বিরাণভূমির শোকার্ত আর্তনাদ
শেষ চিঠিটা কবে ডাকবাক্সে পাঠিয়েছিলাম, মনে নেই। সেই চিঠির প্রতি–উত্তর পাওয়ার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে অনেকটা বছর কেটে গেছে। স্মৃতির পাতায় জমা হয়েছে অনেক পাওয়া না–পাওয়া বিষাদের গল্প। বয়সের ছাপ এসেছে শরীরের ভাঁজে ভাঁজে। অনুভূতিজুড়ে এখন সংশয়ের বিড়ম্বনা। ভালো থাকার দিনগুলো ইতিমধ্যে শেষ হওয়ার পথে। চোখের জল শুকিয়ে চৌচির; দহনে পুড়ে ভস্ম হয়ে গেছে পাঁজরের মাংসপিণ্ড। ধোঁয়াশার অন্ধকারে তলিয়ে গেছে বিরাণভূমি। অথচ আমাকে ভালোবাসার সময় আপনার আর হলো না। শুনেছি, আপনি অনেক অভিমানী। কিন্তু এতটা আত্মকেন্দ্রিক, কখনো জানা ছিল না।
রোজ আপনার সঙ্গে কথা বলার অপেক্ষায় থাকি। কখনো আপনার পুরোনো স্মৃতি আওড়াতে আওড়াতে হেঁটে যাই পাতালপুরীর পথে। আপনার মন খারাপের দিনগুলোয় ছায়ার মতো পাশে থেকেছি। কখনো বিপদে পড়লে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। নিজের সর্বস্ব বিসর্জন দিয়েও আমি আপনার প্রিয়জন হয়ে উঠতে পারিনি। ভেবেছিলাম, কোনো একদিন আপনি আমার ভালোবাসা বুঝবেন। বুকে টেনে নেবেন পরম ভালোবাসায়। কিন্তু সেই ভাবনা আমার চরম মিথ্যে ছিল। শুনেছি, আমার জন্য আপনার কোনো অনুভূতি নেই। আমি কষ্ট পেলে আপনার কিচ্ছু যায়–আসে না। আমার প্রতি আপনার এত অবহেলা, বুঝতে পারিনি কখনো। বুঝতে পারলে কখনো বিরক্ত করতে আসতাম না। যখন বুঝতে পারলাম, তখন আমার ফিরে আসার সব পথ বন্ধ। তবু আপনার কাছে আশ্রয় চাইব না। ধুঁকে ধুঁকে নিজেকে শেষ করে দেব, তবু আপনার সান্নিধ্যে আর আসব না। বেঁচে থাকা অবধি আর মুখ দেখাব না।
পৃথিবীটা গোল। চলার পথে কখনো দেখা হলে তৎক্ষণাৎ আমি আমার গন্তব্য ফিরিয়ে নেব। মেনে নেব ভাগ্যরেখা। জন্মের পর থেকে হাসতে ভুলে গেছি। বারবার ভুল করতে করতে নিঃশেষ হয়ে গেছি। হারিয়ে গেছে মুখের ভাষা। মরে গেছে স্বপ্নগুলো। হৃদয়ফাটা আর্তনাদে কর্ণযুগল বধির হয়ে গেছে। ভুলে গেছি বংশপরিচয়। এত কিছু সত্ত্বেও নিজেকে মেলে ধরতে চেয়েছি বারবার। ভুল মানুষকে ভালোবাসার চেয়ে বড় আঘাত আর কিছুতে হতে পারে না। পরিপাটি একটা সাজানো–গোছানো জীবন আমারও ছিল। কালের চক্রে কেমন করে এমন নষ্ট হয়ে গেলাম, বুঝে উঠতে পারলাম না। অথচ যার জন্য আমার এই করুণ পরিণতি, সে দিব্যি সুখে আছে। আমার জন্য তার মনে কোনো ভাবনা নেই। আমি এতটা বোকা, কখনো আন্দাজ করতে পারিনি। বোকা না হলে কেউ নিজের সবকিছু বিসর্জন দিয়ে আপনাকে ভালোবাসত না। আমার কষ্টের দিনে হাসিমুখে আপনার মুখ ফিরিয়ে নিলেন। একটু সহানুভূতি দেখালেন না। কতটা সহজে ভুলে গেছেন আমার সাহায্যের কথা।
কখনো তো আপনার ক্ষতি করিনি। আপনাকে নিয়ে কোনো কটূক্তি করিনি। নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে গেছি। অথচ ভালোবাসার দায়ে আপনি আমাকে এতটা কষ্ট দিতে পারলেন? আমার চোখে জল ঝরিয়ে খুব কি সুখ পেয়েছেন? আপনার দেওয়া মানসিক অত্যাচারে আজ আমি ক্ষতবিক্ষত। বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিপরীতে আপনি অনেক সুখে আছেন। শুনেছি, আপনি অন্য কাউকে ভালোবাসেন। তাকে কাছে পাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আমিও চাই, অন্য কাউকে নিয়ে সুখে থাকেন। আপনার প্রতি আমার কোনো দাবিদাওয়া নেই। শুধু বলব, আমার মতো কাউকে এত কষ্ট দেবেন না। বিনা দোষে কাউকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন না। মন ভাঙার আঘাত সবাই সইতে পারে না। অবশ্য আপনি বুঝবেন না, মন ভাঙার আঘাত কতটা ভয়ানক হতে পারে। কাউকে মিথ্যে স্বপ্নের প্রতিশ্রুতি দেবেন না। কাউকে নিঃস্ব করে ছেড়ে দেবেন না।
নির্দিষ্ট কাউকে নিয়ে অনেক সুখী হোন। তার স্বপ্নের মানুষ হয়ে উঠুন। কারও ভালোবাসার অপেক্ষা হোক আপনাকে ঘিরে। আপনার ভালোবাসা পেয়ে কেউ একজন স্নাত হোক। আপনাকে ঘিরে হোক তার সব চাওয়া-পাওয়া। আপনার মুখে হাসি দেখলে ভালো লাগে। আপনার চুলের ভাঁজে ভাঁজে অন্য কারও হাতের ছোঁয়া দেখলে ভালো লাগে। আপনাকে কখনো ঘৃণার চোখে দেখতে পারব না। ভালোবাসার মানুষের জন্য কোনো ঘৃণা থাকতে নেই। আমিও চাই, আপনি আমাকে আমৃত্যু ভুলে থাকুন। কিন্তু আপনাকে ভুলে যাওয়ার কোনো অবকাশ আমার নেই। আমার সব ভাবনা শুধু আপনাকে ঘিরে। আপনার দেওয়া সব আঘাত ফুল ভেবে মনের ক্যানভাসে সাজিয়ে রেখেছি। সময় পেলে একদিন এসে দেখে যাবেন। আপনার জন্য আমার মনের দরজা সব সময় খোলা।
কিন্তু কখনো আপনি আর আমাকে দেখতে পাবেন না। আমি মিলিয়ে গেছি অদৃশ্য প্রকৃতির মধ্যে। অনেক রহস্যের জাল বুনে নিজেকে বিছিয়ে দিয়েছি বিশাল আকাশজুড়ে। একবার বলেছিলেন, আমাকে নিয়ে আপনি পুরো পৃথিবী ঘুরে বেড়াবেন। পাহাড়ি ঝরনায় আমার বুকে মাথা রেখে ভিজবেন। ঝুমবৃষ্টির দিনে অনেক খুনসুটি করবেন। আপনার বলা সব কথাই আমি আত্মস্থ রেখেছি। ভুলে যাইনি কোনো কথা। একটা সময় আপনার কণ্ঠ শোনার জন্য মুঠোফোনের এপারে অনেক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম। রোজ আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইতাম। আপনার মুখের হাসি শোনার জন্য হাজারো কথার ফুলঝুরি সাজাতাম। অথচ সেই আপনি আজ আর আমার নেই। আমার থেকে অনেক দূরে সরে গেছেন। ভুলে গেছেন পুরোনো সব স্মৃতি।
একটা সময় হয়তো আমাকে আপনার ভীষণ মনে পড়বে। একটু কথা বলতে চাইবেন। কিন্তু তখন হয়তো আমি আর থাকব না এই পৃথিবীতে। সাড়া দিতে পারব না। কথায় আছে, মানুষ যখন যা চায়, তখন তা পায় না। যখন পায়, তখন তা চায় না। আপনিও হয়তো আমার জন্য আফসোস করবেন। নিজের ভুল বুঝতে পারবেন। হয়তো ক্ষমা চাওয়ার জন্য অনেক অনুশোচনায় ভুগবেন। কিন্তু আমাকে পাবেন না। আমি চলে যাব অন্তহীন পৃথিবীর পথে। সেদিন আপনার ডাক আমার কান পর্যন্ত পৌঁছাবে না। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হবে না পায়ের তালু। ক্রমাগত হাঁটতেই থাকবে বিমূর্ত মনোভাবে। সেদিন হয়তো আপনার প্রতি আমার মনে প্রচণ্ড অভিমান জন্ম নেবে। শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেহ–মন ফিরে তাকাবে না আপনার দিকে। আপনার চোখে জল ঝরলেও অনুভূতিহীন হয়ে যাব আমি। হয়তো তৎক্ষণাৎ আপনি ভূপৃষ্ঠে লুটিয়ে পড়বেন। এদিকে আমিও অদৃশ্য হয়ে যাব সম্মুখের পথে। চাওয়া-পাওয়ার অনেক ঊর্ধ্বে চলে যাব আপনি–আমি। কেউ কাউকে ‘ভালোবাসি’ বলা হবে না এ মানবজন্মে। আপনি–আমি দুজনই একদিন হেরে যাব প্রকৃতির পালাবদলে। থমকে যাবে সব অনুভূতি। ধুলায় মিশে যাবে ভালোবাসার স্মৃতিচিহ্ন।
চৌহালী, সিরাজগঞ্জ