কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে…।’
পরিকল্পনা করেও ভ্রমণ বাতিল হওয়ার ঘটনা অনেক আছে। তাই এবার আর কোনো রিস্কে যাইনি। বাংলাদেশ রেলওয়ের সাইটে একটা ফাঁকা সিট, তিন মিনিটের সিদ্ধান্ত, টিকিট কাটা, ব্যস। এবার একাই ছুটে যাই চা–বাগানের ডাকে সিলেটে। বৃহস্পতিবার অফিস শেষ করে রাতের ট্রেনে উঠলাম জীবনের প্রথম সিলেট দর্শনের উদ্দেশে।
লম্বা যাত্রায় বাসে-ট্রেনে ঘুমানোর বাতিক অনেক দিনের। ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সামনের ছোট্ট টেবিলে মাথা দিয়ে ঘুম। শেষ রাতের দিকে প্রচুর শোরগোল, চিৎকারে ঘুম ভাঙল। অনেকটা হুড়মুড়িয়েই উঠলাম। এই ধর, ধর…পেছনের সিটের নারীর ভয়ার্ত কান্নাভেজা কণ্ঠ, ‘ছাইড়া দেন মইরা যাবে তো।’
ঘটনা বুঝতে বেশিক্ষণ লাগল না। চলন্ত ট্রেনের খোলা জানালা দিয়ে বাইরে থেকে ছিনতাইকারী হাত বাড়িয়ে মুঠোফোন নেওয়ার সময় পেছনের একজন হাত ধরে ফেলে। তারপর অন্যরাও সেই হাত টেনে ধরে। কিন্তু যখন জানালা খুলে তাঁকে ভেতরে আনতে যাবে, তখনই সবার হাতে ব্লেড বা চাকুজাতীয় কিছু দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে শুরু করে। সেটা সামাল দিতে না পেরে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। গুরুতর কিছু না হলেও যাঁরা ধরেছিলেন, মোটামুটি সবার হাতেই জখম হয়েছে, রক্ত পড়ছিল। বাকি রাত কেটেছে আলোচনা–সমালোচনায়। কখন ঘুমিয়েছি জানি না। ঘুম ভেঙেছে, যখন ভোরের কুয়াশামাখা আবছা আলো দেখা যাচ্ছিল জানালা দিয়ে।
সিলেট স্টেশনে ট্রেন থামল ভোরে। স্টেশন দেখে অবাক হলাম, ভেবেছিলাম অনেক গোছানো, ঝকঝকে হবে। কিন্তু তেমন কিছু না, কাজ চলছে। জীবনের প্রথম সিলেটে পা রাখছি। কেউ নেই সঙ্গে, একা। পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে পরিচিত এক ছোট ভাইকে কল দিলাম। সে শহরেই থাকে। সঙ্গ দেওয়ার কথা। তাঁর আসতে একটু সময় লাগবে; ভাবলাম এই ফাঁকে হজরত শাহজালালের দরগাহ থেকে ঘুরে আসি। একটা অটোরিকশা নিয়ে চলে গেলাম দরগাহ গেটে।
দলে দলে মানুষ আসছে। ভেতরে ঢুকে অনেকক্ষণ কবুতর দেখলাম। শত শত কবুতর বসে আছে ওপরে। অনেকেই ছবি তুলছে, ভিডিও করছে। একসঙ্গে যখন উড়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বসছে, চমৎকার সেই দৃশ্য। সেখান থেকে গেলাম মাছ দেখতে। পুকুরের চারপাশে মানুষের ভিড়। বড় বড় শীল, গজারগুলো একদম কিনারায় ভিড়ে যেন মানুষের ডাকে সাড়া দিচ্ছিল। তাদের দেওয়া খাবার খাচ্ছিল।
ঘড়িতে সময় তখন সকাল প্রায় ৭টা। এরই মধ্যে ছোট ভাই এসে যাওয়ার কথা। কিন্তু মুঠোফোন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হলাম তার সঙ্গে। মাজারে এত মানুষের মধ্যে এমনিতে খুঁজে পাওয়াও মুশকিল। মিনিট ত্রিশেক অপেক্ষা করলাম গেটের একপাশে। না পেয়ে ভাবলাম সময় নষ্ট করে কী লাভ। রিকশা নিয়ে চলে গেলাম কদমতলী বাসস্ট্যান্ডে, গন্তব্য শ্রীমঙ্গল। বাসস্ট্যান্ডেও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম তার জন্য, ভাবলাম যদি খুঁজে এখানে আসে। কিন্তু তার সঙ্গে আর দেখা হলো না। একাই শ্রীমঙ্গল গিয়ে পৌঁছালাম বেলা সাড়ে ১১টার দিকে। মুঠোফোন পুরোপুরি বন্ধ। কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই।
কোথায় ঘুরব, কী করব এসব নিয়ে আগে থেকে কোনো পরিকল্পনা করিনি। ভেবেছিলাম ছোট ভাই যেহেতু আছে, এসব নিয়ে ভাবার কী দরকার। না থাকলেই–বা কি, মুঠোফোনে দেখলেই সব পাওয়া যাবে। মুঠোফোন বন্ধ হয়ে সব হিসাব গোলমেলে করে দিল। মানুষের থেকে জিজ্ঞেস করে উপায় খুঁজে বের করলাম ঠিকই, কিন্তু সমস্যা দাঁড়াল একা যাওয়া নিয়ে। রিজার্ভ ছাড়া কেউ যেতে চাচ্ছে না। রিজার্ভ করে গেলেও বেশ মোটা টাকা গুনতে হবে। তার মধ্যে জানাশোনা নেই কিছুই। হাঁটতে হাঁটতে শ্রীমঙ্গল স্টেশনের দিকে গেলাম, সেখানে গ্রুপ দেখে হঠাৎ মনে পড়ল আমি গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছি না কেন।
সাতজনের একটা গ্রুপ অটোওয়ালার সঙ্গে কথা বলছিল। একজনকে বললাম, ‘ভাই ঢাকা থেকে একা এসেছি। আপনাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়া যাবে?’ একজনের মুখে আরেকজন তাকাল, বলল, ‘সলো ট্রাভেলার? এভাবে ঘুরাই মজা। সমস্যা নেই। চলেন।’
তারপর আরও কিছু টুকটাক কথাবার্তা হলো। নাশতা করলাম একসঙ্গে। দুইটা সিএনজি নিয়ে রওনা হলাম। প্রথমে গেলাম এম আর খান চা-বাগানের দার্জিলিং টিলাতে।
সারি সারি চা–বাগান। মাঝখানের রাস্তা দিয়ে হাঁটছি আমরা। নয়নাভিরাম দৃশ্য। হালকা কুয়াশা থাকলেও চা–বাগানের ভেতর শীতের মাত্রা যেন কমে এসেছিল। সেখানে একটা মিরাকল ঘটল। পাহাড় থেকে নামার সময় সেই ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। সেও আমার মতো একটা গ্রুপে যুক্ত হয়ে এদিকে এসেছে। ধরেই নিয়েছে, এখানে এলে হয়তো আমাদের দেখা হয়ে যাবে। সেও আমার মতো দরগাহর গেট আর বাসস্ট্যান্ড—দুই জায়গাতেই অপেক্ষা করে আসছে। তারপর আর কি, আবার দলবদল। তাদের ছেড়ে নতুন দলে এসে ভিড়লাম। মুঠোফোন তখনো বন্ধ। দার্জিলিং টিলাতে পাহাড়ের আনাচকানাচে ইচ্ছেমতো ঘুরাঘুরি হলো।
সেখান থেকে অটো করে সবাই মিলে রওনা দিলাম লাল পাহাড়ের উদ্দেশে। এত দিন যে ছবি, ভিডিও অনলাইনে দেখে আসছিলাম। যে সিলেটের চা–বাগানের গল্প শুনে আসছিলাম, সেগুলো চোখের সামনে। চর্মচক্ষু দিয়ে উপভোগ করছি সৌন্দর্য। সবুজ বাগানের মধ্যে রাস্তা ধরে লাল পাহাড়ের উদ্দেশে রওনা দিলাম আমরা ছয়জন, সঙ্গে একজন গাইড। তিনিই গল্প বলতে বলতে আমাদের নিয়ে যাচ্ছিলেন।
সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমাকাশে। রক্তিম আলোয় পাহাড়ের লাল মাটি যেন আরও লাল হয়ে উঠেছে। নিঃসঙ্গ একাকী টিলাগুলোকে সঙ্গ দিচ্ছে অযুত–সহস্র চা–গাছ। কোনটার বয়স কত, কে জানে! সূর্যের আলো যখন নিবু নিবু, তখন ফেরার পথ ধরলাম। আবার অটোতে করে শ্রীমঙ্গল বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশে। পথিমধ্যে একটা দোকানে সিলেটের সেই বিখ্যাত সাত রঙের চা খেতে ভুলিনি। যদিও তেমন স্বাদ খুঁজে পাইনি। বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে করে আবার সিলেট গিয়ে শহরে অনেকক্ষণ ঘুরাঘুরি। তারপর খাওয়াদাওয়া করে রাতের বাসে ঢাকায়।
মিরপুর ১০, ঢাকা