একটি কমলালেবু এবং একমুঠো ভাতের শ্রেণিসংগ্রাম ‘একই বৃত্তে’

‘একই বৃত্তে’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যছবি: সংগৃহীত
একই বৃত্তে কত রঙের জীবন, কত ধরনের ভাঙন, কত রকমের মানুষের যে ঘোরাফেরা, জীবনের গহীনের ঢেউ, অন্ধকার, শূন্যতাও যে জীবনের এক একটা রং ক্যানভাসে তাকে ফুটিয়ে তুলে সংবেদনশীল মনের অনুভূতিতে সাড়া জাগানো যায়, একই বৃত্তের ক্ষমতার কেন্দ্রকে চিনিয়ে দেওয়া যায়—পরিচালক তা প্রমাণ করেছেন।

‘দেশশুদ্ধ লোক যতদিন খেতে পায়নি কমলালেবু— খাননি লেনিন’ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার প্রবাদের মতো সত্যি ছিল বিশ্বখ্যাত দার্শনিক লেনিনের জীবনী। পশ্চিমবঙ্গের অন্য এক বামপন্থী কবি জয়দেব বসু ছোটদের জন্য লেনিনের জীবনীগ্রন্থের সূচনাপত্রে ওপরের অংশটুকু আবার উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন। ধনী-গরিব, জমিদার-প্রজা, শাসক-শোষিত সেই আদি-অন্ত কালের চিরাচরিত শ্রেণি বৈষম্যের ওপরে কাজী মোরশেদের রচনায় নির্মিত চলচ্চিত্রে এই কমলালেবু আবার আক্ষরিক অর্থে গল্পের চাবিকাঠি হয়ে উঠল। নিজের কাহিনি, চিত্রনাট্য, পরিচালনায় অনবদ্য চলচ্চিত্রায়ণ করেছেন কিংবদন্তি পরিচালক কাজী মোরশেদ। চলচ্চিত্রের নাম ‘একই বৃত্তে’।

মূলত তৃতীয় বিশ্বের একই বৃত্তের সব মানুষের মন এবং জীবন ভাঙাগড়ার গল্প। একটা কমলালেবু আর এক মুঠো ভাতের জন্য যে শোষিত মানুষের জীবন, পচা গলা সমাজের আবর্তে চরকির মতো পাক খায়। আর ভাত ছড়িয়ে কাক পোষা শাসকের চরিত্র চিরকাল একই থেকে যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শাসকের রূপ বদলায় মাত্র।

কৌশলে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ করে দিয়ে ইংরেজরা চলে গেছে। এই ইংরেজরা নিজেদের সুবিধামতো অখণ্ড ভারতবর্ষে সৃষ্টি করেছিল জমিদারি প্রথা। জমিদাররা প্রজাদের ওপর অত্যাচার করে খাজনা, কর আদায় করবে, জমিদারদের থেকে ভাগ নিয়ে বহাল তবিয়তে চলবে ভিন দেশে এসে ছড়ি ঘোরানো ব্রিটিশ রাষ্ট্রব্যবস্থা। ১৯০ বছর ধরে শাসন করা অত্যাচারী ইংরেজদের চরিত্র আর তাদের অনুকূলে থাকা দেশীয় জমিদারদের চরিত্র প্রায় একই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান দেশভাগের পরে, ১৯৫০ সালে এসে প্রজাসত্ত্ব আইনের মাধ্যমে চিরতরে বিলুপ্ত হয় জমিদারি প্রথা। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও জমিদাররা বিলুপ্ত হয়নি। তাঁরা নিজেদের চাল-চলন, আচার-আচরণ, সনাতনী মূল্যবোধ আভিজাত্য—কিছুই ত্যাগ করতে পারেননি। ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও নিজের ভেতরে বাইরে ভাঙতে ভাঙতেও মচকাতে চাননি। ১৯৫৮ সালে তেমনই একজন জমিদারের চরিত্র, জমিদার বাড়ির অন্দরমহল নিয়ে এই কাহিনি বিশ্লেষিত হয়।

ফুলজান নামের একজন দাসী হলো গল্পের শোষিত শ্রেণির চরিত্র। মাঝেমধ্যে ফুলজানের ভোররাতের স্বপ্নে ভেসে আসে, অজানার উদ্দেশে রেললাইন ধরে সন্তান দুলালকে নিয়ে সে তাজুর সঙ্গে হিজলতলি গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছে। দুলালের মাথায় একটা কাপড়ের পুটলি, তাজুর মাথায় তোরঙ্গ। জমিদারবাড়ির বেগম সাহেবার দেখাশোনা করে সে। নিজের স্বপ্নের কথা একদিন ভাসা ভাসা কথার চলে বেগম সাহেবাকে বলে। ভোররাতের স্বপ্ন বাস্তবে পূরণ হয় কি হয় না, তা নিয়ে তখনো অবশ্য দুজনই সংশয়ে। তবে গল্পের পরিণতিতে এসে আমরা দেখি, এই স্বপ্ন দৃশ্য দিয়ে আবার চলচ্চিত্রের শেষ হচ্ছে।

