পুতুল কাঁদছে, খুব কাঁদছে। নিস্তব্ধ নীরব ভাষাহীন দুটি চোখ থেকে অনবরত ঝরনার মতো জল ঝরে যাচ্ছে। সে এখন বড় হয়েছে। ছোটবেলায় যে কান্না আসেনি, সে কান্না এই বেলায় পূর্বাভাস ছাড়াই হানা দিচ্ছে জলোচ্ছ্বাসরূপে।
ভেসে ওঠে সেই স্মৃতি! খুব জ্বর, জ্বরের তোড়ে তিতা মুখ। সাত দিন আগে একটা পাউরুটি খেয়েছিল। মাথা ঘুরতে ঘুরতে তা বমি হয়ে বের হয়ে গিয়েছিল। শিশুর কতটুকু যত্ন, খেয়াল, পুষ্টিকর খাবার লাগবে, পুতুলের মা-বাবা বুঝতেই পারেননি। হোমিও চিকিৎসা দিয়ে কাজ না হওয়া গ্রাম্য অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার দেখালে রোগ না সারিয়েই ভিটামিন ওষুধ আর ভুল চিকিৎসার জন্য ভেতর-ভেতর কত বড় ক্ষতি হয়, এটা বুঝতে পারে না। গাইনি ডাক্তারের একটা ফুটফুটে মেয়েশিশু, তাকে দেখভাল করার জন্য লোক রাখা। শিশুটির হাতে দারুণ সুন্দর একটি পুতুল দেখে পুতুলের সব স্মৃতি যেন প্রখর থেকে প্রখর হতে থাকে। জ্বরের দাবদাহে মাথায় পানি ঢালা, কপালে জলপট্টি, পথ্য—এসবের কিছুই মেলেনি। মিলেছিল নিঃসঙ্গ অপরিচ্ছন্ন অনাদরী বিছানায় পড়ে থাকা একা সময়, রোগের যন্ত্রণা। টিনের ঘরের টুইয়ের কাছেই মাকড়সার ঝুল জমতে জমতে পুতুলের মতো দেখতে হয়েছিল। সন্ধ্যাবেলায় বাতির আলোতে পুতুলের মা মশারি টানিয়ে দেন। কী খাবে জিজ্ঞেস করেন? সে বলে ওঠে, ‘একটা বুড়ি পায়ের কাছে বসে আছে, ও খিচুড়ি চাইছে মুরগির গোশত দিয়ে। আর ওই যে গুল মান্নান (মেম্বার) সাদা শার্ট পরে আমাকে খুব ডাকছে...নিয়ে যাবে কোথায় যেন।’ পুতুলের মা কাঁদেন। কারণ, গুল মান্নান নামের মেম্বার কয় দিন আগেই মারা গেছেন। ঘরের টুয়ে মাকড়সার ঝুল আস্ত একটা পুতুলের মতো দেখতে লাগে। বিছানায় পরে থাকা পুতুল ওই খেলনা পুতুল নেওয়ার জন্য ছটফট করতে থাকে।
গাইনি ডাক্তারের জিজ্ঞাসায় স্মৃতি থেকে হুঁশ ফেরে কিশোরী পুতুলের। জিজ্ঞেস করেন—
‘তোমার বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ কেমন? ভালো লাগে ছেলেদের?’
‘না।’
‘তোমার কি কখনো খুব জ্বর হয়েছিল?’
‘প্রায় সময় জ্বর থাকত। বাড়ির পাশেই নদী। নদীতেই পড়ে থাকতাম সব সময়। একবার এক মাস জ্বর ছিল। তখন আমি ক্লাস ফাইভ পাস করে সিক্সে উঠি। বাঁ পা চিকন হয়ে গিয়েছিল।’
পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পুতুল আরেক দিন হাসপাতালের ডাক্তারের রুমে প্রবেশ করে। চেয়ারে বসে টেবিলের সামনে রাখা নামফলকে চোখ রাখে...রুম নং ২১, বিভাগ গায়নোকোলজি, ডা. সাকিনা ইসলাম, সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতাল। অন্য অক্ষরগুলো ঝাপসা হতে থাকে। ডাক্তারের কথা কানে আসে।
কীভাবে যে বলি! তোমার সাহস আছে, তবে শক্তি রেখো...তোমার ইউটেরাস অনুর্বর। এত ক্ষুদ্র যে তোমার কোনো দিন ঋতুচক্র বা মাসিক হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সম্ভাবনা নেই মা হওয়ারও!
পুতুলের চোখ আবার ডাক্তারের ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েটির পুতুলের দিকে যায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে সাদাকালো দিনগুলো…।
খালি পা, খালি গা, পরনের বিড়াল প্যান্টটাও ময়লায় মাখা-মাখা। টিনের বেড়ার ছিদ্র দিয়ে অন্যের বাড়িতে চলা সাদাকালো টেলিভিশন দেখার প্রবল আগ্রহে দাঁড়িয়ে ছিল সে। ও বাড়ির মেয়েগুলো দরজা খুলে পুতুলকে তাড়িয়ে দেওয়ার পরেও বেহায়ার মতো আবার টিনের ছিদ্রে চোখ রাখে সে। একপর্যায়ে ও বাড়ির শিশু ছেলেটি সপাং করে পিঠের ওপর কঞ্চি দিয়ে বাড়ি মারায় পুতুল তুমুল শব্দে কেঁদে ওঠে। ছেলেটির মা তখন ঘরের ভেতর মাটির মেঝেতে ন্যাটা দিয়ে বসতে বলে পুতুলকে। পিঠে টনটনে দাগ, কিছুটা পিঠের তেলের অংশ বের হয়ে গিয়েছে। পুতুল ভুলে যায় ব্যথার কথা, টেলিভিশনে চোখ রাখে। সিনেমা দেখবে। সিনেমার নাম লাল পাহাড়। শাবানার ছোট্ট মেয়েকে গুন্ডারা ধরে নিয়ে যায় লাল পাহাড়ে। মেয়েটির হাতে একটা গোলাপি রঙের পুতুল ছিল। গুন্ডাদের থেকে উদ্ধারের সময় হাত থেকে সেটি পড়ে যায়। সিনেমা শেষ হওয়ার পর থেকে পুতুলের খুব ইচ্ছা করছে লাল পাহাড়ে যেতে। তার ধারণা, ওখানে গেলে পুতুলটা খুঁজে পাবে।
ডাক্তারের উচ্চ শব্দে আবার স্বাভাবিক হয় সে। দেখো, তোমার এই সমস্যার সমাধান হবে। তবে চিকিৎসা ব্যয়বহুল। জানি না তোমার পরিবার বহন করতে পারবে কি না! আগামী দিন তোমার মা অথবা বড় বোনকে নিয়ে এসো!
ডাক্তারের রুম পেছনে ফেলে হাঁটছে পুতুল। মাথাভর্তি রোদ। কৈশোরকাল ছেড়ে আসার পরও অর্ধেক চিকিৎসায় অসমাপ্ত সমাধানে পুতুল। এখন তার চাঁদ দেখলে কষ্ট হয়। উইমেন ডিজিজ শব্দটাও মাথায় ঘোরে। পুরুষ, প্রেম, বিয়ে এসব নিয়ে ভাবে না। ভাবতে গেলে কাউকে ঠকানো হবে ভেবে থেমে যায়। এক দিন তো স্কুলের বাংলা ম্যাডাম ডেকে নিয়ে বুক থেকে ওড়না খুলে বলে, তোর বুক কোথায় পুতুল!
বাড়ি ফিরে সে খুব কেঁদেছিল। হাসপাতাল থেকে গাইনি ডাক্তার বদলি হওয়ার পর ডাক্তার তৃষ্ণা রানির কাছে যায় পরামর্শের জন্য। তিনি পরামর্শ দেন বড় ওড়না পড়ে গা ঢেকে রাখার।
পুতুল যত বড় হতে থাকে গ্রামের মধ্যে মাছির শব্দ বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে সংক্রমণ। একদিন তার নিজের মা তাকে অপয়া বলে বসে। এতে পুতুল এত কষ্ট পায় যে গোসল করতে গিয়ে মাথায় পানি ঢালার ছুতোতে চোখের পানি ধুয়ে ফেলে।
পুতুলের বড় বোন মাঝেমধ্যে ওষুধ কিনে দেয়। চিকিৎসাটা নিয়মিত চালানো উচিত জেনেও হয়ে ওঠে না। ডাক্তারের কমপাউন্ডার, গ্রামের কেউ কেউ, বন্ধুদের মধ্যে থেকেও পুতুলকে হিজড়া বলে আঘাত করা হয়। হিজড়া ভিন্ন জিনিস, অনুর্বর ইউটেরাস এটাও ভিন্ন জিনিস। পুতুল তাদের সামনে কিছুই বলে না। কিন্তু প্রত্যেক রাতে, প্রত্যেক নামাজে জায়নামাজের সিজদাহর জায়গা, ঘুমানোর বালিশ, বুকের কাপড় চোখের জলে ভিজতে ভিজতে কালচে দাগ হয়ে যায়। এসএসসি পাসের পর শ্বাসকষ্ট অনুভব করে। দম নিতে কষ্ট হয়। একদিন পেরে না ওঠে ডাক্তার দেখায়। হার্টের সমস্যা ধরা পড়ে। হার্টের শ্যাডো অসম্ভবভাবে ফুলে যাওয়ার চিহ্ন স্পষ্ট হয়।
মানসিকভাবে পুতুলের জায়গায় কেউ দাঁড়ালে দাঁড়িয়ে থাকতে পারত কি না কে জানে!
তারুণ্যে পা পড়ে যায় পুতুলের। অ্যালোপ্যাথি ওষুধের খরচ বহন করতে না পেরে হোমিও খেতে থাকে। হোমিওর ফলাফল দ্রুত না পাওয়ায় সেটাও বাদ দেয়। পথনাটকের দলে যোগ দেয় পারিশ্রমিকের কথা শুনে। দূরদূরান্তে পথনাটক করে পারিশ্রমিক নেয়। মানুষ দেখে, জীবন দেখে। তার চেয়েও অনেক বেশি কষ্টে থাকতে দেখেছে মানুষকে। মানুষ দেখতে দেখতে একসময় সহ্য করে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলে তার হিজড়া শব্দ, অপয়া, অলক্ষ্মী শব্দগুলোকে। ইচ্ছাশক্তিতে ভর করে উড়তে চায় খুব।
তারুণ্য যখন টগবগ করে ওঠে পুতুলের চোখে-মুখে তখনো তার পুরুষের প্রতি তাকাতে ইচ্ছা করে না ভয়ে। একদিন হঠাৎ সালোয়ারে লাল দাগ দেখে সে চমকে ওঠে। ভালোভাবে পরখ করে যখন বুঝতে পারে, সে পূর্ণাঙ্গ নারী হওয়ার অনুমোদন পেয়েছে, তখন পুতুল কেঁদে ওঠে কৃতজ্ঞতায়।
পুতুলের হাতের কাছে এখন অসংখ্য পুতুল। প্রতি মাসেই তাকে প্যাড কিনতে হয়। কিন্তু ফেলে আসা দিনগুলো ভাবলেই তার চোখ শুকনা থাকে না।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সিরাজগঞ্জ বন্ধুসভা