সময়ের সওয়ার

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আজ সন্ধ্যায় টিউশনি শেষে ঢুঁ মারলাম সাইবারে। কোনো কাজ নাই, তবু মেইলটা ওপেন করলাম। সেখানে লেখা ‘ডিয়ার সজল, প্লিজ মিট মি অন ফ্রাইডে মর্নিং অ্যাট নাইন এএম’। রিপ্লাই দিয়ে জানালাম, আমি আসব।
যথাসময়ে হাজির হলাম। বেতনের বিষয় নিয়ে আলাপ হলো। নির্ধারিত হলো ২০ হাজার টাকা। আগামীকাল যোগদান করতে হবে। অফিসে গেলেই যোগদানপত্রটি দেওয়া হবে। মন ফুরফুরা লাগছে।

কিন্তু রাস্তায় নেমেই মেজাজটা বিগড়ে গেল। জনতার মুখে আতঙ্ক। আগামীকাল হরতালের ডাক দিয়েছে বিরোধী দল। কাল অফিসে যে যেতে হবে! চিন্তায় পড়ে গেলাম। ভাবলাম, যা হবার হবে। আগে আম্মা-আব্বাকে ফোন করে খুশির খবর দিই।

ফোন দিতেই বোন শায়লার আবদার,‌ প্রথম মাসের বেতন পেয়ে আমাকে একটা ঘড়ি আর একটা জামা দিতে হবে। আম্মা এ কথা শুনে বললেন, ‘খোকা, ও বললেই শুনিস না। প্রথম মাসে ঘড়ি কিনা দিস, পরের মাসে জামা দিস। তুই বেশি বেশি বই কিনা পড়ালেহা কর। সামনের বিসিএস পরীক্ষায় ম্যাজিস্ট্রেট হউন লাগব কিন্তু। আমি তরে বই কিননের টেকা দিতে পারি নাই দেইখ্যা গতবার পাস করত পারস নাই। বাবা, এইবার তোর পাস করনই লাগব।’
‘আম্মা, তুমি বেশি বেশি কইরা দোয়া কইরো, তাইলে আমি পারামই।’
‘বাবা, কাইলকা হরতাল, সাবধানে যাইও। পথঘাট ভালা কইরা দেইখা যাইও।’
‘আম্মা, তুমি চিন্তা কইরো না।’

নতুন অফিস, নতুন মানুষ। মাস শেষে আমাকে আর ধারদেনা করতে হবে না ভেবেই শান্তি পাচ্ছি। তবে শুনেছি, বেসরকারি অফিসে মালিককে তোষামোদ করে টিকে থাকতে হয়। সেই সঙ্গে কাজেরও হিসাব থাকে না। যখন যা হুকুম, তা-ই সামলাতে হয়। তবে কাজ নিয়ে ভাবছি না। আর তোষামোদ আমার দ্বারা হওয়ার নয়।

আম্মা কত চিন্তা করে আমাকে নিয়ে। তার কাছে মনে হয় সবচেয়ে সেরা চাকরি মানেই ম্যাজিস্ট্রেট হওয়া। বিসিএসে সব ক্যাডারের চাকরিই সম্মানের। প্রশাসন ক্যাডারের লোকদের দাম্ভিকতা আর অহংকারে ওই চাকরি মোটেও ভালো মনে হয় না। প্রশাসনিক জটিলতায় তারা লাল ফিতা দিয়ে সরকারি ফাইলকে বন্দিদশায় ফেলে ফায়দা লুটে। কেউ কেউ অমায়িকও হন; তবে তাঁদের সংখ্যা হাতেগোনা।

রাতে শুয়েছি ঠিকই; কিছুতেই ঘুম আসছে না। হুমায়ুন আহমেদের ফাউনটেন পেন বইটি চোখের সামনে মেলে ধরলাম। পাতা ওলটাতে ওলটাতে চোখ গেল ‘বৃষ্টি নেশা ভরা সন্ধ্যাবেলা’ গল্পটির দিকে। গল্পটি এক নিশ্বাসে পড়ে যাচ্ছি। বৃষ্টি আমার খুব পছন্দের।
অফিস যাওয়ার উত্তেজনায় সারা রাত বারবার ঘুম ভেঙেছে, ভোরে ক্ষুধায় পেট চুঁ চুঁ করছে। বেশ ক্ষুধা লেগেছে। ঘরে কিছু নেই যে খাব। ব্যাচেলর লাইফ, খাদ্য বিষয়ে সম্পূর্ণ বুয়ানির্ভর। যা রাঁধে, তা-ই খাওয়া। বাড়তি কিছু থাকে না। এক গ্লাস পানি গলাধঃকরণ করলাম আর বুয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। এর মধ্যে রেডি হলাম। কিন্তু বুয়ার খবর নাই। কাল এসে ইনিয়েবিনিয়ে এমন এক বাহানার বিষয় নিয়ে আলাপ করবে, যা শুনে কিছুই বলতে ইচ্ছা করবে না।

রাস্তায় খুব বেশি মানুষ নেই। আহা রে! ঢাকা যদি এমন হতো সব সময়। একটু চিন্তাও হচ্ছে। নতুন অফিস, নতুন মানুষ। মাস শেষে আমাকে আর ধারদেনা করতে হবে না ভেবেই শান্তি পাচ্ছি। তবে শুনেছি, বেসরকারি অফিসে মালিককে তোষামোদ করে টিকে থাকতে হয়। সেই সঙ্গে কাজেরও হিসাব থাকে না। যখন যা হুকুম, তা-ই সামলাতে হয়। তবে কাজ নিয়ে ভাবছি না। আর তোষামোদ আমার দ্বারা হওয়ার নয়। যাক, আগে তো শুরু করি। তারপর ভাবা যাবে। যতটা দুশ্চিন্তায় ছিলাম, তেমনটি ঘটেনি। চার-পাঁচ দিন হয়ে গেল, নিজের ডেস্কে বসে কাজ করেই কেটেছে বেশির ভাগ সময়। তরিকুল স্যারকে বেশ ভালো মানুষই মনে হচ্ছে।

এরই মধ্যে ব্যস্ততায় তিন মাস কেটে গেল। টেরই পেলাম না। মায়ের শরীরটা ভালো নয়। ঠান্ডা লেগে গলা বসে গেছে। ভাবছি, অফিস থেকে দুদিনের ছুটি নিয়ে মাকে ডাক্তার দেখিয়ে আসব। কিন্তু তরিকুল সাহেবের মেয়ের বিয়ে হওয়ায় তিনি ছুটিতে আছেন। তাই আমার ছুটিতে যাওয়া যাবে না। মাকে ফোন দিলাম। মায়ের কথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। শায়লার সঙ্গে কথা বললাম। বিসিএসের ফরম ফিলাপ করেছি, জানালাম।
‘ভাইয়া, মা খুব খুশি হইছে। বলছে সে নফল নামাজ পড়ে তোমার জন্য দোয়া করবে।’
‘আগে তো পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হই, তারপর মাকে খুশি হতে বল।’
‘তুমি উত্তীর্ণ হবে নিশ্চয়ই, ইনশা আল্লাহ।’
‘সেইভাবে তো প্রস্তুতি নিচ্ছি। দেখি সামনে কী হয়।’
‘ছোট কাক্কু মাকে বলেছেন, তোমার যদি টাকা লাগে, তাইলে তিনি দেবেন। দরকার অইলে দু-এক মাস চাকরি করতে মানা করছেন।’
‘আরে পাগলী, চাকরি কি ইচ্ছা হলেই ছেড়ে দেওয়া যায়? পরে পাব কোথায়? ওর মধ্যেই পড়তে হবে। কাক্কুকে চিন্তা করতে মানা করিস।’
‘মাকে কাল হাসপাতালে নিয়া গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ কিনে দিস।’
‘ঠিক আছে ভাইজান।’

অফিসে গিয়ে বসলাম। এর মধ্যেই বড় স্যার আলীম সাহেবের পিএস এসে বললেন, স্যার দেখা করতে বলেছেন। ধীরগতিতে হেঁটে যাচ্ছি আর চিন্তা করছি কেন ডেকেছেন। দরজায় দাঁড়াতেই দেখতে পেলাম, স্যারের কক্ষে একজন অল্প বয়স্ক মেয়ে বসে আছে। একবার ভাবলাম, এখন ঢোকা উচিত হবে কি না? আবার ভাবলাম, নিশ্চয়ই মেয়েটার কোনো প্রয়োজনে আমাকে ডেকেছেন।
‘স্যার, আসব?’
‘নিশ্চয়ই, বসো।’
‘[মেয়েটার দিকে তাকিয়ে] আমার মেয়ে মৃদুলা। ওর প্রয়োজনেই তোমাকে ডাকা। কাল থেকে ও এই অফিসে তোমার পদেই জয়েন করছে। তুমি ওকে কাজ বুঝিয়ে দেবে, যখন প্রয়োজন হবে।’
‘মৃদুলা, ও খুব ভালো এবং নির্ভর করার মতো ছেলে। আশা করি তুমি ভালো শিখতে পারবে।’
আমি ভাবছি, উনি তো সরাসরি বস হিসেবেই জয়েন করতে পারেন, চাইলে ওপরে যেকোনো পদে।
‘ওকে আগে কাজ শিখতে হবে, তারপর আগাতে হবে। জানার কোনো বিকল্প নেই, বুঝলে। আস্তে আস্তে এগুলো ভালো না হলে হোঁচট খেতে হয়। ওর জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা ওকে এমনিতেই কাবু করে ফেলেছে। আমি আর কখনো চাই না কোনো কিছুতে আমার মেয়েটা আহত হোক।’

স্যারের চোখ ছলছল করছে। মৃদুলার চোখেও পানি। নিশ্চয়ই এমন কোনো ঘটনা আছে, যা উনাদের কষ্ট দিচ্ছে। আমি তো আর জিজ্ঞেস করতে পারি না তাঁদের ব্যক্তিগত বিষয়। স্যার স্বাভাবিক হওয়ার জন্য আমাকে উদ্দেশ্য করে প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন,
‘তোমার পরীক্ষা কবে? প্রস্তুতি কেমন নিয়েছ?’
‘স্যার, প্রস্তুতি ভালো। আর পরীক্ষা সামনের মাসের মাঝখানে।’
‘তুমি পরিশ্রমী ছেলে, ইনশা আল্লাহ হয়ে যাবে। আমি চাই, তুমি ভালো করো। যেখানে থাকো, আমার দোয়া সঙ্গে থাকবে।’
‘ধন্যবাদ, স্যার।’

স্যার ভীষণ ভালো মানুষ। এত উৎসাহ দেন সবাইকে, ইচ্ছা থাকলেও কেউ কাজে ফাঁকি দিতে পারবেন না। এত ভালো মানুষটাকে ঠকানো উচিত নয় কারোরই। তারপরও তো খারাপ লোকজন ঠকায় তাঁকে। মৃদুলার কথা ভাবছি, কী নিষ্পাপ অবয়ব চোখেমুখে। কে তাঁকে কষ্ট দিল? যা মনে হলেই ওঁরা কষ্ট পাচ্ছে, মেয়েটার জীবনে খারাপ অভিজ্ঞতা যোগ হলো! এই নশ্বর পৃথিবীতে কেন মানুষ এত খারাপ কাজ করে? অল্প কয় বছরের জীবন যেখানে, তবু প্রতিনিয়ত করছে হাঙ্গামা। স্বস্তি নেই কারও। সুন্দর একটা পৃথিবীর স্বপ্ন অনেক মানুষকে আবার ভাবায়ও। আদৌ কি তা সম্ভব? এই অসুন্দর হায়েনাদের মতো হিংস্র, লোভী মানুষদের জন্যই সম্ভব নয়।

মৃদুলা খুব তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন এবং স্থির প্রকৃতির। অল্পতেই কাজ বুঝে ফেলার ক্ষমতা আছে। মেয়েটার অসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব আছে। আমি কেন! যেকোনো ছেলেই মুগ্ধ হবে। বসের মেয়ে বলে কথা! ওসব ভাবনাকে বেশি পাত্তা দেওয়া যাবে না। চাকরি তাহলে নট। আমার ওপর পড়েছে তাঁকে কাজ শেখানোর ভার। অতএব সজল! আপনি এই ভাবনা পর্যন্তই ক্ষান্ত থাকুন! হা হা হা,
নইলে খেতের বেড়া খেত খেয়েছে দোষে দোষী হবেন। নিজেকে প্রবোধ দিলাম।

আমাকে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বেশ কিছুদিন ছুটি নিতে হলো। পরীক্ষা বেশ ভালো হয়েছে। এক দিনের জন্য বাড়ি গেলাম। মা, শায়লা, বাবাকে এবার অনেক দিন পর দেখলাম। মা আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরল। চাকরি পাওয়ার পর প্রথম আসা। সবার জন্য জামাকাপড় আনলাম। একসঙ্গে সবাই জামাকাপড় পেয়েছে, এটা এই প্রথম ঘটল আমাদের বাড়িতে। বাবা কিংবা আমার, দুজনেরই সাধ্যের বাইরে ছিল এত দিন। এমনকি ঈদেও নয়! কাপড় হাতে দিতেই মা খুশিতে কেঁদে ফেলল।
‘বাজান, আইজ আমরার ঈদ মনে অইতাছে।’
‘হ্যাঁ আম্মা, এহন থাইকা ঈদেও পাইবা।’
‘বাজান! আল্লাহ তোরে অনেক বড় করুক।’
আমার আসা উপলক্ষে মা চাচাদের দাওয়াত করেছে। সবাই রাতে হইচই করে একত্রে খেলাম। শায়লাটাকে বেশ বড় মনে হচ্ছে এক দিনেই। এত দিনে দেখতে মাশা আল্লাহ আরও সুন্দর হয়েছে। ওর দু-একটা বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে, বাবা খাওয়ার ফাঁকে আমাকে বললেন। আমি আব্বাকে বারণ করে দিয়েছি।
‘ওকে ঢাকায় নিয়ে অনার্সে ভর্তি করাব আগে, তারপর বিয়েটিয়ে দেখা যাবে।’

পুকুর ঘাটলায় বসে আছি। এমন সময় ফোন এল। তাকিয়ে দেখি, মৃদুলার নাম ভাসছে।
‘হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম।’
‘এমনভাবে সালামের উত্তর দিয়েছেন! মনে হচ্ছে বড় কেউ ফোন দিয়েছে!’
‘আপনি তো বড়ই, বয়সে না হলেও। তা ছাড়া ছোটদেরটাও সুন্দর করে নিতে হয়। আমরা জানি না বা মানি না।’
‘জ্ঞান দান হচ্ছে খুব! ভালো, বাবা জানতে চাচ্ছিল কাল অফিসে আসছেন কি না?’
‘না, কাল পর্যন্ত ছুটি। পরশু জয়েন করব।’
‘কোনো বিশেষ কাজ আছে কি?’
‘হ্যাঁ, ইংল্যান্ডের একটা টিম আসবে পরশু দিন। আপনাকে ওদের সঙ্গে থেকে অফিসের কাজগুলো দেখাতে হবে।’
‘অবশ্যই, ম্যাডাম মৃদুলা।’ দুজনেই হাসলাম একসঙ্গে।
‘ঠিক আছে তাহলে, আল্লাহ হাফেজ।’

কাজের বাইরে এমনিতে বেশি কথা বলে না মৃদুলা। এই মেয়েটাকে নিয়ে ইদানীং ভাবছি। কেন? তা জানি না। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিতে ভেজা গাছগুলোকে সুন্দর লাগছে ভীষণ। পাশের কদমগাছে ম্যালা কদম ফোটে আছে। আগে কখনো মনে হয়নি কদম এত সুন্দর। যদি মৃদুলা পাশে থাকত!
‘এমনি এক বরষায় ভিজে
পাশাপাশি হাঁটছি যেন
তুমি আমার হাতে কদম দিয়ে বললে
ভালোবাসি, ভালোবাসি।
আমি দ্বিধান্বিত!
আমাকে না কদমকে?
উত্তরে বললে দুটোই।
কোনটা বেশি প্রিয়?
সলাজে বললে, তুমি।
তোমায় ছুঁয়ে থাকা হাত কাঁপছে
এই বুঝি প্রেম!’

দুদিন ছুটি কাটানোয় অফিসে অনেক কাজ জমে গেছে। বড় স্যারের নির্দেশ মোতাবেক সব কাজ দুদিনে গুছিয়ে আপডেট করে অন্য কাজে হাত দিতে হবে।

এদিকে আলীম সাহেবের ইচ্ছা, সজল আর মৃদুলাকে একটা পরিণতিতে দেখবেন। তিনি এটুকু ভরসার জায়গা খোঁজে পেয়েছেন যে সজলের কাছে তাঁর মেয়ে ভালো থাকবে। বিপত্তি হলো, সত্যি ঘটনাটা সজল জানলে মৃদুলাকে গ্রহণ করতে না-ও পারে। তিনি মনে মনে স্থির করেছেন, সজলকে পাত্র হিসেবে যেহেতু পছন্দ হয়েছে, সে জন্য উনি নিজে তাকে মেয়ের সব ঘটনা খুলে বলবেন। তারপরও যদি সে রাজি থাকে, তাহলে দুজনের বিয়ে দেবেন।
এক বিকেলে অফিসের পর সজলকে থাকতে বললেন। যথাসময়ে ডাকা হলো কক্ষে।
‘তোমাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে না বলে সরাসরি বলি। তুমি সব শুনে যদি কোনো দ্বিধায় পরো তাহলে নির্ভয়ে আমাকে বলবে।’
‘ঠিক আছে, স্যার।’
‘মৃদুলাকে তোমার কেমন লাগে? এ কদিনে যতটুকু দেখেছ?’
‘স্যার, ও ভালো মানুষ, আন্তরিক, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন।’
‘ওকে যদি তোমার সঙ্গে বিয়ে দিই, তোমার আপত্তি থাকবে?’
‘স্যার, আপত্তি করার মতো কোনো কারণ আছে কি? যা জানি না।’
‘ওর জীবনে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা তোমাকে বলছি তবে। ওটা হয়তো তোমার আপত্তির কারণ হতে পারে। বাবা হয়ে এ ঘটনা লুকালে তোমার সঙ্গে প্রতারণা করা হবে। সে জন্য সব খুলে বলছি।

