ব্যালন ডি’অরের দাবিদার হয়েও যেসব ফুটবলার বঞ্চিত

(বাঁ থেকে) রবার্ট লেভানডফস্কি, ভার্জিল ফন ডাইক ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো
ছবি: সংগৃহীত

ব্যালন ডি’অর হলো ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিগত স্বীকৃতি। নির্দিষ্ট একটি বছরে সেরা খেলোয়াড়ের হাতে ওঠে এই পুরস্কার। তবে কোনো কোনো বছর ব্যতিক্রমও হয়েছে।

১৯৫৬ সালে ব্যালন ডি’অরের প্রথম আসরে পুরস্কারটি জয় করেন ইংল্যান্ডের স্ট্যানলি ম্যাথিউস। তখন নিয়ম ছিল, কেবল যাঁরা ইউরোপের ফুটবলার, তাঁরাই এটি জিততে পারবেন। অর্থাৎ ইউরোপের বাইরে অন্য কোনো দেশের খেলোয়াড়েরা ব্যালন ডি’অরের জন্য বিবেচিত হবে না। এই নিয়মের পরিবর্তন হয় ১৯৯৫ সাল থেকে। বর্তমানে এই পুরস্কারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট ও ম্যাচে পারফরম্যান্সের প্রভাব এবং দলীয় সাফল্যেরও প্রভাব থাকে।

প্রথমে ফ্রান্স ফুটবল ৩০ জন শীর্ষ ফুটবলারের একটি তালিকা করে। সেখান থেকে ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ ১০০-তে থাকা দেশের সাংবাদিকদের জুড়ি বোর্ডের সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে সেরা পাঁচ নির্বাচন করা হয়। বেশির ভাগ সময় সেরা খেলোয়াড়ের হাতেই উঠেছে স্বীকৃতি। কয়েক বছর বিতর্কও হয়েছে। প্রকৃত সেরার হাতে না উঠে অন্য কারও শোকেসে গেছে সোনালি ট্রফি।

উয়েফা ছেলেদের বর্ষসেরা ট্রফি হাতে বায়ার্ন তারকা রবার্ট লেভানডফস্কি
ছবি: এএফপি

রবার্ট লেভানডফস্কি (২০২০-২১)
২০১৯-২০ মৌসুমে বুন্দেসলিগা, ডিএফবি-পোকাল ও চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে ট্রেবল নিশ্চিত করে বায়ার্ন মিউনিখ। সব ধরনের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৫৫ গোল করে নিজেকে বিশ্বের সেরা স্ট্রাইকার হিসেবে প্রমাণ করেন দলটির তারকা রবার্ট লেভানডফস্কি। কিন্তু করোনার কারণে ওই বছর ব্যালন ডি’অর দেওয়া হয়নি। মূলত লিগ ওয়ানের মৌসুম পুরোপুরি সম্পন্ন না হওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নেয় ফ্রান্স ফুটবল ম্যাগাজিন কর্তৃপক্ষ।

পরের বছর ২০২১ সালে বায়ার্নের হয়ে সব ধরনের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে আরও ৬২ গোল করেন পোলিশ স্ট্রাইকার। মনে হয়েছিল, এবার অন্তত তাঁর হাতে পুরস্কারটি উঠবে। কিন্তু ফলাফলে দেখা গেল, লিওনেল মেসির চেয়ে ৩৩ ভোট কম পেয়েছেন লেভানডফস্কি (৫৮০টি)। ব্যালন ডি’অর জয়ের পর বক্তৃতায় মেসিও বলেন, এটা লেভানডফস্কির প্রাপ্য। লেভানডফস্কিকে উদ্দেশ্য করে মেসি বলেন, ‘সবাই জানে এবং আমরাও স্বীকার করি যে গত বছরের বিজয়ী ছিলে তুমি। ফ্রান্স ফুটবলের উচিত ২০২০ সালের ব্যালন ডি’অর তোমার হাতে তুলে দেওয়া। এটা তোমার প্রাপ্য এবং তোমার বাড়িতে এটা থাকা উচিত।’ ওই বছর শেষ পর্যন্ত ‘গার্ড মুলার স্ট্রাইকার অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কারে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে সাবেক বায়ার্ন তারকাকে।

লিভারপুলের ভার্জিল ফন ডাইক
ছবি : এএফপি

ভার্জিল ফন ডাইক (২০১৯)
ইয়ুর্গেন ক্লপের অধীনে ২০১৯ সালে টটেনহামকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জয় করে লিভারপুল। সেই দলের সেরা তারকা নিশ্চিতভাবেই ডাচ ডিফেন্ডার ভার্জিল ফন ডাইক। প্রিমিয়ার লিগের সেরা সেন্টারব্যাক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। প্রিমিয়ার লিগে দ্বিতীয় স্থানে থেকে শেষ করে লিভারপুল।

২০১৮-১৯ মৌসুমে লিভারপুলের হয়ে সব প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে অংশ নেন ভার্জিল ফন ডাইক। ডিফেন্ডার হয়েও গোল করেছেন রেকর্ড ১০টি। ইতিহাসের মাত্র চতুর্থ ডিফেন্ডার হিসেবে ব্যালন ডি’অর জয়ের বেশ দাবিদারও ছিলেন। কিন্তু ফলাফলে মাত্র ৭ ভোটের ব্যবধানে লিওনেল মেসির কাছে হেরে যান।

ওই মৌসুমে বার্সেলোনার হয়ে ৫১ গোল ও ২২টি অ্যাসিস্ট করেন মেসি। তবে দলীয়ভাবে কোনো শিরোপা জিততে পারেনি তাঁর দল। চ্যাম্পিয়নস লিগে লিভারপুলের কাছে তারা হেরে যায়। ভার্জিল ফন ডাইকের হাতে ব্যালন ডি’অর না ওঠায় বেশ হতাশ হয়েছিলেন কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ। তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকদের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং এভাবেই তারা এটা করে থাকে। আমি এটিকে একটু ভিন্নভাবে দেখি, আরও অনেকেও এভাবে দেখে। আমার মনে পড়ে না, আর কোনো ডিফেন্ডারের এতটা ভালো মৌসুম কেটেছে কখনো।’

পাঁচটি ব্যালন ডি’অর জিতেছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো
ছবি: রয়টার্স

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো (২০১৮)
২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল, টানা ১০ বছর ব্যালন ডি’অরের সোনালি ট্রফি কেবল দুজন মানুষের হাতে গেছে; ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ও লিওনেল মেসি। ২০১৮ সালে এসে সেটিতে ভাগ বসান লুকা মদরিচ। ওই বছর রিয়াল মাদ্রিদের ১৩তম চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ে অন্যতম বড় ভূমিকা ছিল এই মিডফিল্ডারের। পাশাপাশি রাশিয়া বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়াকে ফাইনাল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পেছনে তাঁর অবদান অনেকটাই। কিন্তু পুরো বছরে লুকা মদরিচের নামের পাশে কেবল ৩টি গোল ও ১১টি অ্যাসিস্ট।

অথচ ২০১৭ থেকে ১৮ মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগে ১৫টিসহ সব ধরনের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৪৪টি গোল করেছিলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। তবে এ নিয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি পর্তুগিজ যুবরাজ।

ফ্রাঙ্ক রিবেরি

ফ্রাঙ্ক রিবেরি (২০১৩)
প্রথম জার্মান ক্লাব হিসেবে ২০১২-১৩ মৌসুমে ট্রেবল জয় করে বায়ার্ন মিউনিখ। সে সময় থমাস মুলার, ফিলিপ লাম ও বাস্তিয়ান শোয়েনস্টেইগার ছিলেন দলটির প্রধান তারকা। কিন্তু বায়ার্নের সফলতার সত্যিকারের কারিগর ছিলেন ফ্রাঙ্ক রিবেরি। সব ধরনের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৩৪ গোলে অবদান ছিল এই ফরাসি তারকার। তারপরও ব্যালন ডি’অর ভোটিংয়ে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ও লিওনেল মেসির পেছনে থেকে যান তিনি।

সর্বাধিক ৫৫ গোল করে সেবার ব্যালন ডি’অর নিজের করে নেন রিয়াল মাদ্রিদ তারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। যদিও তাঁর দল কোনো বড় শিরোপা জিততে পারেনি।
২০২২ সালে ইতালিয়ান সংবাদমাধ্যম লা গ্যাজেটা ডেলো স্পোর্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ নিয়ে প্রকাশ্যে হতাশা ব্যক্ত করেছেন ফ্রাঙ্ক রিবেরি। তিনি বলেন, ‘এটি অন্যায় ছিল। সেবার আমার জন্য দুর্দান্ত একটি মৌসুম ছিল এবং আমার জেতা (ব্যালন ডি’অর) উচিত ছিল। তারা (ফ্রান্স ফুটবল কর্তৃপক্ষ) ভোটের সময় বাড়িয়ে দেয় এবং কিছু একটা ঘটেছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল।’

২০১০ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যাচে আরিয়েন রোবেন (বাঁয়ে) ও ডার্ক কাউটের (ডানে) সঙ্গে ওয়েলসি স্নেইডার
ফাইল ছবি

ওয়েসলি স্নেইডার (২০১০)
বিশ্বকাপের বছর ব্যালন ডি’অরে টুর্নামেন্টটির প্রভাব থাকে। সেটি বিবেচনায় নিলে ২০১০ সালে স্বীকৃতিটি পাওয়ার কথা ছিল ডাচ তারকা ওয়েসলি স্নেইডারের। দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে যৌথভাবে সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন তিনি এবং চারটি ম্যাচসেরার পুরস্কারও জিতেছিলেন। দলকে ফাইনালে নিয়ে যাওয়ার পেছনে তাঁর অবদান অনেকটাই।

এ ছাড়া ইন্টার মিলানের চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়েও ওয়েসলি স্নেইডারের অবদান রয়েছে। সেমিফাইনালের প্রথম লেগে বার্সেলোনার বিপক্ষে ৩-১ গোলে জয়ের ম্যাচে নিজে একটি গোল করেন এবং করিয়েছেন আরও একটি। ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে জয়ে এই ডাচ প্লেমেকারের একটি অ্যাসিস্টও রয়েছে। অথচ ব্যালন ডি’অরে সেবার সেরা তিনেও জায়গা পাননি ওয়েসলি স্নেইডার।

বার্সেলোনার হয়ে ৪৭ গোল ও ১২টি অ্যাসিস্ট করে দ্বিতীয়বারের মতো ব্যালন ডি’অর জিতে নেন লিওনেল মেসি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়েছিলেন মেসির সতীর্থ জাভি হার্নান্দেজ ও আন্দ্রেজ ইনিয়েস্তা। দল হিসেবে বার্সেলোনা লা লিগা ও ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপের শিরোপা জয় করে।

তথ্যসূত্র: গোলডটকম