তরুণ প্রজন্মের পিছিয়ে পড়া দেশের জন্য অশনিসংকেত

স্মার্টফোনে আসক্তি মস্তিস্কের সক্ষমতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছবি: সংগৃহীত

জনশুমারি ও গৃহগণনার চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় পৌনে পাঁচ কোটি তরুণের বসবাস। যা দেশের বর্তমান জনসংখ্যার প্রায় চার ভাগের একভাগ। সাধারণত শৈশব এবং প্রাপ্তবয়স্কের মাঝামাঝি সময়টিতে যাঁরা অবস্থান করেন, তাঁদেরই আমরা তরুণ হিসেবে বিবেচনা করি। সে হিসেবে যাঁদের বয়স ১৫-২৯, তাঁরাই তরুণ প্রজন্ম। এ বয়স বড়ই বিচিত্র, বিস্ময়কর। এ বয়সে থাকে না কোনো ভয়, পিছুটান। এ বয়স শুধু জানে এগিয়ে যেতে, মাথা উঁচু করে বাঁচার লড়াইয়ে জয়ী হতে।

বর্তমান পৃথিবীতে যত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটছে, যত ইতিহাস রচিত হয়েছে; সেসবের পেছনে কোথাও না কোথাও তারুণ্য রয়েছে। সমাজ সংস্কার থেকে শুরু করে বিজ্ঞান, রাজনীতি, দর্শন, চিকিত্সা, যুদ্ধসহ সব ক্ষেত্রেই তারুণ্য তাঁদের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই সম্রাট আকবর তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দ্বারা ভারতবর্ষকে একটি আধুনিক বৃহত্তর রাষ্ট্রের মর্যাদা এনে দেন। কুরাইশদের মধ্যে শান্তি স্থাপন করতে হযরত মুহম্মদ (সা.) মাত্র ২০ বছর বয়সেই তরুণদের নিয়ে গড়ে তোলেন ‘হিলফুল ফুজুল’। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার দেশমাতৃকার প্রেমে নিজের জীবনটাই উৎসর্গ করে দেন। আবার গ্রিক বীর আলেকজান্ডার মাত্র ২৩ বছর বয়সেই জয় করে নেন অর্ধেক পৃথিবী। এরকম হাজারো উদাহরণ প্রমাণ করে যে তরুণ প্রজন্ম বা তারুণ্য একটি দেশের জন্য শুধু গুরুত্বপূর্ণই নয়, বরং একটি দেশের মেরুদণ্ডও বটে।

বর্তমান কিশোর-তরুণদের মধ্যে গ্যাং সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। এটা ক্ষতিকর।
প্রতীকী

পূর্বপুরুষদের সূত্র ধরে, বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক পৃথিবীর তরুণ সমাজও পিছিয়ে নেই। প্রযুক্তির সহায়তায় একদিকে যেমন অনেকেই বদলে দিতে চাইছেন দেশ, সমাজ; আবার সেই একই প্রযুক্তির সহায়তায় তারুণ্য অতি সহজেই এখন পৌঁছে যেতে চায় সফলতার শীর্ষে, হতে চায় রাতারাতি সেলিব্রেটি। অত্যন্ত নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে এটা বলতেই হয় যে এসব রাতারাতি সেলিব্রেটি বনে যাওয়া তরুণদের সংখ্যাই সমাজে সবচেয়ে বেশি। তাঁদের না আছে কোনো বাস্তবিক জ্ঞান, না আছে দেশ এবং সমাজ নিয়ে চিন্তা। তাঁদের সম্বল একটাই, সেটা হলো লাইক, ফলোয়ার এবং ভিউ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ে সময় নষ্ট করার চাইতে তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশই এখন একজন ইউটিউব সেলিব্রেটির ভিডিও দেখে সময় পার করাকে খুব বেশি যৌক্তিক মনে করে। আবার তরুণদের একটা অংশ তাঁদেরকে আদর্শ হিসেবে ভাবছে। ফলে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো থেকে ধীরে ধীরে নিজেদের অজান্তেই দূরে সড়ে যাচ্ছে প্রজন্ম। সৃজনশীল চিন্তার ক্ষমতাকে করছে সংকুচিত এবং পড়াশোনায় মনোযোগী না হয়ে ঝুঁকে পড়ছে রাতারাতি অর্থ উপার্জন ও ভাইরাল হওয়ার দিকে। এখনই যদি সচেতন না হওয়া যায়, তাহলে আগামীতে আমরা মানসিকভাবে ভঙ্গুর একটি তরুণ প্রজন্ম পেতে যাচ্ছি।

এ ক্ষেত্রে মিডিয়াগুলোও অবদান রাখতে পারছে না। উল্টো তাঁরাই ভিউ পাবার আশায় তাঁদের পেছনে ক্যামেরা নিয়ে ছুটছে। একটি ঘটনা শেষ না হতেই আরেকটি নতুন ঘটনার জন্ম হচ্ছে। যা সত্যিই একটি দেশের জন্য অশনিসংকেত।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সামাজিক এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? অবশ্যই পারিবারিক সচেতনতা। কেননা একটি শিশুর জীবনে প্রথম স্কুল তার পরিবার। পরিবার থেকে সে যে ধরনের শিক্ষা অর্জন করে, পরবর্তী জীবনে সে তা সব ক্ষেত্রেই মেনে চলে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও এ সমস্যা ও সমাধান নিয়ে কাজ করতে হবে। দেশীয় সংস্কৃতি ভুলে তরুণ প্রজন্ম যাতে বিপথে পা না বাড়ায়, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো একটা সুন্দর স্থিতিশীল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ গড়ে তোলা। যে পরিবেশে আমাদের তরুণেরা নিজেদের মতামত কোনো ধরনের ভয়ভীতি ছাড়াই প্রকাশ করতে পারবে।

একসময় বিকেলবেলা গ্রামের স্কুলমাঠে ফুটবল, ক্রিকেটসহ বিভিন্ন শারীরিক কসরতের খেলা হতো। এখনকার কিশোরেরা সেই মাঠে বসেই এসব খেলার পরিবর্তে খেলছে ফ্রি ফায়ার, পাবজির মতো সব মোবাইল গেম। ছবিটি কুষ্টিয়ার কন্দর্পদিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠ থেকে তোলা
ছবি: অনিল মো. মোমিন

বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার (বিওয়াইএলসি) ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিস অ্যান্ড জাস্টিস সেন্টারের ‘ইয়ুথ ম্যাটার্স সার্ভে-২০২৩’ জরিপে দেখা গেছে, ৭১ দশমিক ৫ শতাংশ তরুণ জনপরিসরে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশকে নিরাপদ মনে করেন না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে ১৬-৩৫ বছর বয়সীদের মধ্যে এ জরিপ চালানো হয়। এ যখন পরিস্থিতি তখন এটা হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে তরুণ প্রজন্ম মতামত প্রকাশ করা বা ভিন্ন কিছু করে ঝামেলায় পড়ার চাইতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব সেলিব্রেটিদের নিয়েই পড়ে থাকবে। সহজে পরিশ্রম ছাড়াই ক্যামেরা অন করে ভাইরাল হওয়ার স্বপ্ন দেখবে।

যাই হোক, তরুণেরাই আগামীর ভবিষ্যতৎ। সুতরাং তারুণ্য বিপথে গেলে, একটি রাষ্ট্র কিংবা দেশ পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার শঙ্কাও থাকে। সে দিক বিবেচনায় আমাদের এখনই উচিত নৈতিক শিক্ষায় জোর দেওয়া, স্বশিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরা, রাজনীতিকে স্থিতিশীল করা, শিক্ষা ও গবেষণায় জোড় দেওয়া এবং বই পড়তে ও ভালো কিছু গ্রহণ করতে তরুদের উত্সাহ দেওয়া। তরুণেরা যত ইতিবাচক পরিবেশ পাবেন এবং মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারবেন; তত তাঁরা এসব মরীচিকা হতে মুখ ঘুরিয়ে নিবে।

শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা