মহাতারকা হওয়ার প্রতিভা সত্ত্বেও কেন পতন হলো ওজিলের

ওজিলের চোখে রোনালদো সেরা
ফাইল ছবি, এএফপি

রিয়াল মাদ্রিদ থেকে মেসুত ওজিলকে যখন আর্সেনালে বিক্রি করে দেওয়া হয়, তখন তাঁর সম্পর্কে সের্হিও রামোস বলেছিলেন, ‘সে গ্রেট ফুটবলার, ইউনিক। যদি ক্ষমতা আমার হাতে থাকত, তাহলে রিয়াল মাদ্রিদ থেকে বিক্রি করা সর্বশেষ ফুটবলার হতো সে। এই সিদ্ধান্ত (রিয়াল থেকে ওজিলকে বিক্রি করে দেওয়া) কোনোভাবেই আমার বুঝে আসে না।’ ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো যেন আরও বেশি অখুশি ছিলেন। তিনি সতীর্থদের বলতেন, ‘ক্লাবের এই সিদ্ধান্ত আমার জন্য খুবই খারাপ সংবাদ। সে এমন একজন খেলোয়াড়, যে গোলপোস্টের সামনে আমার অবস্থান সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারত।’

২০১০ সালের জুলাইয়ে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেওয়ার পর থেকে ক্লাবটির হয়ে তিন মৌসুম খেলেছেন জার্মান প্লেমেকার মেসুত ওজিল। তিন মৌসুমেই তিনি স্পেনের সর্বাধিক অ্যাসিস্টকারী হন। জয় করে নেন মিডিয়া এবং সমর্থকদের ভালোবাসা। এই সময়ের মধ্যে রিয়ালের জার্সিতে ১৫৯ ম্যাচ খেলে ২৭ গোল করেন। আর সতীর্থদের দিয়ে গোল করিয়েছেন ৮১টি! এ জন্যই মূলত ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো খুশি ছিলেন না। পর্তুগিজ যুবরাজের অধিকাংশ গোলের অ্যাসিস্টকারী ছিলেন ওজিল। বলা হয়, রোনালদোর প্রধান বল জোগানদাতা এই জার্মান।

আর্সেনাল দলেও ব্রাত্য হয়ে পড়েন আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায় বলে দেওয়া মেসুত ওজিল
ফাইল ছবি রয়টার্স

রিয়ালে বেশ সুখেই ছিলেন ওজিল। তবে আর্সেনালে যোগ দেওয়াটা তাঁর একক সিদ্ধান্ত ছিল না। টটেনহাম থেকে গ্যারেথ বেলকে রেকর্ড ট্রান্সফারের বিনিময়ে কিনে আর্থিক ঝামেলায় পড়ে রিয়াল মাদ্রিদ। আর সংকট মোকাবিলায় একজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়কে বিক্রি করতেই হতো। সে সময় ওজিলের মার্কেট দর ভালো থাকায় তাঁকেই ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ক্লাব কর্তৃপক্ষ। ২০১৩ সালের জুনে মাত্র ২৪ বছর বয়সে আর্সেনালের ইতিহাসের সবচেয়ে দামি খেলোয়াড় হিসেবে ক্লাবটিতে যোগ দেন এই মিডফিল্ডার।

গানারদের হয়ে প্রথম চার মৌসুম দুর্দান্ত কাটে জার্মান তারকার। আর্সেন ওয়েঙ্গারের অধীনে অবিশ্বাস্য সব সৃষ্টিশীলতা দেখিয়েছেন, মাঠে কল্পনাতীত সব মুহূর্তের জন্ম দিয়েছেন আর আর্সেনালের হয়ে গোলে সহায়তার যত রেকর্ড আছে, সব নিজের করে নিয়েছেন। সর্বশেষ যেবার চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলেছে আর্সেনাল, সে মৌসুমে লুদোগোরেৎসের বিপক্ষে অনন্য এক গোল উপহার দিয়েছিলেন ওজিল। যেটিকে তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা গোল বললেও ভুল হবে না।

২০১৮ সালে জার্মানি জাতীয় দল থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন ওজিল
ফাইল ছবি: রয়টার্স

কিন্তু এরপরই ঘটে ছন্দপতন। ওয়েঙ্গারের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে ওজিলের ক্যারিয়ারও যেন পিছু হাঁটতে থাকে। নতুন কোচ হিসেবে উনাই এমেরি আসলেও সেরা ফর্ম আর ফিরে পাননি তিনি। পরে ২০১৯ সালের শেষে দলটির দায়িত্ব পান তাঁরই সাবেক সতীর্থ মিকেল আর্তেতা। সমর্থকেরা আশা করেছিলেন, এবার হয়তো তাদের প্রিয় তারকা নতুন রূপে ফিরবেন! আর্তেতাও চেয়েছিলেন ওজিলকে দলের প্রাণ বানাতে। কিন্তু এক বছর পরই সাবেক সতীর্থের ব্যাপারে নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে নেন আর্সেনাল কোচ। দল থেকেও ধীরে ধীরে বাদ দিয়ে দেন। ২০২০-২১ মৌসুমে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে গানারদের ২৫ সদস্যের তালিকা থেকে তাঁকে ছেঁটে ফেলেন কোচ। তারও আগে ৭ মার্চ ক্লাবটির হয়ে নিজের শেষ ম্যাচ খেলে ফেলেন ওজিল। আর্সেনালের হয়ে আট (প্রকৃতপক্ষে সাত হবে) মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ২৫৪ ম্যাচে ৪৪ গোল করেছেন ওজিল। আর সতীর্থদের দিয়ে গোল করিয়েছেন ৭৯টি!

চুক্তির মেয়াদ ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত থাকলেও জানুয়ারিতেই তুরস্কের ক্লাব ফেনারবাচে যোগ দেন এই তারকা। সেখানে কিছুদিন পর দেশটির আরেক ক্লাব বাসাকসেহিরে যোগ দেন। সেখান থেকে এ বছরের শুরুর দিকে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে পেশাদার ফুটবলকে বিদায় বলে দিয়েছেন বিশ্বকাপজয়ী এই ফুটবলার। ২০০৯ সালে জার্মানির হয়ে অভিষেকের পর ২০১৮ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলেন ওজিল। এর মাঝে ২০১৪ বিশ্বকাপে জার্মানির হয়ে জেতেন বিশ্বকাপ। ২০১৮ সালে বিশ্বকাপে ব্যর্থতা এবং ফেডারেশনের সঙ্গে নানা ঝামেলায় জড়ানোর পর জাতীয় দল থেকে অবসর নেন তিনি।

এরদোয়ানের সঙ্গে ওজিল ও গুন্দোয়ানের বিতর্কিত সেই ছবি
ছবি: এএফপি

তাঁর ক্যারিয়ার আরও লম্বা হতে পারত। হতে পারতেন মহাতারকা। কিন্তু হয়নি। দুর্দান্ত প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও অচিরেই ঝরে পড়েন। ওজিলের ব্যাপারে একবার তাঁর সাবেক কোচ হোসে মরিনহো বলেছিলেন, ‘শিল্প ফুটবলকে সহজ করে তোলে। আর ওজিলের সেই দক্ষতা রয়েছে।’ মাদ্রিদে থাকাকালীন তিন মৌসুমে গোলের সুযোগ সৃষ্টি করার দিক দিয়েও লা লিগায় সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন তিনি (৩২৩টি)। আর প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে কোনো একটি নির্দিষ্ট মৌসুমে সর্বাধিক সুযোগ (১৪৬টি) সৃষ্টি করার রেকর্ডও তাঁর দখলে।

ওজিলের ক্যারিয়ার লম্বা না হওয়ার পেছনে যতটা না ফর্ম দায়ী, তার চেয়েও বেশি দায় বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ড। তুর্কি বংশোদ্ভূত জার্মান ফুটবলার সে। জন্ম এক মুসলিম পরিবারে। তুরস্কে কখনো না থাকলেও দেশটি তাঁর মনের মধ্যে সব সময়ই ছিল। তাই তো তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপ এরদোয়ানের স্পর্শে ছিলেন ওজিল। কিন্তু ২০১৮ বিশ্বকাপের আগে এরদোয়ানের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে আর্সেনালের জার্সি উপহার দেওয়াটা একটু বাড়াবাড়িই মনে হয়েছে জার্মান ফুটবল ফেডারেশনের। এরপরই দেশটির হয়ে না খেলার সিদ্ধান্ত নেন ওজিল। তবে আর্সেনালের হয়ে তখন ভালোই চলছিল সব। কিন্তু চীনের উইঘুরের মুসলমানদের নিয়ে টুইটারে কথা বলার পর এখানেও সমস্যায় পড়েন তিনি। উইঘুর বিতর্কের পর তাঁকে আর স্কোয়াডে রাখা হয়নি। ক্যারিয়ারটা মূলত সেখানেই থমকে যায় তাঁর।