সেই জীর্ণ শীর্ণ শরীরটা আজও খুঁজি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বাবার শরীরটা জীর্ণশীর্ণ ছিল। রোগাক্রান্ত নয়, জীবনযুদ্ধের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ লৌহ বডি। নিরলস পরিশ্রম করে যাবার উপযুক্ত শরীর। অসম্ভব ভালো, সৎ এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন বাবা। বিভিন্ন কারণে তাঁর সঙ্গে অন্যরকম সুসম্পর্ক ছিল। মনের কথা হয়তো সবার সঙ্গে শেয়ার করতে পারতেন না। তাই তাঁর কথা শোনার একটা নৈতিক দায়ভার থাকত আমার কাঁধে।

মৃত্যুর দুই বছর আগে বাবা বুঝে গিয়েছিলেন, ইহজাগতিক দায়দায়িত্ব শেষের দিকে। মৃত্যুপরবর্তী ভাবনাগুলো আমার কাছে ব্যক্ত করেছিল। একজন সন্তানের জন্য শান্ত মনে পিতার মৃত্যুপরবর্তী ইচ্ছে শোনাটা মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। তবু আমাকে শুনতে হয়েছে বাধ্যানুগত সন্তানের মতো। মনে যে ঝড় বইছিল সে সময়, তা এখন ঠাওর করা দুঃসাধ্য যে কারোর পক্ষে। আজও সে ঝড়ের তীব্রতা অনুভব করতে পারি ঠিক সেদিনের মতো।

সেদিন বাবা বলেছিলেন, চিতার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শিমুল গাছে তাঁর পূর্বগামীদের সঙ্গে তিনি মিলেমিশে থাকবেন। এ সত্য কি অসত্য ভাষণ, তা জানার ক্ষমতা আমার নেই। কারণ, আমি বেঁচে আছি। আর বেঁচে থেকে মৃত্যু পরবর্তী কারোর আত্মার অবস্থান জানার মতো জ্ঞান নেই। জীবিত আমি এবং মৃত বাবার ভাবনার মধ্যে অবলম্বন শিমুল গাছটা এখনো দণ্ডায়মান। ঠিক আগের মতো।

আজ বাবা নেই দুই বছর হলো। কথাগুলো বলার চার বছর হয়ে গেছে। স্মৃতির মানসপটে সেসব কথা চিরভাস্বর। বাবাকে যখন শেষ বিদায় জানাই; ভগবানের কাছে এই মিনতি ছিল, তিনি যেন বাবাকে স্বর্গবাসী করেন। সে স্বর্গ কোথায় তা নিজেও জানি না। কেবল এক কল্পিত সুখের রাজ্য। অথচ বাবা বলেছিলেন, শিমুল গাছে তাঁর পূর্বগামীদের সঙ্গী হবেন। জানি না, তাঁরা কে কোথায় আছেন! এও জানি, রক্ত মাংসের সেই বাবা আর কোনোদিন চোখের সামনে আসবেন না। তবু ঐ জীর্ণশীর্ণ শরীরের মানুষটা, আমার জীবিত বাবাকে দেখতে খুব মন চায়। বাবার জীর্ণশীর্ণ শরীরটা খুঁজে বেড়াই, চিতার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শিমুল গাছে।

শিক্ষক, কুড়িগ্রাম