তখন বর্ষাকাল। শ্রাবণের শেষ। যত দূর মনে পড়ে আগস্টের ১১ কি ১২ তারিখ। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে ঠিক হলো নীলগঞ্জের এক পরিত্যক্ত জমিদারবাড়ি ঘুরতে যাওয়া হবে। আমি ভ্রমণপ্রেমিক মানুষ। ঘুরতে যাওয়া হবে শুনেই লাফিয়ে উঠলাম। কিন্তু সুমন ইতস্তত করতে লাগল। সে নাকি রফিকের সঙ্গে গত বছর সেখানে বেড়াতে গিয়েছিল। রাতে খটখট শব্দ শুনেছে। আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। মাস্টার্স পাস একটা ছেলে কী করে ভূত বিশ্বাস করে?
আমরা সবাই যাচ্ছি দেখে শেষে সে–ও দোনোমনা করতে করতে রাজি হয়ে গেল। মনে হলো একটা আপদ জুটল। ভূতে ভয় পাওয়া মানুষের হাজার সমস্যা। একা একা ঘুমাতে ভয় পাবে, কিছু একটা শব্দ হলেই চট করে জেগে উঠে সারা বাড়ি মাথায় তুলবে। ভূতের ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপবে। আলনায় জামা ঝোলানো আছে, অন্ধকারে সেটা দেখেই ভূত ভেবে ভয় পেয়ে রাতদুপুরে সবাইকে জাগাবে। যত জ্বালা! রাত জেগে জেগে হরর মুভি দেখা আমার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আমার ভয় করে না, বরং আনন্দ হয়। কেন হয় কে জানে!
আমার বন্ধুরা তখন সবাই গভীর ঘুমে। আমিও শুয়ে ছিলাম, কিন্তু ঘুম না আসায় উঠে এসেছি। অন্যরা যে যার মতো শুয়েছে—করিডরের অন্য প্রান্তে।
শুনেছি রফিকের দাদা জমিদার ছিলেন। অত্যাচারী-স্বৈরাচারী জমিদার। গ্রামের মানুষ তাঁর ভয়ে কাঁপত। তিনি গ্রামের মানুষের জমি দখল করতেন, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিতেন, গাঁয়ের মানুষ মেরে ফেলতেন বিনা অপরাধে। একদিন হঠাৎ তিনি আত্মহত্যা করলেন! গাঁয়ের অনেকে বলাবলি করে, তিনি নাকি গভীর অমাবস্যা রাতে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন, আবার কেউ বলে গলায় ফাঁস দিয়ে। কোনটা সত্য কেউ জানে না। তারপরই এল বিপর্যয়। অবিবাহিত বড় ছেলে মারা গেলেন বিষক্রিয়ায়, আর ছোট ছেলের লাশ উদ্ধার করা হলো ফ্যানে ঝুলে থাকা অবস্থায়। ছোট ছেলের স্ত্রী অর্থাৎ রফিকের মা রফিককে নিয়ে চলে আসেন তাঁর বাবার বাসায়। সেখানেই বড় হয় রফিক। তারপর চাকরিসূত্রে ঢাকায় আসা। গুলশানে মাকে নিয়ে একটা বাসা ভাড়া করে থাকে।
সেই থেকেই জমিদারবাড়ি জনশূন্য। একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে রফিকের সেখানে যাতায়াত আছে। এক কেয়ারটেকার অবশ্য রফিক রেখেছে, ঝাড়ামোছা করার জন্য। আগে তিনি জমিদারবাড়িতেই থাকতেন। কিছুদিন হলো তিনি পরিবার নিয়ে পাশে এক বাড়িতে ভাড়া থাকেন। এক রাতে তাঁর ছোট মেয়ে কী দেখে যেন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। তাঁরাও অবশ্য রাতে এটা–সেটা শব্দ পান। গভীর রাতে বাড়ির পাশে একটা কুকুর করুণ স্বরে ডাকাডাকি করে। দিনের বেলা কুকুরটিকে কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না। রাতে কোথা থেকে আসে, কারও জানা নাই। এর পর থেকেই কেয়ারটেকার মতিন মিয়া তাঁর পরিবার নিয়ে পাশের এক বাড়িতে ভাড়া থাকেন।
রাত প্রায় ১টা পর্যন্ত আড্ডা দিলাম। ঠিক হলো আগামী শুক্রবার সকাল ৬টায় নন্দীপুর রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে নীলগঞ্জ স্টেশন যাব। সেখান থেকে জিপে করে নীলগঞ্জ জমিদারবাড়ি।
‘ওরে বাবা! কী বিরাট বাড়ি!’ নিলয় বলে উঠল। বাড়িটা আসলেই বিশাল। রফিক বলেছিল প্রায় ৪ বিঘা জমির ওপর এই জমিদারবাড়ি। বোঝাই যায় ক্ষমতা প্রতিপত্তি কোনো কিছুরই অভাব ছিল না জমিদার বাবাজির। কিন্তু ওই যে একটা কথা আছে না, ভাগ্য?
দিনের বেলাতেও যেন অন্ধকার এখানে–সেখানে জমাট বেঁধে আছে। একটু আগেই একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। জমিদারবাড়ির রাজকীয় প্রবেশদ্বার থেকে যে রাস্তাটা ভেতরের দিকে চলে গেছে, সে রাস্তাটা কাদায় প্যাঁচপ্যাঁচে। ভেজা পাতাগুলোর ওপর দিয়ে হাঁটতে আওয়াজ হচ্ছে।
একটু আগেই সন্ধ্যা নেমেছে। জায়গাটা ভারি অন্ধকার। প্রযুক্তির অগ্রগতির ছোঁয়া এদিকে এখনো পৌঁছায়নি। নেটওয়ার্ক তো দূরের কথা, বিদ্যুৎ পর্যন্ত নেই। জায়গাটা ভারি সুন্দর। চারপাশে সব বড় বড় রেইনট্রিগাছ। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে দেখতে বড় ভালো লাগছে। হঠাৎ দেখি গাছের কালচে পাতাগুলোর মাঝে সাদা ধোঁয়ার মতো কী একটা যেন। কী হতে পারে? সাদা কাপড়? কিন্তু অত ওপরে সাদা কাপড় কীভাবে আসবে?
‘আরে! তুই এখানে কী করছিস? ডাইনিংয়ে খাবার দিয়েছে, খেতে যাবি চল।’ খেতে চলে গেলাম। খেতে খেতে অবশ্য গাছের ডালের রহস্যময় সাদা কাপড়ের কথা কিছুই মনে রইল না। খাবারদাবারের আয়োজন অবশ্য বেশ—দেশি মুরগির মাংস, ভুনা কবুতরের মাংস, মসুরের ডাল, আলুর চপ আর আলুর ভর্তা। মনে হলো স্বর্গের কোনো অমৃত। কেয়ারটেকারের স্ত্রী পাশেই ছিলেন। তাঁর হাতের রান্নার প্রশংসা করতেই লাল হয়ে গেলেন। খাওয়াদাওয়া অবশ্য হারিকেনের আলোতেই করতে হলো। খারাপ লাগল না। গ্রামীণ অনুভূতি।
‘সাব, ঘুমাইবেন না?’ রাত অবশ্য খুব বেশি হয়নি। মাত্র ১০টা। তবু প্রত্যন্ত অঞ্চলে একে নিশুতি রাত বলেই মনে হচ্ছে। যাবার সময় কেয়ারটেকার নিচু গলায় বলে গেলেন, ‘ভাই সাব, এত রাইতে এইহানে এ্যাহা এ্যাহা থাইকেন না। কহন কী অয় কওন যায় না। যান ঘুমাইয়া পড়েন।’ বলেই তিনি ‘রাম রাম’ বলতে বলতে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। আর আমার যা হাসি পেল। আমাকে দেখাচ্ছে ভূতের ভয়? হা! হা! হা!
আমার বন্ধুরা তখন সবাই গভীর ঘুমে। আমিও শুয়ে ছিলাম, কিন্তু ঘুম না আসায় উঠে এসেছি। অন্যরা যে যার মতো শুয়েছে—করিডরের অন্য প্রান্তে। আমার ঘরটা করিডরের এ প্রান্তে। যদিওবা বিশাল বাড়ি, ঘরের অভাব নেই। তবু সব ঘরে থাকার মতো অবস্থা নেই। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রেইনট্রিগাছগুলোর দিকে তাকিয়ে আছি। ঠান্ডা হাওয়া বইছে। বেশ ভালো লাগছে।
‘হা হা হা’ হঠাৎ কার যেন খিলখিল হাসির শব্দ পেলাম। কেউ কি আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে? না, তা কী করে হয়? পুরো বাড়িতে আমরা ছয় বন্ধুই আছি শুধু। বাকিরা ঘুমিয়েছে। ওদের নাক ডাকার আওয়াজ পাচ্ছি। পুরো বাড়িতে শুধু আমিই জেগে আছি। তবে হাসল কে? ভয় পাওয়ার মতো ছেলে আমি নই। ‘কে? কে ওখানে?’ প্রাণপণ চেষ্টা করেও গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারলাম না। টের পেলাম গলা শুকিয়ে কাঠ। ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালাতে যাব তখনই কে যেন বরফের মতো ঠান্ডা হাতে আমার গলা টিপে ধরল। স্যাঁতসেঁতে এক গন্ধ নাকে এল। সেই সঙ্গে রক্তের মিষ্টি গন্ধ। আহা! কী সুন্দর সেই গন্ধ!
আমি দাঁড়িয়ে আমার ঘুমন্ত পাঁচ বন্ধুর সামনে। দূরে কোনো এক গির্জার ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত বারোটা বাজল। আমার নাকে আবার রক্তের সেই মিষ্টি গন্ধ এসে ধাক্কা দিল। হঠাৎ আমার খুব তৃষ্ণা পেল। রক্ত তৃষ্ণা!
বন্ধু, রংপুর বন্ধুসভা