যেভাবে প্রথম গল্প লিখেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯ মে ১৯০৮—৩ ডিসেম্বর ১৯৫৬)প্রতিকৃতি : মাসুক হেলাল

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। নামটা শুনতেই হৃদয় যেন প্রশান্ত হয়ে যায়। বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি এই লেখকের আজ জন্মদিন। ১৯০৮ সালে আজকের দিনে বিহারের সাঁওতাল পরগনা, বর্তমান ঝাড়খন্ড রাজ্যের দুমকা শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। মেদিনীপুর জিলা স্কুল থেকে ১৯২৬ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় এবং ১৯২৮ সালে বাঁকুড়া ওয়েসলীয় মিশন কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে উচ্চতর পড়ালেখার জন্য গণিত বিষয়ে ভর্তি হন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে।

গণিতে পড়ালেখা করে গণিতশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করতে পারতেন। কিন্তু মানিক লিখতে এলেন কীভাবে? ভাবছেন, নিশ্চয়ই লিখতে আসার জন্য আবার কারণ লাগবে বুঝি! লেখার জন্য কারণ প্রয়োজন কি প্রয়োজন নয়, তা নিয়ে যুক্তিতর্ক হতে পারে। বিখ্যাত কবি–সাহিত্যিকদেরও এ বিষয়ে নানা মত আছে। কিন্তু মানিকের প্রথম গল্প লেখার পেছনে একটি ঘটনা আছে। ঘটনাটা বলব, তার আগে মানিকের ছেলেবেলা ও বড় হওয়ার কিছু কথা বলে নেওয়া জরুরি।

কিশোর বয়সে মাকে হারান মানিক। মাতৃহীন জীবন যেমন হয়, মাকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছিলেন। ‘জননী’ উপন্যাস পড়লে মায়ের প্রতি তাঁর ভালোবাসা উপলব্ধি করা যায়। বরাবরই মানিক মেধাবী, পড়ালেখায়ও ভালো ছিলেন। ঝুঁকি নিতে ভালোবাসতেন। মাঝিমাল্লাদের সঙ্গে চলে যেতেন দূর গন্তব্যে। বর্ষার ভরা নদীতে বন্ধুদের সঙ্গে নৌকা চালিয়ে আনন্দ পেতেন। মানিক কুস্তিও শিখেছিলেন। কণ্ঠের মাধুর্য ছিল, চমৎকার গান গাইতেন। দারুণ বাঁশিও বাজাতেন। আর শখ ছিল বই পড়ার। বই পড়তে ভালোবাসতেন। বই পড়া প্রসঙ্গে মানিক লিখেছেন, ‘বই কেন ভালোবাসি? মানুষকে ভালোবাসি বলে। বইয়ের মধ্যে মানুষের সঙ্গ পাই।’ বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ, বিশেষ করে ‘বিষবৃক্ষ’, ‘গোরা’সহ সাহিত্যের অমূল্য রত্ন পড়েছিলেন কিশোর বয়সেই। ‘একখানা বই পড়তাম আর তার ধাক্কা সামলাতে তিন-চারদিন মাঠে ঘাটে, নৌকায় নৌকায়, হাটবাজারে মেলায় ঘুরে তবে সামলে উঠতাম,’ লিখেছেন তিনি।

মানিক বিশ্বাস করতেন, লেখক হওয়ার জন্য প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। তা ছাড়া রাতারাতি লেখক হওয়ার ম্যাজিকে তিনি বিশ্বাস করতেন না। মানিকের প্রথম গল্প লেখার ঘটনাটা বলব বলেছিলাম। ঘটনাটা জানার পর অনেকেরই মনে হতে পারে, মানিক বোধ হয় প্রস্তুতি ছাড়াই লিখতে এসেছিলেন। কিন্তু বিষয়টা মোটেই তেমন নয়। আগেও বলেছি, মানিক বই পড়তে ভালোবাসতেন। কিশোর বয়সেই পড়ে ফেলেছিলেন বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সব রচনা। তা ছাড়া মানুষের জীবনের প্রতি ছিল তাঁর দারুণ আগ্রহ। তাই তো তাঁর লেখায় খুঁজে পাওয়া যায় জীবনের সব যন্ত্রণা, বাস্তবতা।

আর কথা না বাড়াই। ঘটনাটা এবার বলি। লেখালেখি করবেন, লেখক হবেন—এ সংকল্প ছেলেবেলায় মানিক আঁটেননি। এমনকি কল্পনাও করেননি একজীবন নিরলসভাবে লিখে কাটাবেন। বিজ্ঞানমনস্ক মস্তিষ্কে শুধু ভাবতেন আর খুঁজতেন প্রতিটি ‘কেন’র উত্তর। বোধ হয় এ কারণেই অঙ্কে বিএসসি অধ্যয়নরত অবস্থায় বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে প্রথম এবং নিজের লেখা শ্রেষ্ঠ গল্পের একটি লিখতে পেরেছিলেন।

নিশ্চয়ই ভাবছেন, বাজি ধরে আবার শ্রেষ্ঠ গল্প লেখা যায় নাকি! কীভাবে যায়, আত্মজৈবনিক লেখায় নিজেই তিনি লিখেছেন, ‘বারো, তেরো বছর বয়সের মধ্যে বিষবৃক্ষ, গোরা, চরিত্রহীন পড়া হয়ে গিয়েছে। আর সে কি পড়া!...বড় ঈর্ষা হতো বই যাঁরা লেখেন তাঁদের ওপর। হয়তো সেই ঈর্ষার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল একদিন লেখক হবার চেষ্টা করার সাধ।’

যাহোক একদিন বন্ধুদের আড্ডায় কথায় কথায় লেখা ছাপার বিষয় উঠল। সূত্রপাত এক বন্ধুর তিনটি লেখা মাসিক পত্রের অফিস থেকে ফিরে আসা। বন্ধু সম্পাদককে একটা গাল দিলেন। মানিক প্রতিবাদ করলেন। বললেন, ‘কেন বাজে কথা বকছ? ভালো লেখা কি এত সস্তা যে হাতে পেয়েও সম্পাদকেরা ফিরিয়ে দেবেন?’ প্রশ্নের তীর তেড়ে এল মানুষটির কাছে। বন্ধুদের একজন প্রশ্ন করেই বসল, ‘তুমি কী করে জানলে?’ ‘আমি জানি।’ উত্তরে বললেন মানিক। নানা কথা–কাটাকাটির প্রসঙ্গক্রমে বাজি ধরে বসলেন। বললেন, ‘তিন মাসের মধ্যে ভারতবর্ষ, প্রবাসী বা বিচিত্রায় গল্প লিখে ছাপাবেন।’ যে কথা সেই কাজ, ‘বিচিত্রায়’ ছাপা হলো তাঁর প্রথম গল্প। শুধু কি ছাপা হলো, সম্পাদক বাড়ি পর্যন্ত এসেছিলেন। হাতে তুলে দিয়েছিলেন সম্মানী। দাবি জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আর একটি গল্প চাই।’

বলছিলাম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প লেখার ঘটনার কথা। বাজি ধরে লেখা গল্পের নাম বলব। তার আগে একটি তথ্য জানিয়ে রাখি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সার্টিফিকেট নাম কিন্তু মানিক নয়। মানিক হচ্ছে তাঁর ডাকনাম। বাড়ির লোকেরা তাঁকে আদর করে এই নামে ডাকতেন। তাঁর আসল নাম প্রবোধ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। আর গল্পটির নাম ‘অতসী মামি’।

গণিতের মেধাবী শিক্ষার্থী মানিক বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে সেই যে শব্দ নিয়ে খেলা শুরু করলেন, তারপর আর থামেননি। একাধারে লিখে গেছেন কালজয়ী সব লেখা। সৃষ্টি করেছেন বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী সব চরিত্র। সমৃদ্ধ করে গেছেন বাংলা সাহিত্যের ভান্ডার।

কার্যনির্বাহী সদস্য, বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