দেশ ভাগ যে মানুষে মানুষে সম্পর্কের বন্ধনকেও কীভাবে ছিন্ন করে দেয়, সেই টালমাটাল পরিস্থিতির একটুকরা ঐতিহাসিক কাহিনির দর্পণ প্রতিফলিত হলো চলচ্চিত্রে।
দুটি দৃশ্য—মা ও মাটির প্রতি সন্তানের যন্ত্রণা তীব্রতর হয়ে ফুটে ওঠে এই চলচ্চিত্রে। মণীন্দ্র সরকারের মা জ্ঞানদাসুন্দরী মারা যাওয়ার আগে স্বামীর বলে যাওয়া কথাটা সন্তানকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, সাত পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে মণীন্দ্র যেন কখনো চলে না যায়। দেশ ও মাতৃ অন্তঃপ্রাণ মণীন্দ্র কথা দেয়, সে যাবে না। মাতৃবিয়োগের মুহূর্তে দিশেহারা, উন্মাদের মতো মণীন্দ্র ঘর ছেড়ে উঠানে ছুটে এসে বুকফাটা আর্তনাদ করে ওঠে। মাতৃহারা সন্তানের এই আর্তনাদ পূর্বপুরুষের ঘরে বাতি হয়ে জ্বলে কি না, জানি না; তবে পৃথিবীর আকাশ–বাতাস কেঁদে ওঠে। চোখের জলে জননী জন্মভূমির মাটি ধুয়ে যায়।
মণীন্দ্র চরিত্রে আহমেদ রুবেলের অভিনয়ও বহুদিন মনে থাকবে। শুধু সংলাপ বলার মুহূর্তগুলো নয়, সংলাপহীন বিশেষ বিশেষ মুহূর্তের অভিব্যক্তিও লক্ষণীয়; যেন এক সরব ও নীরব ভালোবাসার বুনন, সৃষ্টিশীল দক্ষতায় জন্মভূমির মাটিকে জাগিয়ে রাখেন তিনি। জন্মভূমিকে মাতিয়ে রাখেন। সদ্য প্রয়াত রুবেলের মতো অভিনেতার অভাব সহজে পূরণ হওয়ার নয়।
দ্বিতীয় দৃশ্যটি হলো, ভরত দাস দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আসামের মুসলিম পরিবারের সঙ্গে জমি বিনিময় পর্ব অনেকেরই হয়ে গিয়েছে। ধর্মের ভিত্তিতে দেশটা ভাগ হয়ে যাচ্ছে। মুসলমানরা মনে করছে মুসলমানের দেশ পাকিস্তানে এসে তারা ভালো থাকবে। হিন্দুরা ভাবছে, হিন্দুর দেশ ইন্ডিয়ায় বোধ হয় সকাল–সন্ধ্যা শুধু মন্দিরের ঘণ্টা ধ্বনি বাজে আর আকাশ থেকে দেবতার পুষ্পবৃষ্টি হওয়ার মতো রোজ দুই বেলা খাবার ঝরে পড়ে। এই ভরত মণীন্দ্রের কাছেও জমি বিনিময়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। গোঁয়ার গোবিন্দকে একরোখা মণীন্দ্র মুখের ওপর সাফ জানিয়ে দিয়েছে, দরকার হলে সে মুসলিমদের সঙ্গে থাকবে, মুসলিমদের সঙ্গে খাবে; তবু বাপ–ঠাকুরদার ভিটেমাটি ছেড়ে কোথাও যাবে না। বিদায়বেলায় ঘরের মহিলা মরাকান্না জুড়েছে, ভরতকে তখনো বেশ শক্ত একজন মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। এই তো অল্প দূরেই ইন্ডিয়া, যখন মন চাইবে সে জন্মভিটায় এসে সবার সঙ্গে আবার দেখা করে যাবে, যেন শুধু একটা সাঁকো পারাপারের খেলা! সেই মুহূর্তে মণীন্দ্র শুধু তাকে জিজ্ঞাসা করে, তুমি পারবে আসতে?
মুহূর্তের মধ্যে দুই চোখ ছলো ছলো, নেমে এল বাঁধফাটা যন্ত্রণার আর্তনাদ। লোহার মতো মানুষটা যেন এক পরশমণি মণীন্দ্রের স্পর্শে হয়ে উঠল সোনা। বুক ডুকরে কেঁদে ভাসিয়ে আর্তনাদ করতে লাগল, ‘এটা আমার বাড়ি, আমার উঠান, আমার গাছ...।’ এই মায়ার সংসার ছেড়ে কোথাও কি চলে যাওয়া যায়! জন্মভিটার মাটি আঁকড়ে ধরে তুলে সে বউয়ের আঁচলে বেঁধে দেয়। মৃত মানুষকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার সময় এভাবে পুঁটলিতে কিছু খাদ্যশস্য বেঁধে দেওয়া হয়। দেশান্তরী এই মানুষগুলোও আজ যেন মৃত।
দেশ বিভাজনের করুণ অবস্থা নিয়ে মা-মাটি ও মানুষের মর্মস্পর্শী সম্পর্কবিজড়িত ‘দেশান্তর’ উপন্যাসটি লিখেছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। সেই উপন্যাসের গভীর মর্মব্যথাকে অনুপম চলচ্চিত্রায়িত করলেন কবির জামাতা আশুতোষ সুজন। যথাযথ চিত্রনাট্য লিখেছেন ‘পেয়ারার সুবাস’খ্যাত নুরুল আলম আতিক, সঙ্গে ডালিম কুমার ও আশুতোষ সুজন। গোটা চলচ্চিত্র নির্মাণের অন্তরালে কবি নির্মলেন্দু গুণের কন্যা পরিচালক মৃত্তিকা গুণেরও নিশ্চয়ই অলিখিত অনেক ভূমিকা রয়েছে। মণীন্দ্র সরকারের দুই ছেলে অমল আর কমলের অভিনয়ে একজন তো তূর্য ইতিমধ্যেই বেশ পরিচিত দক্ষ শিশুশিল্পী। তানভীর মোকাম্মেলের ‘রূপসা নদীর বাঁকে’ চলচ্চিত্রেও তাকে দেখেছি। ছোট অমল–কমলের ভূমিকায় আশুতোষ-মৃত্তিকার সন্তানকেও দেখলাম মনে হয়। ঠিক চিনতে পারলাম না। তবে একজন পরিচালকের কাছে ছোট ছোট সব শিল্পীই তো সন্তানসম।
নেহাল কোরাহৈসির চিত্রগ্রহণ চমৎকার। জাহিদ নীরবের সংগীতমূর্ছনা দারুণ। গ্রামবাংলার মেঠো ছবি, সুর এবং ঘটনার ঘনঘটার ব্যঞ্জনাকে দুজনই অনবদ্য রূপ দিয়েছেন। চিত্রনায়িকা মৌসুমীকে এখানে দেখলাম একেবারে অন্য রকম মণীন্দ্রের স্ত্রী অন্নপূর্ণার ভূমিকায়। বিকল্পধারার পরিচালকেরা এভাবেই একজন শিল্পীর প্রকৃত অভিনয়সত্তাকে তুলে আনতে পারেন। বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের চাকচিক্যের আড়ালে অনেক সময় শিল্পীসত্তা ঠিকমতো পরিস্ফুটিত হয় না। আবার একজন অভিনয়শিল্পী যে চিরকাল নায়ক-নায়িকা থাকবেন, বয়সের সঙ্গে তা–ও হওয়ার নয়। যেকোনো চরিত্রের মধ্যেই নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে পারলে শিল্পীসত্তার জগৎ প্রসারিত হয়। মৌসুমী গ্রাম্য মধ্যবয়সী অন্নপূর্ণার চরিত্রে অভিনয় করে নিজের জাত চিনিয়েছেন।
কবি নির্মলেন্দু গুণ ও আশুতোষ সুজন কিন্তু এ চলচ্চিত্রে অত্যন্ত সংযত ও সংবেদনশীল হয়ে বলতে চেয়েছেন সেই সব সংখ্যালঘু মানুষের কথা, যারা কোনো অবস্থাতেই জননী জন্মভূমিকে ছেড়ে যায়নি।
প্রথম চলচ্চিত্রে মণীন্দ্র আর অন্নপূর্ণার মেয়ে মনসার চরিত্রে অভিনয় করে রোদেলা টাপুর একেবারে ফাটিয়ে দিয়েছেন। ফুল কুড়ানিয়া, গাছে চড়ে বসা গ্রামীণ চঞ্চলা নবীন কিশোরীটি যে বাবার চোখে স্বয়ং জগৎকালী। এই কন্যার জন্মক্ষণে বাবা দুই পুত্রের সঙ্গে বেড়া বাধঁতে বাধঁতে কালী এসে রামপ্রসাদের বেড়া বেঁধে দেওয়ার সেই চিরন্তন গল্প বলছিল। গল্প চলাকালীন যেন মহাকালের এই কালীর আবির্ভাব। মনসা নামটির মধ্যেও গ্রামবাংলার চিরাচরিত পূজিত সর্পের দেবী বিরাজমান। নিম্নশ্রেণির মানুষের দেবী হলেও এই দেবীকে ঘিরে গ্রামবাংলার চিরাচরিত সংস্কৃতির লোককথা, লোকগানের বহর কিন্তু অনেক বড়। তাই মনসা আবহমান কালের বঙ্গসংস্কৃতির প্রতীকী রূপ।
আবার চট্টগ্রামের শাক্ত ঠাকুমার কাছে কালী ও ভক্ত রামপ্রসাদের গল্পগুলো একসময় আমিও যে কত শুনেছি! রাউজান উত্তরগুজরা গ্রামে আমার বাবা, ঠাকুমার প্রতিষ্ঠিত কালীমন্দির এখনো আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পরিবেশ–পরিস্থিতির চাপে পড়ে আমরা দেশান্তরী উদ্বাস্তু হয়ে গিয়েছি।
গোটা পশ্চিমবঙ্গেও এমন অসংখ্য চট্টশ্বরী, ঢাকেশ্বরী, কুমিল্লাশ্বরী মন্দির আছে। এসব মন্দিরের উপাস্য দেবীরা সবাই মূলত কালী। ভিন্ন ভিন্ন আঞ্চলিক রূপে এক কালীর বহু রূপ। চট্টশ্বরী মন্দিরে চট্টগ্রামের ব্রাহ্মণ দ্বারা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক আচার–আচরণে পূজা হয়। দুই বাংলার অন্য সব অঞ্চলের মানুষও পূজা দিতে আসে। কিন্তু চট্টগ্রামের মানুষ থাকে বেশি। ঢাকেশ্বরী, কুমিল্লাশ্বরী প্রভৃতি মন্দিরও একই রকম। আসলে এসব মন্দিরের মধ্যে দিয়ে এককালে দেশ ছেড়ে আসা উদ্বাস্তুরা নিজেদের জননী জন্মভূমিকেই পূজা করে বলে মনে করি। জননী জন্মভূমির টানে আঞ্চলিকতাকে বজায় রেখে বিশ্বপ্রাণ ছোঁয়ার এক বিপুল আয়োজন।
আবার আমার মতো অনেক মানুষও তো আছে, দেশ ছেড়ে আসার যন্ত্রণায় যাঁরা সব অলৌকিক ভক্তি–বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। নাস্তিক জীবন যাপন করেন, যা কিছু যুক্তিযুক্ত, তাকেই বিশ্বাস করে। অন্তরে হারানো বেদনার বাঁশি বাজে। জননী জন্মভূমির সঙ্গে আমাদেরও নাড়ির টান কোনো দিন ছিন্ন হওয়ার নয়।
কবি নির্মলেন্দু গুণ ও আশুতোষ সুজন কিন্তু এ চলচ্চিত্রে অত্যন্ত সংযত ও সংবেদনশীল হয়ে বলতে চেয়েছেন সেই সব সংখ্যালঘু মানুষের কথা, যারা কোনো অবস্থাতেই জননী জন্মভূমিকে ছেড়ে যায়নি। মনসার বিয়ে ঠিক হয়েছে কাজলার অনিল ধরের ছেলে হিমাংশুর সঙ্গে। হিমাংশু গোটা গ্রামের একমাত্র ম্যাট্রিক পাস ছেলে, চন্দ্রনাথ স্কুলে মাস্টারি করে। তখনকার দিনে এই ম্যাট্রিক পাসের কদর যে কত ছিল, সবার কথাবার্তায় তা বোঝা যায়। আমাদের এ সময়ের কত শত শত বিএ, এমএ পাস ছেলেও এত কদর পায় না। এই ম্যাট্রিক পাসের এত কদর ছিল বলেই আন্ডার–ম্যাট্রিক পাত্রও অনেক সম্মান পেত। মানে পাস করতে পারেনি তো কী হয়েছে! ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়াশোনা তো করেছে পাত্র।
হিমাংশুর বাবা অনিল ধর মণীন্দ্রের মন জয় করে নিয়েছে। দেশের মাটি হলো স্বর্গ, মরলেও এখানে বাঁচলেও এখানে—এসব কথাবার্তা বলে। আসলে ভারতে তারও যোগাযোগ পর্ব মিটে গিয়েছে। সেখানে গেলে হিমাংশুর জন্য ভালো পাত্রী পাওয়া যাবে কি যাবে না, তাই আগেভাগে বিয়েটা করিয়ে নিতে চায়। আর মিষ্টি কথার ফাঁদে পা দিয়ে মনসাকে হিমাংশুর হাতে তুলে দেয় মণীন্দ্র। গ্রাম্য বধূরূপে রোদেলা টাপুর এখানেও নজর কেড়েছেন। হিমাংশু চরিত্রে ইয়াশ রোহানও যোগ্য।
মনসার সঙ্গে হিমাংশুর প্রেম, সংসার জমে ওঠেছিল। হিমাংশু মনসাকে কথা দিয়েছে, মনসা না গেলে সে–ও দেশ ছেড়ে যাবে না। বাপের উপযুক্ত মেয়ে মনসাও কোনো অবস্থাতেই দেশ ছেড়ে যেতে চায় না। মণীন্দ্র এসে কন্যাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে নিয়ে যায়। আর যোগীশাসন গ্রামে সবাইকে অবাক করে দিয়ে কাজলার অনিল ধরের দেশান্তরী নৌকা এসে ভেড়ে।
মণীন্দ্র বেয়াইয়ের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়ে, সম্পর্ক ছিন্ন করে। মনসা প্রতিবেশীর ঘরে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। সে এখন স্বামী আর শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে দেশ ছেড়ে যাবে কি না, তার জন্য রাতে সালিসি সভা বসে।
দেশ ভাগ যে মানুষে মানুষে সম্পর্কের বন্ধনকেও কীভাবে ছিন্ন করে দেয়, সেই টালমাটাল পরিস্থিতির একটুকরা ঐতিহাসিক কাহিনির দর্পণ প্রতিফলিত হলো চলচ্চিত্রে। ‘জননী জন্মভূমি স্বর্গাদপি গরীয়সী…’ বগা তালেবের গানটা ভালো লাগে। ‘আমার স্বপ্নের হাতে হাত কড়া…’ আশুতোষ সুজন এবং অবন্তী দেব সিঁথির কণ্ঠে কোমল নিঠুর চিকন সুরের গানটা আরও বেশি ভালো লাগে। শফি মন্ডলের রামপ্রসাদী গানও গভীর বেদনার মধ্যে ভাবের সাগরে ডুবিয়ে দেয়। অনেক যত্ন করে আশুতোষ সুজন বানিয়েছেন এই চলচ্চিত্র।
কত হিমাংশুরা প্রাণপ্রিয়া রাধাকে ছেড়ে পরিবেশ–পরিবার–পরিস্থিতির চাপে পড়ে দেশ ছেড়ে চলে গেছে। ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।
শামসুর রাহমানের কবিতা আজও বড় বেশি করে নাড়া দেয়, ‘এ পবিত্র মাটি ছেড়ে কখনো কোথাও, পরাজিত সৈনিকের মতো সুধাংশু যাবে না’। ‘দেশান্তর’ সেই বার্তা বয়ে আনে।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত