১ থেকে ১৭২তম— প্রতিটি পাঠচক্রে যাঁর উপস্থিতি শতভাগ

মুদ্রিত বই পড়ার দলগত পাঠের আসরে আলোচনায় ভৈরব বন্ধুসভার উপদেষ্টা সুমন মোল্লাছবি: বন্ধুসভা
ভৈরব বন্ধুসভার নিজস্ব স্লোগান ‘বন্ধুসভা করতে চাও, পাঠচক্রে আউ’। স্লোগানটিও সুমন মোল্লার দেওয়া। বন্ধুসভার প্রাথমিক সদস্যপদ পেতে তিনি একটি শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। সেটি হলো পরপর তিনটি পাঠচক্রে উপস্থিত থাকতে হবে।

ভৈরব বন্ধুসভার মুদ্রিত বই পড়ার দলগত পাঠের আসর পাঠচক্রের ১৭২তম আসরটি বসে গত সোমবার। ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রাচীন পালাগানের সংকলন মৈমনসিংহ গীতিকার ‘দস্যু কেনারামের পালা’ নিয়ে হওয়া পাঠচক্রে যেসব বন্ধু অংশ নেন, তাদের একটি অংশ ছিল না ১৭১তম আসরে। এমনি করে কেউ যদি আগের আসরে থেকে থাকেন, তাঁদের অনেককে পাওয়া যায়নি পরবর্তী আসরে। তবে প্রথম থেকে ১৭২তম—সব কটিতে উপস্থিত ছিলেন কেবল একজন। তিনি ভৈরব বন্ধুসভার উপদেষ্টা ও প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক সুমন মোল্লা।

পাঠচক্রের প্রতিটি আসরে তিনি একজন মনোযোগী শ্রোতা এবং বিশ্লেষণধর্মী আলোচক। বই নির্বাচন থেকে শুরু করে মুখ্য আলোচক—উভয় ক্ষেত্রে দৃঢ়তার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। ভৈরব বন্ধুসভার পাঠচক্রকে গতিশীল করতে সুমন মোল্লার অবদান অনেক। এই সংগঠনে যুক্ত হওয়ার পর থেকে দেখছি পাঠচক্র যেদিন থাকে, তিনি নাওয়াখাওয়া ভুলে বই পড়ছেন, প্রস্তুতি নিচ্ছেন পাঠের আসরের জন্য। প্রতিটি আসরে তাঁর জ্ঞাননির্ভর আলোচনায় মুগ্ধ হতে হয়।

মুদ্রিত বই পড়ার প্রতি সুমন মোল্লার বিরল ভালোবাসার কারণেই ভৈরব বন্ধুসভার পাঠচক্র আজ সারা দেশে সমহিমায় দ্যুতি ছড়াচ্ছে। চারপাশে আজ আমাদের যত বিস্তৃত পরিচয় আর মর্যাদা—সবই পাঠচক্র ঘিরে। আনন্দ নিয়ে বই পড়া যায়, বই পড়ায় উচ্ছ্বাসজাগানিয়া উপস্থিতি এবং বই পড়ার আসরের মাধ্যমে একটি সংগঠনকে শক্ত ভিত পাইয়ে দেওয়া যায়—সব কটি সত্যযোগ তাঁর হার না মানা অবিচল নেতৃত্বের কারণেই।

পাঠচক্রের প্রতি অবিচল ভালোবাসার নেপথ্য কথন জানতে কথা হয় সুমন মোল্লার কাছে। তিনি জানান, কঠিন সব চেষ্টা ও উদ্যোগের কথা। বর্তমানে বই পড়ার আসরের মতো অনাগ্রহের জায়গায় তরুণদের ফেরানোটা কতটা কৌশলের ছিল, তা-ও জানা যায় কথোপকথন থেকে। সুমন মোল্লা বলেন, ‘ভৈরব ছোট শহর। ছোট শহরে সৃজনশীল উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা অনেকটা কঠিন। উদ্যোগ বাস্তবায়নে জোগানের স্বল্পতা পদে পদে ভোগায়। যেমন পাঠচক্রের প্রধান উপকরণ প্রত্যাশিত বইয়ের জোগান। ভৈরবে বাণিজ্যিক বইয়ের দোকানে এখন আর সাহিত্যের বই নেই। গাইড আর পাঠ্যবই সাহিত্যের বইয়ের তাক দখল করে নিয়েছে। সুতরাং হাতের কাছে বই পাওয়ার আর সুযোগ থাকল না। আবার কোনো পাঠাগার থেকে যে বই সংগ্রহ করা যাবে, এমন সুযোগও নেই। কারণ, ভৈরবে এখন আর কোনো পাঠাগার সক্রিয় নেই। এক-দুটি থাকলেও বই আদান–প্রদান নেই। অথচ প্রতিটি পাঠচক্রে নির্দিষ্ট বইয়ের একাধিক কপির প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে অনলাইন বই বিক্রি প্ল্যাটফর্মের সাহায্যের বিকল্প নেই। আবার এই মাধ্যমে বই পাওয়া অনেকটা ব্যয়বহুল। পাওয়ার পর অন্তত ১০ দিন আগে বন্ধুদের কাছে কপি দিতে হয়। তাঁরা এই কপি হাতবদল করে পড়েন। প্রক্রিয়াটি কঠিন ও বড় দায়িত্বের।’

জোগানের দ্বিতীয় অভাব তরুণদের সংঘবদ্ধ অবস্থান না থাকা বলে জানান তিনি। সুমন মোল্লা বলেন, ‘ভৈরবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই। নেই বড় কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ফলে তরুণদের সংঘবদ্ধ অবস্থানও নেই। এ অবস্থায় শুরুর দিকে তরুণদের সংঘবদ্ধ করার চ্যালেঞ্জটি ছিল কঠিন।’

দেখা গেছে, পাঠচক্র ও সংগঠনকে এগিয়ে নিতে তিনি প্রথমে ওই দুটি জোগানের সহজ প্রাপ্তি নিশ্চিত করেন। সুমন মোল্লার মতে, পাঠচক্রের জন্য প্রত্যাশিত বই প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে একটি নিজস্ব পাঠাগার প্রতিষ্ঠা হতে পারে বিকল্প। শেষ পাঁচ বছরের চেষ্টায় ভৈরব বন্ধুসভার পাঠাগার এখন সহস্রাধিক বইয়ের সমৃদ্ধ একটি পাঠাগার। এর মাধ্যমে তিনি পাঠচক্রের বই পাওয়া অনেকটা সহজ করে দিয়েছেন। একই সঙ্গে বন্ধুদের মুদ্রিত বই পাঠেও মনোযোগী করেছেন। প্রতি মাসে অন্তত ১৫টি বই আদান-প্রদান হয়। তারুণ্যের সমাবেশ ঘটানোর বড় প্ল্যাটফর্ম তৈরির অভাবটি তিনি পূরণ করেছেন পাঠচক্রকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেই।

‘পাঠচক্রের জন্য প্রত্যাশিত বই প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে একটি নিজস্ব পাঠাগার প্রতিষ্ঠা হতে পারে বিকল্প।’
ভৈরব বন্ধুসভার উপদেষ্টা সুমন মোল্লা
ভৈরব বন্ধুসভার উপদেষ্টা ও প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক সুমন মোল্লা
ছবি: সংগৃহীত

কয়েক বছর ধরে ভৈরব বন্ধুসভার সক্রিয় বন্ধুর সংখ্যা শতাধিক। এর বড় একটি অংশের যুক্ত হওয়ার পেছনের গল্প পাঠচক্র। আমার শুরুটাও পাঠচক্রের প্রতি মুগ্ধতা থেকেই। ভৈরব বন্ধুসভার নিজস্ব স্লোগান ‘বন্ধুসভা করতে চাও, পাঠচক্রে আউ’। স্লোগানটিও সুমন মোল্লার দেওয়া। বন্ধুসভার প্রাথমিক সদস্যপদ পেতে তিনি একটি শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। সেটি হলো পরপর তিনটি পাঠচক্রে উপস্থিত থাকতে হবে। কেউ যদি দুটিতে থেকে একটিতে না থাকে, তাহলে নতুন করে টানা তিনটিতে যুক্ত থাকতে হয়। এককথায় ভৈরব বন্ধুসভার সাংগঠনিক ভিত রচনায় তিনি পাঠচক্রকে বড় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছেন।

পাঠচক্র নিয়ে সুমন মোল্লার নেতৃত্বের বড় ছাপ স্পষ্ট হয় করোনাকালে। দীর্ঘ পথচলায় পাঠচক্রের স্বাভাবিক গতি রোধ করতে চেয়েছিল করোনাকাল। কিন্তু তাঁর সাংগঠনিক দৃঢ়তায় করোনাও হার মানে পাঠচক্রের কাছে। সে সময় তাঁর স্পষ্ট কথা, পাঠচক্র বন্ধ হবে না। বিকল্প পথ বের করতে হবে। বিকল্প উপায় হিসেবে প্রথমে জুম লাইভের মাধ্যমে, পরে সীমিত পরিসরে ফেসবুক লাইভে চলমান ছিল পাঠচক্র। করোনাকালে যখন কোনো স্থান উন্মুক্ত নেই, তখন সুমন মোল্লা ও তাঁর স্ত্রী ওয়াহিদা আমিন পলি উন্মুক্ত করে দিলেন নিজেদের ঘর। এই দম্পতির ঘরে বসেই চলে বন্ধুসভার একাধিক লাইভ পাঠচক্র। লাইভ সম্প্রচার হওয়া পাঠচক্র ভৈরবের গণ্ডি পিরিয়ে সারা দেশে সমাদৃত হয়। লাইক–কমেন্টে ভরে দেয় কমেন্ট বক্স। ভিউ বিবেচনায়ও প্রতিটি পাঠচক্র ভিন্নমাত্রা পায়।

গত বছর বন্ধুদের দাবি ওঠে স্কুলে স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে পাঠচক্র করার। এ ক্ষেত্রেও সুমন মোল্লা নেন কার্যকর উদ্যোগ। শেষে স্কুল পর্যায়ে পাঠচক্র সারা দেশে বিশেষ আগ্রহের জায়গা সৃষ্টি করে। এমনকি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আবদার আসতে থাকে তাঁদের স্কুলে গিয়ে পাঠচক্র করার। মানুষের আগ্রহে গতি দিতে স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও সহযোগিতার হাত বাড়ান। কেন্দ্রীয় পর্ষদও নানাভাবে উৎসাহ জোগান দিয়ে যাচ্ছে।

বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা