়দের চক্ষুশূলের মতো বেঁধে। আজ খুব মাতামাতি হয়েছে বানুর মায়ের সঙ্গে। বানুর মায়ের ঝগড়া করার স্বভাবও পাক্কা। দরদের সময় বুকের সব মায়া ঢেলে দেয়, কিন্তু রাগের মাথায় কোমরে কাপড় গুঁজে বাতাসের সঙ্গে ঝগড়া করে।

ভ্যাজর ভ্যাজর করতে করতে ত্বরা করে জাল ফেলল। একটু দাঁড় বেয়ে রমজানের ডিঙিটা বানুদের নৌকার কাছে ভেড়াল। জাল পাহারা দিয়ে কাদের ও বানুর মা গল্প পেতে বসেছে, ‘ও বাজারে মাছের দাম চড়া, অমুক নদীতে মাছের আধিক্য, ওই ঠেলা জালের ঘের ছিঁড়ে খান খান হয়ে আছে...’ এমন কিছু গল্প।

বানুদের বসবাস নৌকাতেই হওয়ায় নৌকাটি তুলনামূলক বড়। মাঝখানে দোচালা বাড়ির মতো ছাওয়া; একপাশে বসে কাদেররা গল্প করছে, অপর পাশে পালের মোটা দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে আছে বানু। রমজান নৌকার মাথায় বসে কী যেন বলছে ওকে, সাতপাঁচ বলতে বলতে তাদের হাসির রেখা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বানুর ঠোঁট ফুলিয়ে কথা বলার ধরন দেখে মনে হয়, তারা যেন সহস্র বছরের পুরোনো সখী-সখা। অট্টহাসি, ছলচাতুরির একপর্যায়ে রমজান হাতের কোষে পানি ছুড়ে মারল বানুর দিকে। সে শিউরে উঠল। খুনসুটিমাখা মুহূর্তটি আরেকটু স্থায়ী হলো। এভাবে জলখেলায় ঝট করে সন্ধ্যা নেমে এলে যে যার মতো ব্যস্ত হয়ে জাল তোলা শুরু করল।

পাঁচ.
গর্জন দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে ঢেউগুলো তটে এসে একধাক্কায় মিশে যাচ্ছে, আবার পিলপিল করে সন্তর্পণে নেমে যাচ্ছে নদীর বুকে। ডিঙির মাথায় বসে ধলোবকের মতো করে তাকিয়ে আছে রমজান। নদীর এই সব কারসাজি দেখছে সেই ছোট্টবেলা থেকেই; তবু তার অভিনিবিষ্ট চোখে ঘোর লেগে আছে। ছোট নোঙরটি সপাত করে ছুটে মারল কাদায়। পেছনের দিক থেকে সবল একটা ধাক্কায় ডিঙির অর্ধেক তুলে ফেলল চরে। এবার খালি পায়ে হাঁটা শুরু করল চরের উন্নাসিক দূর্বাঘাস মাড়িয়ে। সূর্যালোকে রমজানের শ্যামবর্ণের গ্রীবা আরও উজ্জ্বল হয়ে চকচক করছে।

রমজান মুহূর্তেই হারিয়ে গেল শৈশবে। লাল কাঁকড়ার আলপনা দেখছে গভীর মনোযোগ দিয়ে। ওদের সঙ্গে আবারও ভাব জমাতে মন চায় রমজানের। কিন্তু ওরা রমজানকে দেখলে শিং উঁচিয়ে তীক্ষ্ণ নখের ওপর ভর করে আচানক গর্তে ঢুকে পড়ে। রমজান কিঞ্চিৎ আহত হয়। এই নদীর পাড়ে তার বিশেষ সঙ্গী নেই। জনমভর সঙ্গী হয়ে আছে পাড়ভাঙা নদীর কল্লোল, ঝোড়ো হাওয়া, বিকেলের ক্লান্ত মেঘ আর লাল কাঁকড়ার দল। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই মুখ ফিরিয়ে নিল তার থেকে। রমজানও বাবার সঙ্গে সংসার গোছাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল।

গতকাল বিকেল থেকে রমজানের ছটফটানি বেড়েছে। কী যেন অনুভব হচ্ছে ভেতরটায়; ঠিক অনুমানযোগ্যও নয়, আবার নির্লিপ্তভাবে উড়িয়ে দেওয়ার মতোও নয়। বাবার কাছে শুনেছে, বানুরা এই নদী ছেড়েছে গতকাল; স্থানীয় লোকজনের উৎপাতের কারণে অন্যত্র চলে যেতে হয়েছে তাদের।

রমজান মণিহারা সাপের মতো ভোঁ–ভোঁ করে চারদিকে খুঁজতে লাগল নৌকাটি। কোথাও দেখা মেলেনি বানুদের। হয়তো ততক্ষণে তারা পৌঁছে গেছে দূরের কোনো এক শান্ত নদীতে।

রমজান ধীরে ধীরে উপলব্ধি করছে, তার সংগ্রামমুখর জীবনের নির্দয়তার ভেতর পিণ্ডময় নমনীয়তার বসবাস। সে এখন মা–বাবা ছাড়া বিশেষ একজনের শূন্যতায়ও কাতর হয়। আত্মভোলার মতো নদীর ওপারের ধোঁয়াশার মধ্যে হারিয়ে যায়। অবিরত বয়ে আসা ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভাসে তার অবুঝ হৃদয়। রমজান জনম জনমের সঙ্গী ডিঙিটাকে নিয়ে লক্ষ্যহীন মাঝির মতো আনমনে কোথা থেকে কোথায় চলে যায়, নিজেও জানে না। মাঝেমধ্যে ফাটা বাঁশের শব্দের মতো বিশ্রী কণ্ঠে গান ধরে, ‘আমার পাড়ভাঙা এক নদী, আমি নৌকা হতাম যদি, ভাসতে ভাসতে যেতাম তোমার কাছে... ।’

বন্ধু, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা