জয়িতা

জয়িতাপ্রথম আলো

শিশুকাল থেকে রায়নার ছিল এক স্বপ্নময়ী মন। কেন যেন সে নিজেকে ভবিষ্যৎ এক চাকরিজীবী নারী হিসেবে কল্পনা করত। তার মনে হতো সে বড় হয়ে নিজে আয় করে স্বাবলম্বী হবে। নিজের একটা পরিচয় তৈরি করবে। সে জন্য নিয়মিত স্কুলে যেত, পড়াশোনায় বেশ মনোযোগী ছিল। কিন্তু তখনকার দিনে মেয়েদের জন্য এটা মোটেও সহজ ছিল না। নিজ গাঁয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও উচ্চবিদ্যালয় ছিল না। প্রতিদিন এক মাইল পথ পায়ে হেঁটে উচ্চবিদ্যালয়ে যেতে হতো। টেলিভিশন ছিল না। রেডিও ছিল বিনোদন ও জ্ঞান আহরণের একমাত্র মাধ্যম।

বড়দের সঙ্গে বসে ভয়েস অব আমেরিকার খবর শুনত রায়না। রেডিওতে বিভিন্ন তথ্যমূলক আলোচনা অনুষ্ঠান শুনত। কোনো এক অজানা শক্তি তার মনের মধ্যে বুনে দিয়েছিল অদম্য আগ্রহ ও অনুপ্রেরণা। রেডিওর বিশ্ববিচিত্রা অনুষ্ঠান তাকে টেনে নিয়ে যেত স্বপ্নময় জগতে। ছোট্ট রায়নার খাওয়ার প্রতি তেমন আগ্রহ ছিল না। পুতুল খেলা, বই পড়া, সেলাই করা আর বিভিন্ন নতুনত্বে যত আনন্দ। সবার কাছে সে ছিল লক্ষ্মী মেয়ে।

মায়ের কোলে আসা নবজাতকদের সে লালনপালন করত নিজ সন্তানের মতো। শিশুদের ভালোবাসত বড্ড বেশি। সে সংসারের বড় কন্যা। একদিন রায়না গায়ে পায়ে বড় হয়ে উঠল। সাদা মনের মানুষ সে। তার সরলতা ছু্ঁয়েছে অনেকের মন। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সবাই তাকে খুব ভালোবাসত। প্রতিভার প্রশংসা করত।

অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা থাকা সত্ত্বেও মেধাবী রায়না লেখাপড়ায় এসএসসির ওপরে আর যেতে পারল না। সোজা গেল স্বামীর ঘরে। স্বপ্নময় সেই জগৎ পরের ঘর যার নাম। সে এক দুর্বিষহ রাজ্য। ধীরে ধীরে পৃথিবীর সব বাস্তবতা তার সামনে ফুটে উঠতে থাকে। পুতুল ভালোবাসা রায়না নামের সেই আদুরে মেয়েটা একসময় হয়ে উঠেছে গৃহিণী নামক যন্ত্র। কারও কোনো দায় নেই তার প্রতি। কিন্তু অনেক দায়িত্ব তার কাঁধে আপনা থেকে উঠে এল। শুরু হলো জীবন চলা। দিন যায় রাত যায়। সুখ ছোঁয়া হয় না রায়নার।

অতঃপর নিজেকে তৈরি করা শুরু করল একদিন। একদিন সে দেশের প্রথম শ্রেণির নাগরিক হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করল। চাকরি হলো একটি স্কুলে। খোদা সহায় হলেন। দিন পরিবর্তন হলো। সন্তানদের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বলে উঠতে শুরু করল ধীরে ধীরে। স্বাবলম্বী এক নারীর মর্যাদা লাভ করল।
বেশ আছে রায়না এখন। মাঝেমধ্যে একা বসে ভাবে তার দুর্বিষহ সেই দিনগুলোর কথা।

বয়স কম ছিল, কতশত শখ-আহ্লাদ মেটানোর আগ্রহ, ঘুরে বেড়ানোর বাসনায় ছটফট করা ছোট্ট কোমল একটি মন। পরির মতো ডানা মেলে মেঘের ভেলায় ভেসে ভেসে আকাশ ছোঁয়ার অদম্য আগ্রহের কথা মুখ ফুটে বলা হয়নি কাউকে। কাকেই বা বলবে? সে কথা শোনার জন্য আশপাশে কাউকে সে খুঁজে পায়নি।

বিপরীতে অর্থের সংকট, মানুষের অপমান, অবহেলা তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও পায়ে পায়ে দোষের বেড়ি। সীমাহীন বৈষম্যের আচ্ছাদনে জড়িয়ে থাকা এক নারীর জীবন।

একদিন শিক্ষা তাকে মুক্তি দিয়েছে। দিয়েছে স্বাধীনতার স্বাদ। এই স্বাধীনতা তাকে পরি বানিয়ে দিল। মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়ানোর আনন্দ পেল। নিজেকে মানুষ বলে মনে হতে লাগল। সেই ছোট্ট রায়না নিজগুণে আজ একজন জয়িতা।

পূর্ব বাসাবো, কদমতলা, ঢাকা