মৃদুলা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে তখন। থার্ড ইয়ারে। একটা ছেলের সঙ্গে ওর সম্পর্ক হয়। আমরাও তাকে পছন্দ করলাম। ছেলেটা আপাতদৃষ্টিতে বিনয়ী, সুভাষী। লন্ডনে একটা স্কলারশিপ হয়ে গেছে জানায় এবং তাকে নাকি মাসখানেকের মধ্যে বাইরে চলে যেতে হবে। আমরা দেরি না করে বিয়ে দেব সিদ্ধান্ত নিলাম। ছেলের আত্মীয়-পরিজনকে নিয়ে আসতে বললাম। সে তার এক মামাকে নিয়ে এল। সে জানাল, তার বাবা-মাকে আনতে পারবে না; তারা তার বোনের কাছে গিয়েছে বিদেশে। সব কথাই বিশ্বাস করে তার মামার কথায় বিয়ে দিলাম। বিয়ের পাঁচ দিনের মাথায় সে জানাল, তার পাঁচ লাখ টাকা লাগবে আর ব্যাংক জামানত দেখাতে হবে আরও ১২ লাখ টাকা। আমি সব করলাম।
পরে জানতে পারি, সে জার্মানিতে থাকে। ওখানে ড্রাইভিং পেশায় যুক্ত। দেখতে স্মার্ট আর পরিপাটি হওয়ার সুবিধা নিয়ে কয়েক বছর পরপর দেশে এসে পয়সাওয়ালা দেখে ফাঁদ পেতে বিয়ে করে এবং বউকে বিদেশে গিয়ে ডিভোর্স লেটার পাঠায়। ওখানে ওর বউ, বাচ্চা সবই আছে।’
‘আপনারা পুলিশকে খবর দেননি?’
‘ও বিদেশ গিয়ে যখন ছয় মাসেও কোনো যোগাযোগ রাখল না, তখন চারদিকে লোকজন লাগিয়ে এ তথ্য পাওয়া গেল। আমার সর্বনাশ যা ঘটল, তা আর শোধরানোর সুযোগ পেলাম না। আমার মেয়েটা আর বিয়ে করতেই রাজি হয় না। ও প্রায় গৃহবন্দী হয়ে দুইটা বছর কাটিয়েছে। নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে। একাকিত্বই ছিল তার সঙ্গী। একটা সময় নিজেকে সামলে আবার ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া শুরু করে। আমাদের জীবনে একটু শান্তি নেমে আসে।’
‘স্যার, আমি কিছুদিন সময় চেয়ে নিচ্ছি। আমার মতামত পরে আপনাকে জানাব। আপনাদের জন্য সমবেদনা জানাচ্ছি।’
‘ওকে, মাই বয়।’

সমস্ত ঘটনা শোনার পর বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি। কোনো কাজেই মনোযোগ দিতে পারছি না। একি শুনলাম! যা কল্পনাও করিনি। সত্যিকার অর্থে আসলেই মৃদুলাকে আমার মনে স্থান দিয়ে দিয়েছি। কিন্তু বিবাহিত কাউকে জীবনসঙ্গী করব, ভাবতে পারছি না।
প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করেছি নিজেকে নানাভাবে। যখন মেয়েটির অসহায়ত্বের কথা ভাবি, মনটা নরম হয়ে যায়। শায়লার কথা মনে হয়, যদি ওর জীবনে এমন ঘটত! আমরা কী করতে পারতাম?

একটা মেয়ে সেই দোষে দোষী হয়ে একাকী জীবন বয়ে বেড়াবে? এ ভীষণ যন্ত্রণা ও কষ্টের। ওরা তো কিছু লুকায়নি আমার কাছে। অন্য কেউ হলে হয়তো লুকিয়ে বিয়ে দিত।
সব ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলাম, মৃদুলাকেই বিয়ে করব। ও ভালো একটা মেয়ে, ওকে আমি দুঃখী দেখতে পারব না। সিদ্ধান্তের কথা তাদের জানালাম।