বনমালীকে পরজন্মে রাধা হওয়ার মিনতি জানায় ‘রাধাকৃষ্ণ’

‘রাধাকৃষ্ণ’ চলচ্চিত্রে কৃষ্ণ চরিত্রে অভিনয় করেন ইলিয়াস কাঞ্চনছবি: সংগৃহীত

রাধা এখানে রোজিনা। কৃষ্ণ এখানে ইলিয়াস কাঞ্চন। ১৯৯২ সালে প্রখ্যাত পরিচালক মতিন রহমান নির্মাণ করেছিলেন ‘রাধাকৃষ্ণ’ চলচ্চিত্রটি। রাধা-কৃষ্ণের যুগ যুগবাহিত মানবিক প্রেমের আখ্যানকে নিজের মতো করে গুছিয়ে নিয়েছিলেন পরিচালক। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তা ফুটিয়ে তুলেছিলেন।

ধর্মীয় পুরাণ হোক বা সামাজিক লোককথা, আবহমানকাল ধরে জনজীবনে মিশে থাকা এই রাধা ও কৃষ্ণ চরিত্রগুলো কিন্তু ইতিহাস নয়। কবির মনোভূমিতে গড়ে ওঠা এই প্রণয়গাথার নির্মাণ-বিনির্মাণ চলতেই পারে। মতিন রহমানের চলচ্চিত্রে কৃষ্ণের জন্মকথা, শৈশবের লীলা এবং মামা কংসকে বধ করা পর্যন্ত অলৌকিক কাণ্ডগুলো পর্যায়ক্রমে ছুঁয়ে গেলেও মূলত প্রধান হয়ে উঠেছে রাধা ও কৃষ্ণের চিরন্তন মানবিক প্রেমের গল্প।

স্বামী আয়ানের ঘরকে পর করেছে রাধা। পরপুরুষ কৃষ্ণের হৃদয়ঘরকে করেছে আপন। প্রেমের কলঙ্ক নিয়ে আবার পতিগৃহ ছেড়ে যাচ্ছে। এ রকম একটা প্রণয়বিধ্বস্ত বিরহদংশনের মুহূর্তে এই চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা হয়েছে সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে দীন শরৎ–এর লেখা ‘বনমালী গো, তুমি পরজনমে হইয়ো রাধা’ গানটি। এই গান বাঙালি জীবনে এমনিতেই মিশে ছিল, এই প্রথম আরও বিপুল স্রোতে, প্রবল ধারায় বাঙালি হৃদয়কে করুণ রসে বিগলিত করে দিল।

‘রাধাকৃষ্ণ’ চলচ্চিত্রটিও মূলত সুরের সফর। দেখতে দেখতে কানাই বড় হয়ে ওঠে, আপনমনে বাঁশি বাজায়। রাধা সখীদের সঙ্গে নদীতে জল আনতে গিয়ে গান ধরে, ‘ওরে ও পিতলের কলসি তোরে লইয়া যাব যমুনায়...’। জহির রায়হান ‘বেহুলা’ চলচ্চিত্রেও এ গান ব্যবহার করেছিলেন।

এই চলচ্চিত্রের আবহমানকালের আখ্যানকে আমরা কি শুধু হিন্দুদের পৌরাণিক ধর্মের গল্প বলব? শুধু পরিচালক মতিন রহমান, কৃষ্ণ ইলিয়াস কাঞ্চন বা রাধা রোজিনা নয়, চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত অধিকাংশ শিল্পীরা ধর্মপরিচয়ে কিন্তু মুসলিম। যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে কখনো কোনো অবস্থায়ই শিল্পীদের ধর্মপরিচয় খুঁজি না। কিন্তু আজকের দিনে মানুষে মানুষে বিভাজন যেভাবে বাড়ছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে, সেখানে দাঁড়িয়ে এ ধরনের চলচ্চিত্র বাংলাদেশের প্রকৃত সত্তাকে তুলে ধরে। রাধা–কৃষ্ণের প্রেমকাহিনি গ্রামবাংলার চিরন্তন লোককাহিনি ছাড়া কিছুই নয়। ‘কানু বিনে গীত নাই’, এসব গীতিকার প্রকৃত মানবতার পরিচায়ক কিছু মানুষ। এর আবেদন ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সমাজজীবনে কোনো দিনই ফুরানোর নয়।

আজও আমরা দেখি সায়ন নামের এক তরুণ রাধাকৃষ্ণ প্রেমের গান গেয়ে বঙ্গজীবনে কেমন উথালপাতাল ঝড় তোলে। ‘যদি দেখার ইচ্ছা হয়/তোমার নিঠুর মনে লয়/কালিন্দীর ঘাটে আইসো দুপুরের সময়…’ আজকের নেট দুনিয়ায় সেই গান ভাইরাল হয়। জাত–ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে অসংখ্য বাঙালি সেই গানের ভেতর নিজেদের ত্রাণ খোঁজে। অন্যদের আনন্দ দিতে গানের ভিডিও দিকে দিকে ছড়িয়ে দেয়। ‘রাধাকৃষ্ণ’ চলচ্চিত্রে মা যশোধার চরিত্রে আনোয়ারার মধ্যে আমরা বাঙালির চিরন্তন মাতৃত্বের সন্ধান পাই। বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম নিজে এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন।

প্রচলিত সব গান সংগ্রহ করেছেন এবং লোকগানের সুর বিন্যাস করেছেন আহমেদ ইমতিয়াজ। চিত্রনাট্য লিখেছেন পরিচালক মতিন রহমান। নৃত্যপরিচালক ছিলেন এস আলম। আবহ সংগীত পরিচালনা করেছেন মালিক মনসুর। সিরাজুল ইসলামের চিত্রগ্রহণ ভালো লাগে। ভালো লাগা গানগুলো গেয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন, আবিদা সুলতানা, রুনা লায়লা ও এন্ড্রু কিশোর।

মথুরায় চলে যাওয়ার সময় কৃষ্ণ রাধাকে বলেছিল, ‘আমার নামের আগে চিরকাল তোমার নাম উচ্চারিত হবে।’ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে রাধা নাম কৃষ্ণের আগে উচ্চারিত হলেও তার পরিণতি আমরা সবাই জানি। বনমালীর কাছে রাধার মিনতি তাই কোনো দিন ফুরানোর নয়। ‘রাধাকৃষ্ণ’ চলচ্চিত্রটির আবেদনও প্রতিটি সমকালের মাটিতে দাঁড়িয়ে মহাকালকে ছুঁয়ে ফেলেছে।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত