কবি-সাহিত্যিকদের সান্নিধ্য ‘লেখক-সঙ্গ স্মৃতি আনন্দ’

লেখক-সঙ্গ স্মৃতি আনন্দ
কোলাজ: শাকিব হাসান

গত বছর বইমেলার সময় এবং দুই বছর আগে আনিসুল হকের জন্মদিনে তাঁর ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম। দুটো ইন্টারভিউই তিনি শুরু করেছিলেন রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের গল্প দিয়ে। এ কথা বলার কারণ, আনিসুল হকের এবারের বইমেলার নতুন বই ‘লেখক-সঙ্গ স্মৃতি আনন্দ’ পড়তে গিয়ে দেখলাম, বইটা শুরু করেছেন রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের গল্প দিয়ে। দাদাভাইকে নিয়ে যা লিখেছেন, তার বেশ কিছু ঘটনা আমার জানা। আমি স্বয়ং আনিসুল হকের মুখ থেকে শুনেছি। এই যেমন বুয়েটে সহপাঠীদের জলসায় বলেছিলেন, তিনি কবি হবেন বলে ঢাকায় এসেছেন। সেই ছড়া,
‘শহরজুড়ে রাত্রি আসে নিয়নে,
চাঁদের চিঠি ভুল ঘরে দেয় পিয়নে।’

এই ছড়া এবং সেটা নিয়ে ইত্তেফাক অফিসে যাওয়া। ছড়াটি লিড হিসেবে ছাপা হওয়া, পাশে ফয়েজ আহমেদের ছড়া। বইমেলায় দাদাভাই দেখা হওয়ার পর কী বলেছিলেন ইত্যাদি। আমি যে এই বিষয়গুলো জানি, এটা ভেবেই আমার বেশ ভালো লাগা কাজ করছিল। যেমন আনিসুজ্জামান স্যার, সৈয়দ শামসুল হক স্যারের কথা, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, তসলিমা নাসরিন, নির্মলেন্দু গুণ, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারসহ আরও অনেক অনেক গল্প আমার সুযোগ হয়েছে আনিস ভাইয়ের কাছ থেকে শোনার। আরও ভালো লাগছিল আমিও একজন অন্যতম সেরা লেখকের সান্নিধ্য পেয়েছি। তাঁকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। তাঁর নির্দেশনায় কাজ করার সুযোগ পাচ্ছি।

যা হোক, বইয়ে ফিরে আসি। পড়া শুরু করলাম লেখালেখির গুরু সৈয়দ শামসুল হক, কৈশোরে সৈয়দ হকের মুখোমুখি ও হাসপাতালে সৈয়দ শামসুল হককে দেখে ফিরে। সেখানে জানছি, সত্তরের দশকের সাহিত্য কেমন ছিল। আনিসুল হক দৈনিক ইত্তেফাক আর সাপ্তাহিক বিচিত্রার কথা বারবার উল্লেখ করেছেন। সেখানে অনেক গুণী লেখক-কবি-সাহিত্যিকের কথা উল্লেখ আছে। সেই সময়ে ঈদসংখ্যাগুলোর সাহিত্যে যৌনতা ছিল প্রকট। সে বিষয় নিয়ে এই তো সেদিন আনিসুল হক ও কবি শামীম আজাদের ইন্টারভিউ নিচ্ছিলাম, তখন এ নিয়ে কথা হচ্ছিল। ‘পরানের গহীন ভিতর’-এর প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদে হলদে-সবুজে ন্যাড়ামাথা সৈয়দ শামসুল হকের বড় ছবি। আনিসুল হক নিজের স্মৃতি থেকে শামসুল হক কী বলেছেন তা লিখেছেন।

এ বছর আনোয়ারা সৈয়দ হক ‘বাসিত জীবন’ নামের একটি বই প্রকাশ করেছেন। সেই বইয়ে আনিসুল হকের কথা উল্লেখ আছে। ‘হাসপাতালে সৈয়দ শামসুল হককে দেখে ফিরে’ পড়ে ফেললাম। আনিসুল হককে সৈয়দ হক বিশেষ স্নেহ করতেন; কারণ দুজনই উত্তরবঙ্গের। আনিসুল হকের বাড়ি রংপুর আর সৈয়দ হকের বাড়ি কুড়িগ্রাম। আনিসুল হকের হাত ধরে সৈয়দ হক আবৃত্তি করলেন একটা শায়েরি থেকে ‘অশ্রুপাত করতে হয় না। আমাদের দিন ভালো গেছে, আরও ভালো যাবে, আজকের এই দিন নিয়ে যেন আমরা দুঃখ না করি।’ আমি পড়তে পড়তে মুহূর্তটা অনুভব করতে পারছিলাম।

সেদিন বইমেলা সমাচার অনুষ্ঠানে আনিস ভাই বলেছিলেন, সৈয়দ হকের কাছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি কবিতা চাইলেন। লন্ডনের হাসপাতালে শুয়ে সেই কবিটা পাঠালেন সৈয়দ শামসুল হক। এরপর একটা শব্দ নিয়ে তিনি তিনবার খুদে বার্তা পাঠিয়েছিলেন আনিসুল হককে। কর্কটাক্রান্ত শরীর নিয়ে তিনবার খুদে বার্তা পাঠানো ভাবা যায় না। আনিসুল হক এ ঘটনার বর্ণনা আরও ভালোভাবে দিয়েছেন এই বইতে। আরও অনেক ঘটনার উল্লেখ আছে। পড়া শুরু করলাম নির্মলেন্দু গুণ ও হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গ স্মৃতি আনন্দ। কী ভালো লাগা কাজ করছে একেকটি গল্প জেনে। গত মাসেই জিপিএ সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শেষ করে চট্টগ্রাম থেকে ফেরার পথে এয়ারপোর্টে যিনি হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আনিসুল হকের ভুল–বোঝাবুঝি সৃষ্টি করেছিলেন, তাঁর সঙ্গে দেখা। আনিস ভাই অবলীলায় আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বললেন।

যা হোক কবি, লেখক, সাহিত্যিকদের নিয়ে আমার আগ্রহের শেষ নেই। আমাদের যাঁদের সুযোগ হয়নি এমন গুণী মানুষদের সান্নিধ্য পাওয়া, তাঁদের সম্পর্কে জানা, তাঁরা যদি আনিসুল হকের ‘লেখক-সঙ্গ স্মৃতি আনন্দ’ পড়েন, তাহলে অনেক কিছুই জানতে পারবেন।

‘কবি-সাহিত্যিকেরা বেশির ভাগই মজার মানুষ।’ এটা সত্য কথা। তাঁদের সেন্স অব হিউমারের তুলনা হয় না। এই বই অসাধারণ। আরেকটি বিষয়, একটা অনুষ্ঠানে সাত–আটজন বক্তা কথা বললেন। খুবই বিরক্ত লাগছে তখন বক্তব্য। আনিসুল হক সেই সময়ে বক্তৃতা দিতে উঠলেন। বক্তৃতা শুরুর আগপর্যন্ত অনেকে ভাববেন আরও বক্তৃতা! উফ সম্ভব নয়। যখন আনিসুল হক শুরু করবেন, তখন পুরো দৃশ্য পরিবর্তন হয়ে যাবে। গল্প বলার অসাধারণ ক্ষমতা আছে আনিসুল হকের। আর সেই সঙ্গে তাঁর স্মরণশক্তি তীব্র।

একটা ছোট্ট অংশ দিয়ে শেষ করি। পূর্বাভাস পত্রিকার জন্য লেখা চাইতে তসলিমা নাসরিনের পুরান ঢাকার বাসায় যাওয়ার ঘটনায় বাসাটির একটা বর্ণনা দিয়েছেন আনিসুল হক। ‘রং না করা একটা ভবনের পঞ্চম বা ষষ্ঠতলায় তসলিমা নাসরিন থাকতেন। নিচতলায় ছিল কাগজের গোডাউন। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠছি, একেক তলায় একেক রকমের গন্ধ, কোনোটাতে সাবানের, কোনোটাতে লোবানের, কোনোটাতে বিস্কুটের, কোনোটাতে ওষুধের। সব ছিল গোডাউন।’ এই স্মরণশক্তি কেবল আনিসুল হকেরই আছে। এভাবে এত বছর আগে একটা বাসায় যাওয়ার ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তিনি বর্ণনা করেছেন।

যা হোক, এখনো অনেক গল্প পড়া বাকি। আজ আর কথা না বাড়াই।