স্বপ্নের ফেরিওয়ালা

অলংকরণ: তুলি

জেঁকে বসেছে শীত। পৌষের সকালে কুয়াশার ঘ্রাণ নিতে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াই। মায়ের বাগানবাড়ির বাংলোর পাশে বরইগাছে ফুলের ওপর ভ্রমর লুকোচুরি খেলছে। বকুলগাছটি বাতাসে দুলছে। টুপটাপ শিশির ঝরে পড়ছে বকুল ফুলের ডগায়। ছাদবাগানের গাঁদা, গোলাপ ফুটতে শুরু করেছে। দূর থেকে ভেসে আসছে বুলবুলির ডাক।

এককালে মায়ের বাগান থেকে রোজ সকালে পাশের বাড়ির ফাতেমা বুবু ঝাঁট দিয়ে ঝরে পড়া শুকনা পাতা কুড়িয়ে নিয়ে যেত। এ জন্য মা তাঁকে বকশিশও দিত। মাঝেমধ্যে বুবুর ছেলে ফরহাদও আসত। সে বাড়িতে টুকটাক কাজ করে দিয়ে যেত। একদিন দেখি, ফরহাদ কিছু একটার বায়না ধরেছে। বুবু চিৎকার করে বলছে, ‘গোলামের পুত সর বলছি, দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে। তোর বাবা আমারে এক মাস ধরে টাকাপয়সা দেয় না। কীভাবে সংসার চালাই, খবর আছে? গত সপ্তাহে না ৫০০ টাকা নিলি ব্যাট কেনার জন্য। আবার কিসের টাকারে?’ বলে ঝাড়ু নিয়ে দৌড়ানি দিল ছেলেকে।

অর্ধযুগ পরে একদিন ফাতেমা বুবুর সঙ্গে রাস্তায় হঠাৎ দেখা। হাসি দিয়ে বলল, ‘ভাইয়া, আমার ছেলে ফরহাদ ভালো চাকরি পেয়েছে। টাকা জমিয়ে একটা জায়গা কিনে বাড়ি করেছি। অনেক দিন ঝুপড়িঘরে থেকেছি।’

একদিন ফরহাদকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুই লেখাপড়া করলে অনেক ভালো রেজাল্ট করতে পারতিস। লেখাপড়া ছাড়লি কেন?’ জবাবে বলল, ‘মামা, বাপে আমারে এতিমখানায় ভর্তি করিয়ে মৌলভি বানাতে চেয়েছিলেন। মাদ্রাসায় একদিন দেখি, হুজুর ছাত্রদের অনেক মারতেছে। দেখে কাপড়চোপড় গুছিয়ে পালিয়ে চলে আসি।’

ফরহাদকে দেখতাম সকালে তার কৃষক বাবার পিছু পিছু মাঠে চলে যেত কৃষিকাজ করতে। বাবা যখন লাঙল দিয়ে জমি চাষ করত, ফরহাদ মইয়ের ওপর বসে থাকত লাঠি ধরে। গরু লাঙল টেনে মাটি আলগা করত। সে মইতে বসে মজা পেত। তার বাবা লাঠি দিয়ে গরুর পিঠে জোরে আঘাত করত, গরু যাতে দ্রুত হাঁটে। ফরহাদ বলত, ‘বাবা গরু অবুঝ প্রাণী। ওদের এভাবে মেরো না।’ সে মাঝেমধ্যে কাদামাটি হাতে নিয়ে মাটির ঘ্রাণ শুঁকত। মাটির ঘ্রাণে তার মন ভরে যেত। মাটির সঙ্গে মনের কোথায় যেন মিল খুঁজে পেত।

একদিন দেখি, গোরস্তানে কবর খনন করছে ফরহাদ। প্রতিবেশী কেউ মারা গেলে সে কবর খননের কাজে এগিয়ে যায়। শৈল্পিকভাবে খুন্তি চালায় কবরের গায়ে। সাড়ে তিন হাত মাটির বিছানা সে এত সুন্দর করে তৈরি করতে পারে যে বিশ্বাস হচ্ছিল না। খনন করার পর কবরেও শুয়ে দেখছে, মাটি সমান আছে কি না। লিয়াকত ভাই, শামসু চাচা জানাল, কিশোর বয়স থেকে ফরহাদ কবর খনন করার কাজটি ভালো করে রপ্ত করেছে।

ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠে ফরহাদ, টগবগে যুবক। একদিন প্রতিবেশীরা জানাল, সে প্রায় ৪০০ লোকের বেশি মানুষের কবর খুঁড়েছে বিনা পয়সায়। শুধু তা–ই নয়, মাঝরাতে কেউ মারা গেলে খবর শোনামাত্র বিছানা ছেড়ে মৃতের বাড়িতে হাজির। মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেওয়া, কবর খনন করা, খাটিয়া কাঁধে করে নিয়ে আসা সব কাজের কাজি।

বছর কয়েক পর শুনলাম, ফরহাদ রেমিট্যান্স–যোদ্ধা হিসেবে বিদেশে পাড়ি দেবে। মুঠোফোনে বলল, ‘মামা, মাফ করে দিয়েন চলার পথে যদি মনে কষ্ট দিয়ে থাকি। দুবাই শহরের ভিসা পেয়েছি। বিদেশে গিয়ে দেশের জন্য টাকা পাঠাব। দেশ উন্নত হবে।’ কথা শুনে চোখ ভিজে এল।

যেদিন সে প্রবাসে উড়াল দেবে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখি, এলাকার সবাই তার জন্য ভালোবাসা, দোয়া ও শুভকামনা জানাচ্ছে।

অর্ধযুগ পরে একদিন ফাতেমা বুবুর সঙ্গে রাস্তায় হঠাৎ দেখা। হাসি দিয়ে বলল, ‘ভাইয়া, আমার ছেলে ফরহাদ ভালো চাকরি পেয়েছে। টাকা জমিয়ে একটা জায়গা কিনে বাড়ি করেছি। অনেক দিন ঝুপড়িঘরে থেকেছি।’

ফরহাদকে নিয়ে লিখতে বসে চোখের কোণে জল গড়িয়ে পড়ছিল। আমাদের চারপাশে আছে অনেক অদম্য মেধাবী মানবিক কিশোর, যাদের স্বপ্ন ঝরে পড়ে শীতের ঝরে পড়া শুকনা পাতার মতো। শুধু শুকনা পাতার মর্মর ধ্বনিটা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। লালন ফকির এ জন্য গেয়েছিলেন—
‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।
মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি।।
এই মানুষে মানুষ গাথা
গাছে যেমন আলকলতা।
জেনে শুনে মুড়াও মাথা
জাতে ত্বরবি।।’

মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হওয়া যায়। সোনার মানুষ হতে না পারলে কোনো কিছুই কাজে আসবে না। মানুষকে ভালোবেসে মানুষ হও। ফরহাদ শুধু মানুষকে ভালোবাসেনি, সে নিজের দেশকেও ভালোবেসেছে। একজন ভালোমানুষের প্রতিচ্ছবিও তার মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলাম।

উপদেষ্টা, পটিয়া বন্ধুসভা