ফুলজানের স্বামী নেই, সন্তান আছে। বাড়িতে বৃদ্ধ একসময়ের ফলব্যবসায়ী বাবা আছে। এখন তিনি রোগব্যাধিতে জর্জরিত মরণাপন্ন অবস্থায়। তাজু হলো হিজলতলির জমিদারের সর্বক্ষণের দেখাশোনা পরিচর্যার লোক। জমিদারের অন্য এক কর্মচারীর সংলাপের মধ্য দিয়ে এই তাজু চরিত্র নিয়ে অন্যরকম একটা ইঙ্গিতও অবশ্য ভেসে আসে। সে জমিদার বাড়ির পূর্বতন বাঁদির পুত্র। তাকে দেখতে এখন অনেকটা পূর্বতন জমিদারের মতো হয়েছে।

বেগম সাহেবার দেখাশোনা করা বান্দি ফুলজানের সঙ্গে, জমিদারের দেখাশোনা করা এই বান্দা তাজুর এখন আবার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। দুজনে লোকচক্ষুর আড়ালে আবডালে দিনে রাতে একে অন্যের সঙ্গে দেখা করে। ফুলজান তাকে জমিদারের অল্প খাওয়া দুধের গ্লাসটা ধরিয়ে দেয়। কখনো পাতায় মুড়ে ছানা এনে খেতে দেয়। দুজন দুজনকে খুবই ভালোবাসে। একসঙ্গে ঘর বাঁধতে চায়। কিন্তু সারাক্ষণ জমিদারের খেদমত খাটা তাজুর চরিত্র যেন কিছুতেই বিকশিত হওয়ার নয়। জমিদারের পা গা টিপে দেওয়া, লাথি খাওয়া এই মানুষ এসবের বাইরে নিজের দুনিয়া চেনে না। ফুলজানের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে জমিদারের চোখে ধরা পড়ে একদিন বেধড়ক মার খায়। ফুলজান পরম আদর ভালোবাসায়, কখনো তীব্র কটাক্ষ বাণে বিদ্ধ করে তাকে মানুষ করে তুলতে চায়।

‘একই বৃত্তে’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য
ছবি: সংগৃহীত
কাজী মোরশেদের মতো জহুরীরা প্রকৃত জহর চেনেন বলেই চরিত্র অনুযায়ী বহুমাত্রিক শিল্পীদের বেছে নিয়েছেন।

এলবার্ট খানের ক্যামেরায় এই ছবির দৃশ্য ধারণ অসম্ভব সুন্দর। পরিচালকের বোনা দৃশ্য সুন্দর সম্পাদনায় সাজিয়েছেন আমজাদ খান। কিংবদন্তি পরিচালক আমজাদ খানের সহকারী হিসেবে একসময় কাজ করতেন চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান কাজী মোরশেদ। বেঁচে থাকলে আরও অনেক গভীর সমাজমনস্ক চিন্তাশীল কর্মধারায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রজগৎকে সমৃদ্ধ করতে পারতেন। ফুলজান চরিত্রে নাজনীন হাসান চুমকি বাংলাদেশের বিকশিত ফুল হয়ে সৌন্দর্যবর্ধন করেছেন। এমন দক্ষ শিল্পী না থাকলে ফুলজান চরিত্রের গভীরতা প্রকাশিত হতো না। এই গ্রাম্য কন্যার সন্তানের প্রতি স্নেহ, মমতা, পড়শির কটাক্ষে জেদ, পরকীয়া প্রেম–প্রণয় দৃশ্য, ধর্ষিতা নারীর আর্তনাদ, পিতৃহারা কান্না—সবই উজ্জ্বল দীপ্তিতে প্রতিভাষিত হয়েছে।

বারবার ফুলজানকে বিয়ে করার কথা বলা, বৃদ্ধ বাবার কাছেও সম্বন্ধ নিয়ে যাওয়া গ্রামের কূটনি বুড়ি একসময় ফুলজানের মুখ ঝামটায় রেগে গিয়ে বলে উঠে, ‘পুরুষের জেদে বাদশা নারীর জেদে বেশ্যা’। এই সংলাপ থেকেও চিরাচরিত সমাজব্যবস্থার ছবি উঠে আসে। ফুলজানের ছেলের চরিত্রে শিশু শিল্পী স্বচ্ছ, একেবারে যেন সত্যজিৎ রায়ের দ্বিতীয় অপু। তার বাবার জন্য পথ চেয়ে থাকার সেই দৃষ্টি কিছুতেই ভোলা যায় না। দাদুর সঙ্গে খুনসুটি, মায়ের কাছে আবদার, স্কুলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ছড়া শুনে মগ্ন মুগ্ধ দাঁড়িয়ে পড়া, জমিদার গিন্নির বয়াম থেকে বাতাসা লেবেঞ্চুস চেয়ে খাওয়া—এই দৃশ্যগুলো অসাধারণ। অশক্ত মৃতপ্রায় দাদুর চরিত্রে রাইসুল ইসলাম আসাদ তো কিংবদন্তি শিল্পীর জাত চিনিয়ে দিয়েছেন। জমিদারের পেয়াদার হুকুম অমান্য করার কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে নাতিকে নিয়ে বৃদ্ধ কমলালেবুর সন্ধানে বেরিয়েছিলেন। দীর্ঘপথ চলার সেই যন্ত্রণা সবাইকে দগ্ধ করে। একসময় পূর্বের চেনা বাড়ি থেকে অনেক কাকুতি মিনতি করে বীজ ফল জোগাড় হয়। জমিদার বাড়িতে সেই ফল পৌঁছে যায়। সেই ফল হাতে তুলে দেওয়ার নাম করে জমিদার নির্জন ঘরে নিয়ে গিয়ে ফুলজানকে ধর্ষণ করে। বীজফল কমলালেবুটিও একইসঙ্গে বহুমাতৃক চিত্রকল্পের রূপক হয়ে ওঠে।

জমিদারের রক্তে যে কী রকম সাংঘাতিক নরখাদক চরিত্র বিরাজ করে! সেই দম্ভ, সেই অহংকার, সেই ভোগ বিলাসিতার স্বভাব কিংবদন্তি অভিনেতা খলিলউল্লাহ খানের অভিনয়ে অক্ষরে অক্ষরে তা পরিস্ফুটিত হয়েছে। আবার এই জমিদারের ক্ষমতা হারানোর ভাঙন, সেই শূন্যতা গ্রাস মনোবিকলন এসবও খলিল আপন শিল্পীসত্তায় অনবদ্য রূপ দিয়েছেন। জমিদার গিন্নির চরিত্রে ডলি জহুরের অভিনয়ও মনে রাখার মতো। কাজী মোরশেদের মতো জহুরীরা প্রকৃত জহর চেনেন বলেই চরিত্র অনুযায়ী বহুমাত্রিক শিল্পীদের বেছে নিয়েছেন। তাজু চরিত্রে অভিনেতা, পরিচালক তৌকির আহমেদ যেমন বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন, প্রকৃত সৃষ্টিশীল শিল্পী ছাড়া এ ধরনের মননশীল গল্পের প্রকৃত অনুরণন ছড়ানো সম্ভব নয়। জমিদারের পা টিপতে টিপতে সারাজীবন পদদলিত হতে হতে সে কিন্তু চাটুকার হয়ে যায়নি। প্রিয়জনকে ধর্ষিতা হতে দেখে একসময় ফুসে উঠেছে। বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে জমিদারকে।

একই বৃত্তে কত রঙের জীবন, কত ধরনের ভাঙন, কত রকমের মানুষের যে ঘোরাফেরা, জীবনের গহীনের ঢেউ, অন্ধকার, শূন্যতাও যে জীবনের এক একটা রং ক্যানভাসে তাকে ফুটিয়ে তুলে সংবেদনশীল মনের অনুভূতিতে সাড়া জাগানো যায়, একই বৃত্তের ক্ষমতার কেন্দ্রকে চিনিয়ে দেওয়া যায়—পরিচালক তা প্রমাণ করেছেন। প্রমাণ করেছেন জীবনের অন্তর্নিহিত শূন্যতা, যন্ত্রণা, বিষাদ, ক্রন্দন তুলে আনতে পারা ছাড়া মহৎ সৃষ্টি হয় না। একমুঠো আর একটা কমলালেবুর জন্য কালের বোঝা পিঠে মানুষের যাত্রা অনন্তকালের। ভোগবাদী সমাজে শাসক যেখানে ভগবান, জমিদারের ক্ষমতা হারিয়ে গেলেও রাষ্ট্র সেখানে প্রভু হয়ে ওঠে। এই প্রভুত্ববাদের সঙ্গে লড়াই করে মুক্তির পথ খুঁজে নিতে হবে মানুষকেই। ফুলজানদের সুন্দর জীবনে বেঁচে থাকার স্বপ্ন, বেঁচে থাকার যাত্রাপথ সুদূরের পানে ছড়িয়ে দিয়ে পরিচালক নতুন দিনের দিগন্তকে প্রসারিত করে দেন। পৃথিবীটা কমলালেবুর মতো, মানবজমিন চাষ করে রস আস্বাদনের তরে মানুষকে বেঁচে থাকতে হবে। ক্ষুদ্র মানুষ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারলেই বৃহতের ছায়াও ধীরে ধীরে নুইয়ে আসবে। এভাবেই একদিন একই বৃত্তে সবাই মিলে প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠবে। প্রকৃত মানবতার জয়গান ছড়িয়ে পড়বে দিকে দিকে।

এই ছবিতে অনন্য একটিই গান এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠে, ‘গনগনে আকাশ, বাতাস ছন্নছাড়া/ নিভু নিভু দুটি চোখ, যেন জ্বলন্ত দুটি তারা’— প্রকৃত অর্থেই এসব জীবনেরই দ্যোতক।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত