স্মৃতির অ্যালবাম

অলংকরণ: তুলি

মনে পড়ে বন্ধুসভার সেই প্রথম দিনের কথা। সে-ও অনেক বছর আগে। সময় বয়ে গেছে অনেক। সেই গোড়ার কথা আজকের বন্ধুরা হয়তো কল্পনাও করতে পারবে না। তখন মতি ভাই (প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান) ভোরের কাগজে ছিলেন। অফিস ছিল বাংলামোটর। তখন কিন্তু এ সংগঠনের নাম বন্ধুসভা ছিল না। বলতাম পাঠক ফোরাম। সে সময়ের বন্ধুদের মধ্যে ছিল গিয়াস ভাই, সুমন্ত আসলাম, মেজবাহ আজাদ, ফারুক আহমেদ, ফারুকীসহ আরও অনেকে। বন্ধুসভার রুমে প্রবেশ করতেই বললেন, ‘আরে! নতুন বন্ধু, বসতে দাও।’ একসঙ্গে তিনজন চেয়ার ছেড়ে দিল। আলোচনা শেষে করতালি দিয়ে অভিনন্দন! সেই শুরু বন্ধুসভার সঙ্গে পথচলা। সময়ের সঙ্গে চলতে গিয়ে প্রায় সবাই যে যার পেশায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বন্ধুসভার সঙ্গে জীবনের কত স্মৃতি। কত আনন্দ-বেদনার গল্প আছে। বলে শেষ করা যাবে না। অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে গেছে বন্ধুসভা। এক জীবনে হয়তো এ সম্পর্ক শেষ হওয়ার নয়। শারীরিকভাবে বিচ্ছিন্ন হলেও মানসিকভাবে সম্পর্ক থেকে যাবে চিরকাল। সেই যে ভোরের কাগজে প্রথম যেদিন বন্ধুসভায় এসেছিলাম, সেদিনও মনে হয়নি আমি এখানে অচেনা-অজানা কেউ।

বন্ধুসভার সবাই মিশুক। হাসিখুশি প্রাণবন্ত। সব কাজ ফেলে সময় কাটাতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছা করে আড্ডা দিতে। বন্ধুসভায় এসে প্রথম দিনই নিজের মধ্যে একধরনের পরিবর্তন অনুভব করি। যারা এখানে আসে, তারা এ পরিবর্তন বুঝতে পারে। যেখানেই যাই, বন্ধুসভার সদস্য হিসেবে গর্ববোধ করি। আবার অনেকেই এর সদস্য হতে চায়। তারা হতাশা ব্যক্ত করে বলে, ‘যদি বন্ধুসভার সদস্য হতে পারতাম! সবার বন্ধু হতে পারতাম!’

আসলে বন্ধুসভার সদস্য হওয়া কঠিন কোনো কাজ নয়। কেউ যদি বন্ধুসভার নীতি-আদর্শ ধারণ করে, তাহলে সে-ও একজন বন্ধু। বন্ধুরা অসহায় মানুষের জন্য কাজ করে। দেশের জন্য কাজ করে। নিজেকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কাজ করে—গান, বিতর্ক, লেখালেখি, আবৃত্তি, বই পড়া। ভাষা প্রতিযোগ, গণিত অলিম্পিয়াড, মাদক-অ্যাসিডের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনাসহ নানাবিধ সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকে। বন্ধুরা মনে করে, নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে হতে হবে সবার।

বন্ধুদের ভালো কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বন্ধু চত্বর’ নামে একটি চত্বর রয়েছে। বন্ধুরা নিজেদের উজাড় করে অন্যকে ভালোবাসে। অনেক ঝুঁকি নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ায়। কোনো বন্ধুর হয়তো নিজের ঘরে খাবার নেই। বাড়িতে না খেয়ে আছে। অথচ সে অন্যের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে। এ-ই হলো বন্ধুসভা। সিডরে ত্রাণ দিতে গিয়েছিলাম বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা দুর্গম এক চরে। ফেরার পথে ডুবোচরে আটকে যাই। সেদিন জীবন-মৃত্যু ছিল একসঙ্গে। অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে অনেকেই কেঁদে ফেলেছিল। অবশেষে সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলাম। সেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আজও ভুলতে পারিনি।

বন্ধুদের কাজের এমন অনেক উদাহরণ আছে। বিভিন্ন সময় বলে থাকি, ঘরের বাইরে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ জায়গা বন্ধুসভা। সুযোগ পেলেই ছুটে যেতে ইচ্ছা করে। মনটা পড়ে থাকে ওখানেই। আর একবার কেউ বন্ধুসভার বন্ধু হলে সে সারা জীবনই বন্ধু। সারা দেশে বন্ধুসভার রয়েছে লাখো বন্ধু। সবাই একসঙ্গে জেগে উঠলে আমরাই পারব একটি স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে।