লাল-সবুজের বিজয়নিশান

লাল-সবুজের পোশাক ও মাথায় পতাকা নিয়ে সেজেছে ছোট্ট শিশুটি। প্রতীকীছবি: জাহিদুল করিম

ছয় বছরের ছোট্ট বালক রাইয়্যান। বাবার সঙ্গে বসে টেলিভিশনে অনুষ্ঠান দেখছে। টেলিভিশনে দেশাত্মবোধক গানের পাশাপাশি একটি ভাষণ দেখাচ্ছে। ভাষণের সঙ্গে সঙ্গে অজস্র মানুষ সমবেত কণ্ঠে বলে উঠছে, ‘জয় বাংলা’। সে তার বাবা জহিরুল ইসলামকে জিজ্ঞেস করে,
-আচ্ছা বাবা, টেলিভিশনে ওটা কী দেখাচ্ছে বারবার?
-ওটা ৭ মার্চের ভাষণ। যিনি ভাষণ দিচ্ছেন, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি আমাদের স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
-বাবা, স্বাধীনতা কী?
-তুমি মুক্ত আকাশে উড়ন্ত পাখি দেখেছ কখনো?
-হ্যাঁ, দেখেছি।
-তোমার একটি শালিক পাখি আছে, যেটি মা মা বলে ডাক শিখেছে?
-হুম।
-আচ্ছা, বলো তো, খাঁচার দরজা খুলে দিলে কী হবে?
-হি হি হি
-হাসছ কেন?
-তুমি জানো না বুঝি! খাঁচার দরজা খুলে দিলে পাখিটা উড়ে যাবে।
-ঠিক বলেছ। এটাই হলো ওর স্বাধীনতা। তুমি হয়তো শালিক পাখিটিকে খাঁচায় বন্দী করেছ ওকে ভালোবেসে। তাই পাখিটিকে খাঁচায় বন্দী করে ভালো ভালো খাবার দিচ্ছ, ভালোবাসছ, আদর করছ। তারপরও কিন্তু ও খুশি নয়। ওর স্বাধীনতা হলো, ও খোলা আকাশের নিচে উড়বে, পোকামাকড় খাবে, গাছের ডালে বাসা বাঁধবে, গান গাইবে, ওর সঙ্গী ও বাচ্চাদের সঙ্গে সুখে-শান্তিতে থাকবে। কিন্তু তুমি ওকে খাঁচায় আটকে রেখেছ বলে ও তা পারছে না। বন্দী জীবন কাটাচ্ছে। এখানেই ওর স্বাধীনতা নেই। ওকে তোমার ইচ্ছেমতো চলতে হচ্ছে। পাখিটি পরাধীন আর তুমি স্বাধীন। ঠিক তেমনি আমরাও একদিন পরাধীন ছিলাম।

-কখন বাবা?
-আচ্ছা, তবে শোনো। ১৯৪৭ সালে আমাদের ভারতবর্ষ দুটো ভাগে ভাগ হয়। একটি ভারত এবং অপরটি পাকিস্তান। পাকিস্তান ছিল দুটো অংশে বিভক্ত, একটি পশ্চিম পাকিস্তান, অপরটি পূর্ব পাকিস্তান। আমরা ছিলাম পূর্ব পাকিস্তানে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তান তথা আমাদের বাংলাদেশকে শাসন করত। কিন্তু ওরা শাসনের নামে আমাদের ওপর অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতন করত। তখন আমরা ছিলাম ওদের কাছে বন্দী, পাখির মতোই পরাধীন। আমাদের কোনো স্বাধীনতা ছিল না। সে সময় আমাদের এই বাংলায় এক মহান নেতার আবির্ভাব ঘটে। তিনিই আমাদের অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য উজ্জীবিত করেন, অনুপ্রেরণা দেন। কিন্তু এটি পশ্চিম পাকিস্তানিরা মেনে নিতে পারেনি। তারা বিভিন্ন রকম ষড়যন্ত্র করে।

আমাদের বাঙালিদের মধ্যে অধিকার ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে। বারবার পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে আন্দোলনে নেমে পড়ে অদম্য বাঙালিরা। স্বাধীনতা ও অধিকার আন্দোলন বেগবান হয় ১৯৭০ সালের নির্বাচনে, যখন আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দল জাতীয় প্রাদেশিক নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরও পশ্চিম পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করে। ওদের ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু এক অসহযোগ আন্দোলনের ভাষণ দেন, যেটি তুমি একটু আগে দেখেছ।

-তারপর কী হলো বাবা?
-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণে বাঙালিকে অধিকার আদায়ের সংগ্রামের জন্য আহ্বান জানান। তাঁর ঘোষণায় সবাই আশার আলো খুঁজে পায়। ধীরে ধীরে সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। এরই মধ্যে আসে সেই ভয়াবহ কালো রাত। পশ্চিম পাকিস্তানিরা উপায়ন্তর না দেখে এ দেশের মানুষকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে ২৫ মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ তথা নীলনকশা বাস্তবায়ন করে। ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ভারী অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে। ওই রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। তার আগে তিনি ওয়্যারলেসযোগে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণা করে যান। শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। অংশ নেয় নারী-পুরুষ, কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক, পুলিশ-আর্মিসহ দেশের সর্বস্তরের জনগণ। সহায়তায় এগিয়ে আসে ভারতীয় মিত্রবাহিনী। দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করে। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান পায় বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। তাই ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। এসব দিনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় সব স্থানে। সেই উপলক্ষে টিভিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানও হয়।

এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনছিল রাইয়্যান। বাবার কথা শেষ হলে বলে উঠল, ‘বাবা, আমিও কাল বাড়ির ছাদে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করব।’ ‘হ্যাঁ, বাবা। অবশ্যই সে ব্যবস্থা করব।’

পরদিন রাইয়্যানদের বাড়ির ছাদে সবাই মিলে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গায়। রাইয়্যানের গালে জাতীয় পতাকার নকশা করা হয়েছে। লাল–সবুজের ফতুয়া পরেছে সে।