স্বপ্ন দেখতাম, নিজের একটা ঘর হবে

অলংকরণ: তুলি

একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রিয় বিষয়ের একটি ছিল গার্হস্থ্য অর্থনীতি। ক্লাসে ম্যাডাম যখন বিষয়টি পড়াতেন, খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। প্র্যাকটিক্যাল খাতা খুব সুন্দর করে তৈরি করতাম আর মনে মনে ভাবতাম, যেদিন নিজের ঘর হবে, আমিও এভাবে সুন্দর করে সাজাব। নীলক্ষেত গিয়ে ঘুরে ঘুরে ম্যাগাজিন কিনে সুন্দর সুন্দর ছবিগুলো কেটে ফাইলে সযত্নে রেখে দিতাম, ভবিষ্যতের কথা ভেবে।

ঘর সাজাতে খুব পছন্দ করতাম। বাবার ঘর গোছালে দেখা যেত, ভাইয়েরা সব এলোমেলো করে দিত। মনে মনে ভাইদের উদ্দেশে বলতাম, ‘যেদিন নিজের ঘর হবে, সেদিন তোদের আমার ঘরে ঢুকতেই দেব না।’ পথে যেতে যেতে মাটির ফুলদানি, শো-পিস, জানালার পর্দার ডিজাইন দেখতাম আর মনে মনে ধরে রাখতাম। তখন তো আর মোবাইলে ক্যামেরা ছিল না। থাকলে ছবি তুলে রাখা যেত।

দেখতে দেখতে আমার বিয়ের বয়স হলো এবং হুট করে বিয়েও হয়ে গেল। ছেলেটিকে চিনতাম। দুই পরিবারের আগ্রহে বিয়েটা হয়। ছেলেটি শান্ত স্বভাবের এবং চোখ তুলে কথা বলে না, তাঁর এই ভদ্রতা আমার পরিবারের খুব পছন্দ হয়। ছেলেপক্ষ খুব আগ্রহ নিয়ে বিয়ে করালেও মেয়েকে তুলে নিবে না বলে জানায়; কারণ, পাত্রের বড় ভাই তখনো বিয়ে করেনি।

দিন চলতে থাকে, একটি অফিসে চাকরিতে জয়েন করি। প্রতিদিন স্বামী আমাকে অফিসে নিয়ে যেত এবং নিয়ে আসত। সহকর্মীরা ঠাট্টার ছলে নানা কথা বললে আমি শুনে খুব লজ্জা পেতাম। মনে মনে বলতাম, সহকর্মীরা এমনভাবে কেন বলে!

বিয়ে হলেও আমাদের মধ্যে তখনো শারীরিক সর্ম্পক হয়নি। তবে শিগগিরই হবে হয়তো। কিন্তু বিয়ের ছয় মাস কেটে যায়। সত্যি স্বামীর সঙ্গে আমার কোনোরকম সর্ম্পক হয় না। ভাবতে থাকি, তাঁর কি আমাকে পছন্দ নয়? এই চিন্তা আমাকে মাথা কুড়ে কুড়ে খেতে থাকে। অথচ সে প্রতিদিন সকালে আমার বাসায় এসে আমাকে নিয়ে অফিসে যায় এবং বিকেলে অফিস শেষে বাসায় রেখে যায়। ভাবতাম, অবশ্যই পছন্দ করে।
তবে একটা কাজ প্রতিদিন সে করত; তা হলো, প্রতিবার যাবার সময় আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যেত। একদিন আমার বাসায় জন্মদিনের এক অনুষ্ঠানে সে আসে। অনুষ্ঠান শেষে আমার গলার সোনার চেইনটা খুলে তাঁর হাতের কাছে রাখি; কিছুক্ষণ পর তা আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমার খুব লজ্জা লাগতে শুরু করে। আমি কিছু বলি না, চুপ করে থাকি। সে তারপর থেকে আমার বাসায় প্রায়ই আসতে থাকে এবং বাসার কেউ না কেউ বলে, এটা-সেটা খুঁজে পাচ্ছে না।

একদিন ভোরে ক্ষুধার যন্ত্রণায় ময়লার ঝুড়ি থেকে কেটে ফেলা দেওয়া সবজি উঠিয়ে ধুয়ে রান্না করি খাওয়ার জন্য; কিন্তু সেটাও খেতে দেননি শ্বশুর।

আমার এক সহকর্মী একদিন আমাকে জানায়, সে (স্বামী) মাদকের সঙ্গে যুক্ত। প্রথমে বিশ্বাস করিনি তাঁর কথা। পরে বিশ্বাস করতে হয়েছে। আমার মাথায় আকাশ যেন ভেঙে পড়ল। চিন্তায় পড়ে যাই। আমি এখন কী করব? ঘর তো বাঁধিনি এখনো। এখনই কেন ভেঙে যাবে সব। সিদ্ধান্ত নিলাম, তাঁকে মাদকের আসক্তি থেকে মুক্ত করতেই হবে। জিজ্ঞেস করলে সে সত্যটা স্বীকার করে ঠিকই; কিন্তু জানায়, আগে মাদক নিত, এখন সব ছেড়ে দিছে। তাঁর কথায় আশ্বস্ত হই। এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ের অনুষ্ঠান করে সে আমাকে নিয়ে যায়। সিনেমায় দেখেছি, বাসর ঘর কত সুন্দর হয়। কিন্তু আমাকে ঘুমাতে হলো ফুফু শাশুড়ি ও বরের ভাগ্নীদের সঙ্গে। তারা নতুন মামির সঙ্গে ঘুমাতে চায়। শুরু হলো আমার ঘর করা। সারা রাত জেগে থাকা। রাত ১২টা, ২টা, ৩টা; তাঁর ঘরে ফেরা। না, সে আমার সঙ্গে ঘুমাতে পছন্দ করত না। অপেক্ষা করতে করতে মাঝেমধ্যে ঘুমিয়ে পড়তাম না খেয়ে।

না খাওয়াটা একসময় অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। কারণ, অফিস শেষে বাসায় গিয়ে দেখতাম সব রান্না শাশুড়ি করে রেখেছেন এবং ফ্রিজে রেখে তালা দিয়ে রাখতেন। রাত ১২টা-১টার দিকে তাঁরা রাতের খাবার খেতেন। ততক্ষণে আমার ক্ষুধা নষ্ট হয়ে যেত। সকালে অফিসে যাবার সময় সবাই ঘুমিয়ে থাকত। ফ্রিজের তালার চাবি থাকত শাশুড়ির কাছে।
একদিন ভোরে ক্ষুধার যন্ত্রণায় ময়লার ঝুড়ি থেকে কেটে ফেলা দেওয়া সবজি উঠিয়ে ধুয়ে রান্না করি খাওয়ার জন্য; কিন্তু সেটাও খেতে দেননি শ্বশুর। উনি বলেন, ‘সকাল সকাল নিজে ঘুম থেকে উঠে খেয়ে যাও, আর বাসার মানুষ কী খাবে?’ প্রথম প্রথম বাবার বাসায় গিয়ে খেয়ে আসতাম। তারপর ভয় পেতাম, এই বুঝি তাঁরা বুঝে ফেলছে আমি না খেয়ে থাকি। আস্তে আস্তে আমার ক্ষুধাও কমে আসে।

এদিকে, ছোটাছুটি করতে থাকি বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে, রিহ্যাব সেন্টারগুলোতে। সিদ্ধান্ত নিই, স্বামীকে ভালো করে তুলতেই হবে। নইলে আমি কোথায় যাব? শ্বশুর-শাশুড়ি, ভাসুর—সবাইকে জানাই ওনাদের ছেলের কথা। কেউ আমার পাশে দাড়াঁয় না। শ্বশুড়ি বলত, ‘বিয়ে করাইছি কেন? তুমি ধইরা রাখতে পারো না? স্বামী বাইরে যায় কীভাবে? আমাগোটা তো যায় না? বাপ-মা কিছু শেখায়নি?’ শ্বাশুড়ি ছেলেকে জানিয়ে দেয়, আমি তাঁর চিকিৎসার জন্য দৌড়াদৌড়ি করছি। বর তখন আমাকে মারে, মুখে যা আসে তাই বলে। নেশার দলের বন্ধুদের আমার পেছনে লাগিয়ে দেয়। তাঁরা আমাকে রাস্তায় আটকিয়ে উত্ত্যক্ত করে। আমি হাসপাতালে ভর্তি হই। শাশুড়ি শুনে বলেন, ‘আমার নাকি কারও সঙ্গে সর্ম্পক ছিল। এইখানে বিয়ে হওয়ার কারণে তাঁরা আমাকে উত্ত্যক্ত করে।’ আমাকে কেউ হাসপাতালে দেখতে যায়নি। একটু সুস্থ হয়েই শ্বশুর বাড়ীতে ফিরে যাই। সবার মন জুগিয়ে চলার চেস্টা করি। কিন্তু লাভ হয় না।

কোথাও টাকা লুকিয়ে রাখতে পারতাম না। বর নিয়ে যেত। আমার সব গয়না বিক্রি করে দেয়। রাতে বাসায় ফিরত না। রাতে সিড়িতে বসে অপেক্ষা করতাম। মাঝেমধ্যে দেখতাম, ব্যালকনিতে বসে সিগারেট খাচ্ছে আর বাসার কাজের মেয়েটা পাশেই শুয়ে ঘুমাচ্ছে। খুব কষ্ট হতো, কান্না পেত, মুখের ভেতর কাপড় ঢুকিয়ে কাদঁতাম; যেন কেউ না শুনে। নিজেকে বহুবার আয়নায় দেখতাম, আর ভাবতাম কিসের কমতি আমার মধ্যে?

যেদিন বুঝলাম, সে অন্য কোথাও যায়; সেদিন নিজেকে খুব দ্রুত সরিয়ে ফেলার চিন্তা করলাম। কিন্তু সাহস পাচ্ছিলাম না। শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাই। আবার হাসপাতালে ভর্তি হই। সে সময় মনের অজান্তেই হাতের আঙুল দিয়ে চারকোনা ঘর বানাতাম। কাগজ-কলম হাতে পেলেই স্কয়ার বানাতাম…

সাইকোথেরাপিস্ট ও কনসালটেন্ট, সিটি হাসপাতাল লিমিটেড, ঢাকা