মানুষ আর মানবতার জয়গান প্রফুল্ল রায়ের ‘ঈশ্বরপুত্র’

প্রফুল্ল রায়ের ‘ঈশ্বরপুত্র’

মানুষের সংস্পর্শেই মানুষের বেড়ে ওঠা। জন্মের পর থেকে চারপাশের মানুষদের দেখতে দেখতেই প্রাণিজগতের মানুষ নামক প্রাণীটির জীবনযাত্রা চলমান থাকে মৃত্যু পর্যন্ত। বিশ্ব, দেশ, সমাজ এবং সর্বশেষ কিংবা শুরুর পরিসর পরিবারেই মানুষ তার জীবনলীলা চলমান রাখে।

একটু একটু করে এক-দুই থেকে শুরু করে সদস্য বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে পরিবার তৈরি হয়। জীবনে সব সময় পরিচিত মানুষেরাই কেবল পরিবারের সদস্য হয়ে থাকবে, এমন নিয়মেরও ব্যতিক্রম হয়। প্রকৃতির নিয়মে অনেক সময় অপরিচিত ব্যক্তিরাই ধীরে ধীরে পরিবারের সদস্য হয়ে ওঠে। সমাজের নিয়ম মেনে সব পরিবারের গঠন এক হয় না। শুধু রক্তের সম্পর্কের কেউ কিংবা সামাজিক নিয়ম মেনে বন্ধনে আবদ্ধ মানুষই শুধু পরিবারের সদস্য হবে, এমন নিয়ম সব জায়গায় খাটে না।

লেখক প্রফুল্ল রায় রচিত ‘ঈশ্বরপুত্র’ বইটিতেও সে রকম মানুষের জন্য কাজ করা মানুষের কথাই তুলে ধরা হয়েছে। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মাইকেল সমরেশ দত্তের শেষজীবনের পরিবারিক পরিবেশটাও ছিল ঠিক এমনই। যা নিয়ে এগিয়ে গিয়েছে উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।

প্রায় শত বছরে পদার্পণ করা কলকাতার নিউল্যান্ড এলাকাটি নানা ধর্মের মানুষের অবস্থানে গড়ে উঠেছে। শুরুতে জনসংখ্যা কম হলেও সময়ের পরিবর্তনে তা বৃদ্ধি পেয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও সব ধর্মের মানুষের একসঙ্গে মিলেমিশে থাকার মধ্যে কোনো প্রভেদ সৃষ্টি হয়নি।

মূল চরিত্র মাইকেল সমরেশ দত্তের শেষ সময়ের পরিবারের বর্ণনা করতে গেলে বুঝতে পারা যায়, এই সমাজে এমন মানুষ খুব কম হয়। ওনার স্ত্রী নিরুপমা গত হয়েছেন অনেক দিন, দুই সন্তানই বিদেশে থাকে। ছেলে রজত অস্ট্রেলিয়া আর মেয়ে সুমিত্রা কানাডায় থাকে পরিবার নিয়ে। ওনার সংসারে যারা থাকে তারা হলো, ডিংকা—অসুস্থ অবস্থায় রাস্তা থেকে তুলে এনে সুস্থ করা কুকুর; সন্ধ্যা—স্বামীর অত্যাচারে মা-বাবা ও আশ্রয়হীন কাজের মেয়ে; জননী—রাস্তায় পাওয়া ৭-৮ বছরের বোবা ও বধির একটি শান্ত মেয়ে। আরও থাকে একজন, ঘটনার কালক্রমে উপস্থিত হওয়া নারী পাচারকারীদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া মেয়ে সরস্বতী। এই সেই মেয়ে, যে বড়দিনের রাতে গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে যায় এবং কয়েকজনের সহায়তায় তাকে হাসপাতাল নিয়ে যান সমরেশ। সেখানে চিকিৎসা করিয়ে এবং বাড়িতে রেখে যত্ন করে, ৭৩ বছর বয়সের পরোপকারী ব্যক্তি সমরেশ সুস্থ করে তুলেছিলেন ডাক্তার, পুলিশ অফিসার আর প্রতিবেশীদের সহায়তায়। স্মৃতিশক্তি হারিয়ে যাওয়ার পরও মেয়েটি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন পেয়েছিল। যাকে রক্ষা করতে গিয়ে তিনি আহত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন এবং চার দিন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।

সমাজে প্রতিটি মানুষই নিজেদের পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষা এবং দায়িত্ব সামাল দিতেই ব্যস্ত। সেখানে এসব করেও সমাজের অন্য সবার খোঁজ রাখা, বিপদে–আপদে এগিয়ে যাওয়া, নিজের চাহিদা সীমিত করে অন্যদের সুবিধা দেওয়া, অন্যের অভাব দূর করা ইত্যাদি কাজগুলো মানবিক হলেও সবাই করতে পারে না। হাতে গোনা হয়তো এক-দুজন পাওয়া যায় এমন স্বভাবের, যাঁরা আজীবন শুধু মানুষের জন্যই নিজের জীবনের সমগ্র দিয়ে যান। ইতিহাসও হয়তো তাঁদের মনে রাখে না। তবু গল্প, কথা, উপন্যাস কিংবা অন্য অনেকভাবে তাঁরা বেঁচে থাকেন এবং বারবার ফিরে আসেন বিভিন্ন মানুষরূপে।

বিয়ের পর স্ত্রীর জন্য ধর্ম পরিবর্তন করে সমরেশ দত্ত থেকে মাইকেল সমরেশ দত্ত হওয়া লোকটি ছিলেন তেমনি একজন। নিজের মায়ের থেকে পাওয়া শিক্ষা কাজে লাগিয়ে ছিলেন আমৃত্যু। মায়ের মতো শিক্ষকতা পেশাকে বেছে নিয়েছিলেন এবং মানুষের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে মানুষ করেছেন সমাজের অসংখ্য মেধাবীকে। উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রে যা প্রকাশ পেয়েছে সুন্দর উপস্থাপনের মাধ্যমে।

নিউল্যান্ডের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি সমরেশ দত্ত জাত–ধর্ম–বর্ণ–গোত্র উপেক্ষা করে মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, থেকেছেন, বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছেন। যে কারণে খ্রিষ্টানদের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান বড়দিনে নিজ ধর্মের মানুষের পাশাপাশি অন্য ধর্মের লোকদেরও সাহায্য–সহায়তা করে তাদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিয়েছেন সব সময়।
সমাজের শেষ ভরসার স্থান হয়ে ওঠা এই মাইকেল সমরেশ দত্তরাই স্বামীর বেধড়ক মার খেয়ে সংসার থেকে বিতাড়িত হওয়া মেয়ে সন্ধ্যাকে আশ্রয় দেন, বলতে ও শুনতে না পারা রাস্তায় পড়ে থাকা স্বল্প বয়সের শিশু জননী ওনার আশ্রয় পায়, অবুঝ অসুস্থ কুকুর প্রাণীকেও ওনারা আপন করে নেন। আবার বিপদ আছে জেনেও বিহার থেকে নারী পাচারকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে আসা এতিম মেয়ে সরস্বতীকেও নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখান। এমনকি ভারতী এবং সন্দীপের মতো দুজন দুই ধর্মের ভালোবাসায় জড়িত ব্যক্তিদেরও ভালোবেসে পারিবারিকভাবে বন্ধনে আবদ্ধ করে দেওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যান।

মাইকেল সমরেশ দত্তের মতো এমন লোক আছেন বলেই হয়তো সমাজে এখনো মানবতা বেঁচে আছে আর টিকে থাকে, কিংবা বলা যায় টিকে ছিল এবং ভবিষ্যতেও টিকে থাকবে। এই আশাটুকু করা যায়। আর এমন ব্যক্তিরা আছেন বলেই হয়তো সমাজে এখনো মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করে। মানুষের মধ্যে বিরাজমান সৃষ্টিকর্তার ওপর মানুষ ভরসা রাখে। প্রচলিত কথা, মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য—কথাটা যেন সার্থকতা পায় এই ‘ঈশ্বরপুত্র’ উপন্যাসের পাতায় পাতায় লেখা শব্দগুলোতে।

হাজীপুর, নরসিংদী