সীমাহীন দারিদ্র্যের চিত্রভাষ্য শেখ নিয়ামত আলীর ‘অন্য জীবন’

‘অন্য জীবন’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যসংগৃহীত

সীমাহীন দারিদ্র্যের অনবদ্য চিত্রভাষ্য নির্মাণ করেন শেখ নিয়ামত আলী। দরিদ্র জীবনের অসহনীয় যন্ত্রণা তিলে তিলে মানুষকে জ্বালিয়ে–পুড়িয়ে মারে। শেষ করে দেয়। পৃথিবীতে কিছু মানুষ মুখে সোনার চামচ নিয়ে জন্ম নেয়। আর কিছু মানুষ কুকুর-বিড়ালের মতো পথেঘাটে ঘুরে বেড়ায়। দারিদ্র্য কাউকে মহান করে না। কিন্তু দরিদ্র মানুষের সমব্যথী, সহমর্মী হয়ে সেই জীবনের ছবি এঁকে, কবিতা লিখে, চলচ্চিত্র নির্মাণ করে সৃষ্টিশীল মানুষ অবশ্যই মহান হয়ে ওঠেন। কারণ, দুঃখের তিমির রাত্রির প্রদীপ জ্বেলে তিনি সংবেদনশীল প্রত্যেক মানুষের বুকে ব্যথা জাগাতে পারেন, চোখে জল নিয়ে আসতে পারেন। আবার সীমাহীন দরিদ্র জীবনের যন্ত্রণা থেকেও কালে কালে অনেক জীবনপোড়া সৃষ্টিশীল মানুষেরা উঠে আসেন।

শেখ নিয়ামত আলীর দুঃখের চলচ্চিত্রায়ণে দরিদ্র, পীড়িত, ছিন্নমূল মানুষের ছবি নিপুণভাবে উঠে আসে। নিয়ামত আলী নিজেও একজন ছিন্নমূল মানুষ ছিলেন। আদি ভিটা বাংলাদেশে হলেও তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা পশ্চিমবঙ্গে। দেশভাগ নামের মানুষ ভাগের বিভীষিকা জন্ম শিকড় এবং শিকড়ের মাটি ছেড়ে তাঁকেও ছিন্নমূল করেছে। সৃষ্টিশীল মানুষের মধ্যে সারাটা জীবন এই ব্যথা থেকে যায়।

ক্ষমতাশালী পুঁজিপতিদের সঙ্গে সর্বহারা বঞ্চিত মানুষেরা কবে আর পেরে উঠেছে? বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়ে গেলেই কেউ শুধু ছিন্নমূল হয় না।

তবে এ কথা সত্য, আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে হাসান আজিজুল হক বা নিয়ামত আলীর মতো খুব সামান্য কিছু মানুষ ছাড়া দেশভাগের ছিন্নমূল মানুষের যন্ত্রণার কথা তেমন কারও সৃষ্টিতে উঠে আসেনি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বা যন্ত্রণার কথা লিখতে গিয়ে অনেকে উদ্বাস্তুদের স্মরণ করেছেন নামমাত্র। বাংলাদেশ থেকে দলে দলে ছিন্নমূল হয়ে যাঁরা ভারতে এসেছেন, চরম দরিদ্র জীবনের সঙ্গে লড়াই করতে করতে অনেকেই হেরে গিয়েছেন। নিজের পায়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারা দূরে থাক, বেঁচে থাকার ন্যূনতম চাহিদাটুকুও কোনো দিন মেটেনি।

শেখ নিয়ামত আলীর ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ চলচ্চিত্র নিয়ে যখন লিখেছিলাম, ছবির মধ্যে কিংবদন্তি সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালকের ছায়া খুঁজে পাওয়ার কথা উল্লেখ করেছিলাম। ‘অন্য জীবন’ চলচ্চিত্র দেখতে গিয়ে মনে হলো এই মানুষটির মধ্যে শুধু একজন সত্যজিৎ রায় ছিলেন না, একজন মৃণাল সেন ও ঋত্বিক ঘটককেও নিজের জীবন-জারিত দংশনে বহন করে গিয়েছেন আজীবন। সর্বহারা, ছিন্নমূল মানুষের ছবি তুলে ধরতে গিয়ে এভাবেই সব জীবন পোড়া স্রষ্টারা কোথাও একটা জায়গায় এসে এভাবেই যেন এক হয়ে মিলে যান। প্রত্যেক মানুষ নিজের সৃষ্টিশীল চলার পথ জীবনের চরম লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে হেরে যেতে যেতে, বেঁচে ফিরে তৈরি করেছেন। ব্যক্তিজীবনের লড়াই পরবর্তী সময়ে সমষ্টির চেতনা হয়েছে।

এই ‘অন্য জীবন’ বা যে জীবনকে সচরাচর আমাদের যান্ত্রিক গতিশীল মানুষের জীবন চেনে না, একেবারে শেষ দৃশ্যে এসে দেখছি অন্য পৃথিবীর মানুষের জীবনের আপসহীন শেষ লড়াকু মানুষটিও নিজের ছোট্ট সন্তানসহ পরিবার নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে। গ্রামে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে। কাঁধে তার সর্বহারা ছিন্নমূল মানুষের কালের বোঝা। এই বোঝা বয়ে বেড়ানোর শব্দ স্পষ্ট কানে ভেসে আসছে। এই শব্দ ইঙ্গিতবাহী, ইতিহাসের দিকনির্দেশক। কোথায় সে যাবে? কোথায় গিয়ে আশ্রয় পাবে? আদৌ খাবার জুটবে? আদৌ তারা বেঁচে থাকবে? স্পষ্ট কোনো উত্তর পরিচালক নিজেও দিতে পারেননি। শুধু মানুষের দরবারে মানুষের জন্য প্রশ্ন রেখে গিয়েছেন মাত্র। দলে দলে গ্রামের অনেকেই যেভাবে নিরুদ্দেশে পাড়ি দিচ্ছে, গ্রাম উজাড় হয়ে যাচ্ছে; আলী নামের চরিত্রটিও সেভাবেই লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে নতুন করে বাঁচার সংগ্রাম শুরু করার জন্য আহত-পরাহত জীবনের শেষ থেকে শুরুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের অনেক মানুষ না খেতে পেয়ে মারা গেছে, ভাতের জন্য গলায় দড়ি দিয়েছে, শোষকের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে নিহত হয়েছে; এটাই ছিল তখনকার অনির্বচনীয় সত্য।

গ্রামের তাঁতিগোষ্ঠীর লড়াকু নেতা যে আলী গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছে, পালিয়ে বাঁচতে চাওয়ার মতো মানুষ কিন্তু সে ছিল না। নিজের মাটি আঁকড়ে বেঁচে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। চলচ্চিত্রের একেবারে শুরুতে আলীর স্ত্রীর মুখের সংলাপ শুনে বোঝা যায়, ভোররাতে উঠে আলী কচু তুলতে গেছে। ঘরে একমুঠো চাল না থাকাতে শাপলা ফুলের ডাঁটা সেদ্ধ করেও এই মানুষেরা খায়। ঘরে একমুঠো পান্তা ছিল, আলীর বউ সন্তানকে তা খেতে দেয়। আলীর বৃদ্ধ বাবা তাঁত চালায়। এতটাই রোগা জীর্ণ–শীর্ণ বৃদ্ধ মানুষ, বুকের হাড়গুলোও উঠে এসেছে তার। চরিত্র নির্বাচনেও যে পরিচালক কতটা দক্ষ, এই বৃদ্ধ অভিনেতাকে দেখে তা বোঝা যায়।

কচু কাঁধে আলী বাড়ি ফেরে। সেগুলো ছেঁটে নিয়ে কিছু বাড়িতে রান্নার করার জন্য রাখে। বেশির ভাগটা পুনরায় কাঁধে নিয়ে বোঁচকাতে বউয়ের দেওয়া ছয়টা লুঙ্গি, তিনটা গামছাসহ হাটের পথে রওনা দেয়। বউ তাকে খেতে দিতেও পারে না। ঘরে কোনো খাবার নেই। আবার যে তাঁতি কাপড় বিক্রি করে, সে কচুও বিক্রি করে। কারণ, সামান্য কাপড় বিক্রি করে সংসার চলে না। বেশি কাপড় বোনার মতো ক্ষমতাও তাদের নেই। গ্রামে সুতার বড় অভাব, আকাল চলছে। সরকারি সুতার পারমিটও কেউ সহজে পায় না। রাজনৈতিক নেতা আর ক্ষমতাশালী লোকেরা সরকারি সুতা পারমিট নিজেদের হাতে রেখে দেয়। তাঁতিগোষ্ঠীর জীবনে এই সুতা সংগ্রহ করাটাই বড় একটা সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। তাঁতি মাত্রই শিল্পী, কিন্তু শিল্পের রসদ ছাড়া শিল্প বাঁচবে কী করে? পরিচালক এভাবেই হতদরিদ্র মানুষদের জীবনশিল্পী করে গড়ে তোলেন।

নিজেকে ব্রিটিশ আমলের রাজনীতিবীদ দাবি করা এই অঞ্চলের নেতা পান্ডব ভাই পুরোনো দল ছেড়ে নতুন দল গড়ে কলম মার্কা নিয়ে গ্রামের চেয়ারম্যান পদে ভোটে দাঁড়ায়। জনসভায় ঘোষণা করে গ্রামে প্রাইমারি স্কুল তৈরি করবে, রাস্তাঘাট মেরামত করে দেবে এবং অবশ্যই তাঁতিদের সুতার পারমিট দেওয়ার কাজ করবে। গ্রামের অবহেলিত বঞ্চিত কৃষক, জেলে, মুচি সবার পাশে সে থাকবে। আলীর মতো ঘর পোড়া মানুষেরা এই ধূর্ত রাজনীতিবিদের কথায় বিশ্বাস করে না। নিজের ক্ষমতার স্বার্থে রং বদলকারী, দল পাল্টানো রাজনীতির লোকেরা যে বহুকাল আগে থেকেই বঙ্গ সমাজে ছিল, সেই ইতিহাসও এখানে উঠে আসে। এ ধরনের বদমাইশের বিরুদ্ধে যাওয়ার কারণে ভোটের আগেই বিদ্রোহী নেতা আলীর সহযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়। আর ভোটপর্ব মিটে যাওয়ার পরেই বেরিয়ে আসে ক্ষমতার আসল রূপ। তাঁতিদের সুতা না দিয়ে চেয়ারম্যান নিজেই বস্ত্র কারখানা খুলে বসে। সেখানে নিজের অনুগামীদের কাজ দেয়। বিদ্রোহীদের রুটিরোজগারের সব পথ বন্ধ করে দেয়। এই লড়াই শুধু ক্ষুদ্র শিল্পের সঙ্গে বৃহৎ শিল্পের লড়াই নয়, পুঁজিবাদী পুঁজিপতিদের সঙ্গে সর্বহারাদের লড়াইয়ে পরিণত হয়। অথচ সরকারি সুতা বণ্টন ব্যবস্থা হওয়ার কথা ছিল গ্রামের প্রত্যেক মানুষের অধিকার।

ক্ষমতাশালী পুঁজিপতিদের সঙ্গে সর্বহারা বঞ্চিত মানুষেরা কবে আর পেরে উঠেছে? বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়ে গেলেই কেউ শুধু ছিন্নমূল হয় না। দেশের মধ্যেই অগণিত ছিন্নমুকুল, সর্বহারা মানুষের বাস। আসল হলো, আজকের এই রাষ্ট্রব্যবস্থা শুধু কিছু পুঁজিবাদীদের সাজানো কাঠামো মাত্র। হতদরিদ্রদের কোনো গ্রাম, দেশ বা রাষ্ট্র নেই। গরিবেরা সব খানেই শোষিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত। পরিচালক সেই সত্যই পুনরায় তুলে আনেন।

শেখ নিয়ামত আলীর সংলাপ, চিত্রনাট্যর সঙ্গে আনোয়ার হোসেনের চিত্রগ্রহণ এবং আতিকুর রহমানের সম্পাদনাও এই ছবিকে মহাকাল জয়ের পথে নিয়ে এসেছে। প্রতিটি দৃশ্য যেন চলন্ত ক্যানভাসে আঁকা ছবি। হৃদয়ে দাগ কেটে যায়। আমানুল হকের সুর সংযোজন ছবিকে দিয়েছে উচ্চমার্গের আসন। রাইসুল ইসলাম আসাদ, চম্পা, শান্তা ইসলাম, আবুল খায়ের, সাইফুদ্দিন, তন্ময়, চিত্রলেখা গুহ, তমালিকা কর্মকার—সবার অভিনয় মনে রাখার মতো।

সাদা-কালো যুগের নান্দনিক এই ছবি প্রকৃতই অন্য জগৎ এবং জীবনের ছায়াছবি। মায়া জড়ানো এই চলচ্চিত্র আমাদের ভিন্ন একটা ভুবনে নিয়ে যায়।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত