আকাশের পূর্ব দিগন্তে সূর্যের সোনালি আভা ফুটে উঠলেও, ঘড়ির কাঁটা তখন মাত্র ৪টা ৪০। ফজরের আজান হয়েছে প্রায় বিশ মিনিট আগে। ভোরের শেষ প্রহর আর সকালের সূচনার এই সন্ধিক্ষণে, কুয়েতের ফারওয়ানিয়া শহরের তাপমাত্রা ইতিমধ্যেই ৩৫ ডিগ্রি ছুঁই ছুঁই। গ্রীষ্মের এই সময়ে এমন উষ্ণতা অস্বাভাবিক নয়। জীবিকার তাগিদে এই তাপকে উপেক্ষা করেই ছুটতে হয় প্রবাসীদের।
নিশান, প্রবাসজীবনের এক নীরব সাক্ষী। হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেয়ালে ঝোলানো কাঠের ঘড়ির দিকে তাকায়। ঘড়ির কাঁটা ৫টা ছুঁয়েছে। আজ ঈদুল আজহা। ৬টা ৩০-এর মধ্যে গোসল সেরে ঈদের জামাতে পৌঁছাতে হবে আহমাদি শহরে। ফারওয়ানিয়ার তুলনায় আহমাদিতে মুসলমানের সংখ্যা বেশি। তাই আশপাশের শহরগুলোর মুসলমানরা সেখানেই ঈদের জামাতে অংশ নেয়।
নিশান ঘরের অন্যদের জাগাতে শুরু করে—
‘এই সালেহান, ওঠ! ৫টা বেজে গেছে। রাকিব ভাই, রাফি, সবাই ওঠো!’
‘নিশান, মাত্র তো ৫টা বাজে। আরেকটু পরে গেলে হয় না?’ রাকিব ভাই ঘুমচোখে বললেন।
‘না ভাই, পরে দেরি হয়ে যাবে। আজ ঈদের দিন, রাস্তায় ট্রাফিক থাকবে। জলদি উঠুন!’
এক এক করে সবাই ওঠে, মুখ ধুয়ে গোসল সারে। কেউ নতুন পাঞ্জাবি, কেউ আগের ঈদের পাঞ্জাবি পরে প্রস্তুত হয়। সুগন্ধি, আতর ব্যবহার করে সবাই ঈদের আনন্দে নিজেকে মেলে ধরে। নিশানের বাসায় রাকিব ভাই সবার বড়। ঘর থেকে বের হওয়ার আগে সবাই তাঁকে সালাম করে। মশকরার ছলে রাফি বলে—‘ভাই, এবার কিন্তু আমাদের ঈদ সালামি লাগবে!’
‘জি ভাই, এর আগের ঈদে দেননি। এবার কিন্তু দিতেই হবে।’ পাশ থেকে বলে সালেহান।
রাকিব ভাই বলেন, ‘হ্যাঁ, দিব। আগে তো ঈদের জামাতে চল।’
ঘরের বাইরে থেকে নিশানের ডাক আসে। তাঁদের কুয়েতি বন্ধু মোছমেলিন গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। সবাই একসঙ্গে ঈদগাহে যাবে।
ফারওয়ানিয়া থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে আহমাদি শহরের ঐতিহ্যবাহী ঈদগাহে পৌঁছাতে প্রায় ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট লাগে। ঈদগাহের মিম্বারে একজন আলেম আরবি ভাষায় খুতবা দিচ্ছেন। মাঠের প্রতিটি কোণ পরিপূর্ণ। মৃদু বাতাসে আতর ও সুগন্ধির ঘ্রাণ ভেসে আসছে। আকাশের মেঘের আড়াল থেকে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। খতিব সাহেবের খুতবা শেষ হলে যথা নিয়মে ঈদের জামাত শুরু হয়।
জামাত শেষে সবাই একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে। নিশান, রাফিরা অন্য বাঙালি মুসলিমদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে। সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে, অল্প কিছু মিষ্টি খেয়ে তারা আবার বাড়ির পথে রওনা হয়।
রাস্তার দুপাশে সবুজ খেজুরগাছ, সুপারিগাছ পেরিয়ে ছোট পাহাড় পেছনে ফেলে গাড়ি চলতে থাকে। লোকালয়গুলোতে দেখা যায় মানুষ তাদের কোরবানির পশু জবাই করছে, কেউ মাংস কাটছে, কেউ প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই দৃশ্য কোরবানির মূল শিক্ষা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই পশুরা যেভাবে নিজেদের আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করছে, ঠিক তেমনি সাহাবিরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সন্তুষ্টির জন্য নিজেদের সত্য ও মানবতার পথে কোরবান করে দিয়েছেন। এ কারণেই ইসলাম ধর্ম এত সুন্দর।
সালেহান নিচু সুরে বলে, ‘কতই না ইচ্ছা ছিল এই ঈদটা পরিবারের সঙ্গে করব। কিছুই হলো না।’
রাফি সায় দিয়ে বলে, ‘ঠিক বলেছ, সালেহান। আমার আব্বা তো ভেবেই রেখেছিল ঈদে দেশে যাব। তাই গরু কিনেছিলাম। অথচ ঈদের দিনেও ছুটি নেই। বিকেলেই ছুটতে হবে কাজে।’
গাড়ির সামনের সিটে বসা রাকিব ভাই। তিনি বলেন, ‘তোমরা তো মাত্র তিন-চার বছর হলো বিদেশে এসেছ। আর আমি এই নিয়ে তেরো বছর। কিন্তু আজ পর্যন্ত ঈদ দেশের মাটিতে করতে পারলাম না। তোমরা বিয়েশাদিও করোনি, সন্তান-সন্ততিও নেই। আর আমি!’
ওনার চোখ ভিজে আসে। বলতে লাগলেন, ‘মেয়েটা কাল রাতে ফোন করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আব্বু, তুমি কালকে আমাকে নিয়ে নামাজে যাবে না! তুমি কখন আসবে! তুমি না আসলে কিন্তু আমি মাংস খাব না!” পেটের দায়ে আর প্রিয়জনদের মুখের হাসি ধরে রাখার জন্য গত তেরোটা বছর ধরে প্রতি ঈদে কেবল চোখের পানি ফেলি।’
গাড়িতে বসে থাকা সবার চোখ দিয়েই অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। রাফি ফুঁপিয়ে কাঁদে। গাড়ির জানালার বাইরে রাস্তার দিকে এক মনে তাকিয়ে থাকে নিশান। আনমনা হয়ে ভাবে, এই প্রবাসজীবন কতই না বেদনাদায়ক। শারীরিক শ্রমের কষ্ট কোনো কষ্টই না, যখন মনে পড়ে আপনজন ছাড়া আনন্দগুলোকে উপভোগ করার মুহূর্ত।
গাড়ি চলছে আহমাদি ও ফারওয়ানিয়ার মহাসড়ক ধরে। গাড়ির ভেতরে সবাই চুপচাপ।
বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা