‘সুড়ঙ্গ’ সময় এবং জীবন খুঁড়ে চলার একটি দুর্ধর্ষ চলচ্চিত্র

‘সুড়ঙ্গ’ চলচ্চিত্রে তমা মির্জা ও আফরান নিশোছবি : চরকির সৌজন্যে

রায়হান রাফীর ‘সুড়ঙ্গ’ দেখার পর প্রথমেই মনে হতে পারে, গল্পটা বড় একপেশে। নারীরাই সব সর্বনাশের মূল। নারীর জন্য মানুষ বিপথে চালিত হয়। সুস্থ, সুন্দর জীবন হঠাৎ সংসার, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র—সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। নারীর প্রেমের আলোকে মজে জীবনে হঠাৎ অন্ধকার নেমে আসে। এই চলচ্চিত্রে যেমন দেখলাম, গ্রামের এক ইলেকট্রিশিয়ান মাসুদ, ফ্রিজ, টিভি প্রভৃতি বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি সারানোর যার দোকান আছে, ময়না নামের মধ্যবিত্ত ঘরের এক সুন্দরী কন্যার প্রেমে পড়ল। সবার মতামত নিয়ে সামাজিকভাবেই যাদের প্রেম পূর্ণতা পেল, দুজনের বিয়ে হলো। বিয়ের পর স্ত্রীর একটার পর একটা চাহিদা মেটাতে গিয়ে স্বল্প আয়ের কারিগর মাসুদ নাস্তানাবুদ। অর্থনীতির ভাষায় একটা কথা আছে, মানুষের চাহিদা অসীম, কিন্তু একটা নির্দিষ্ট কোনো চাহিদা সসীম। মহাত্মা গান্ধীও বলে গিয়েছেন, ‘প্রতিটি মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটানোর মতো সম্পদ পৃথিবীতে আছে। কিন্তু মানুষের লোভ মেটানোর মতো সম্পদ নেই।’ মাসুদ আর ময়নার ছোট্ট প্রেমের সংসার, যৌবনের মন উড়ু উড়ু করা ভালোবাসার আকুলিবিকুলি পরিচালক ছোট ছোট দৃশ্যে সুন্দর রূপ দিয়েছেন। হয়ে যেতে পারত আর দশটা ছবির মতো এটা একটা সুন্দর রোমান্টিক ছবি।

কিন্তু ময়নার অপরিসীম চাহিদা বাদ সাধল। মাসুদকে শ্রমিকের চাকরি নিয়ে বিদেশ যেতে হলো। সেখানে গিয়ে যে পরিমাণ অর্থ আয়ের স্বপ্ন ও সম্ভাবনা ছিল, বাস্তবে দেখা গেল সে ঠকেছে। এদিকে স্বামীর কাছ থেকে চাহিদামতো অর্থ না পেয়ে আশাহত হয়ে এবং যৌবনের শারীরিক চাহিদা পূরণে ভালোবাসার ময়না মাসুদের বন্ধু জহিরের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। একসময় জহিরের সঙ্গে চলে যায়। মাসুদ দেশে ফিরে এসে প্রাণপ্রিয়া ময়নার বিরহে কাতর। বুঝল, টাকা ছাড়া এখানে ভালোবাসাও বশ মানে না। সৎ পথে টাকা আয়ের কোনো উৎস খুঁজে না পেয়ে ময়নাকে ফিরে পাওয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত অসৎ পথে বিপুল অর্থ পাওয়ার নেশা তাকে পেয়ে বসে। সে একটা সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ব্যাংক লুট করতে যায়।

এখানে সুড়ঙ্গ খোঁড়াটাকে আক্ষরিক সুড়ঙ্গ খোঁড়া ভেবে না নিয়ে, জীবন খুঁড়ে চলা ভেবে নেওয়া যেতে পারে। কারণ, ভালোবাসাহীন বিধ্বস্ত পরাহত জীবন তাকে আজ এখানে টেনে এনেছে। একজন মানুষ সারা জীবন যে কতভাবে দুঃখ খুঁড়ে চলে, এই সুড়ঙ্গ খোঁড়া তারও একটা রূপক। যদিও বাস্তবে এ রকম সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ব্যাংক ডাকাতির নজিরও আছে। আগেকার দিনে ব্যাংক ব্যবস্থা সুলভ না থাকাতে যক্ষের ধনের মতো অনেকেই মাটি খুঁড়ে নিজের সোনাদানা, মুদ্রা লুকিয়ে রাখতেন। অনেকে মাটি খুঁড়ে সেই সব সম্পদ পেয়েছেন। সুতরাং অপ্রত্যাশিত কিছু লাভ করার নেশাও কিন্তু মানুষের মধ্যে বরাবর সুপ্ত রয়েছে। রায়হান রাফীর গল্পের গতি সব সময় দারুণ টানটান। রোমান্টিক গল্প তাই একসময় থ্রিলার হয়ে দাঁড়ায়। এখানেও দেখি পুলিশের ঘোষণামতো পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার পাওয়ার লোভে জহিরের কূটকচালিতে ময়না মাসুদকে ধরিয়ে দেয়।

জেল পালানো আসামি নিজে লুট করতে গিয়ে অন্যের হাতে লুট হয়ে যাওয়া ব্যাংকের সব টাকা পুনরায় উদ্ধার করে। একসময় ময়নাকেও নাগালে পেয়ে যায়। কিন্তু ভোগ না করে বিপুল টাকা সমেত ময়নাকে সে অন্য একটা সুড়ঙ্গের ভেতরে ঢুকিয়ে পেট্রল ঢেলে জ্বালিয়ে দেয়। ভয়ংকর একটা দৃশ্য। উৎপল দত্তের ‘অঙ্গার’ নাটকে জলবন্দী কয়লাখনির শ্রমিকদের আর্তনাদের মতো ময়নার মরণ আর্তনাদ ভেসে আসে।

‘সুড়ঙ্গ’ সিনেমার পোস্টার
ছবি: ফেসবুক

এখন বিষয়টাকে যদি বাড়িতে বউরা সারাক্ষণ টাকাপয়সা নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করে বলে, সবাই এভাবে গর্তে ঢুকিয়ে জ্বালিয়ে দিতে চায়—গরিব জনসংখ্যাবহুল দেশগুলোতে পুরুষশাসিত সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা যেভাবে প্রতিনিয়ত বাড়ছে, এ ধরনের একপেশে ধারণা সেই সব পুরুষকুলের অন্তর্নিহিত হিংস্রতাকে উসকে দেবে। আবার মুক্তিযুদ্ধের ‘গেরিলা’ চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যে আমরা দেখেছি জয়া আহসান আত্মঘাতী বিস্ফোরণে সব শত্রুকে উড়িয়ে দিয়ে দেশের জন্য প্রাণ দিচ্ছেন। সেই মুক্তিযুদ্ধের দেশে একজন নারীকে জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, অর্থলোভী হয়ে উঠেছে বলে। দুটি দুই মাত্রিক বিস্ফোরণ। তাই নারী শব্দটাকে উহ্য করে নিয়ে এখানে একজন অসীম চাহিদার বশবর্তী লোভী মানুষ হিসেবে দেখাটায় ভালো। লোভীদের লিঙ্গান্তর হয় না। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যুর চিরাচরিত সত্যির প্রতিধ্বনিত হয় শুধু।

এই লোভী মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা জহিরকেও দেখলাম। সে আপাদমস্তক একজন নারীলোভী। অনবরত পরকীয়ার টানে ছোটে। বাংলাদেশ থেকে যে দলে দলে শ্রমিকদের বিশ্বের নানা দেশে পাচার করা হয়, সেখানে গিয়ে তাঁরা নানা রকম হেনস্তার শিকার হন— এই বিষয়টিও সুন্দর উঠে এসেছে। প্রেম, যৌনতা, প্রতিহিংসা, খুন, যখম, হানাহানি ঝাড়পিটের সুপারডুপার হিট অসংখ্য ছবি প্রতিনিয়ত তৈরি হয়। কিন্তু বর্তমানে অনবরত পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থায় সাইকো কিলারদের নিয়ে ছবি তৈরির ঝোঁক ক্রমেই বাড়ছে। অপরাধীদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে গবেষণামূলক কাজ হচ্ছে হোক। কিন্তু সুড়ঙ্গের যেমন প্রবেশদ্বার আছে, নিষ্ক্রমণের পথও আছে। সেই সবও জনমানসে সচেতনতার জন্য তুলে আনা দরকার। রাফী অবশ্য একজন মধ্যবিত্ত সন্তানের লড়াই করে বেঁচে থাকার পথে, বাস্তবের সঙ্গে সংঘাতে বিপথে চালিত হওয়ার গল্পটা সুন্দর চিত্রায়িত করেছেন।

চলচ্চিত্র মানুষকে আনন্দ দেওয়ায় জন্য, সেই সত্য থেকে রায়হান রাফী তরুণ প্রজন্মের সফল পরিচালক। বাস্তবে এখানে এত সুন্দর জলজ্যান্ত একটা সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়েছে—ছবির মূল গল্প, চিত্রায়ণ, দৃশ্যায়নে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সুড়ঙ্গের সঙ্গে ম্যানহোলের যোগসূত্র খোঁজাটা ঠিক নয়। শহরের ম্যানহোলে দূষিত, বিষাক্ত জল থাকে। বিষাক্ত জলের গ্যাসে মানুষের পর্যন্ত হয়। রাফীর সুড়ঙ্গ আসলে কিছুটা রূপকথার পাতালঘরের রাস্তা।

মাসুদ চরিত্রে আফরান নিশো আগাগোড়া দুর্দান্ত, সুন্দর সাবলীল অভিনয় করেছেন। ময়না চরিত্রে তমা মির্জা চমৎকার। নৃত্যশিল্পী নুসরাত ফারিয়া নেশা ধরিয়ে দেন। গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তা আপেল খান চরিত্রে কিংবদন্তি বর্ষিয়ান অভিনেতা শহীদুজ্জামান সেলিম অনবদ্য। চাটগাঁইয়ারা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার সময়েও যে চাটগাঁইয়া টানটা থেকে যায়, সেলিম সেখানে অনবদ্য রূপ দিয়েছেন। আমার মা–বাবাও চিরকাল এভাবেই চাটগাঁইয়া টানে শুদ্ধ ভাষায় আমাদের সঙ্গে কথা বলে এসেছেন। বর্তমানে আমাদের নোবেলজয়ী প্রধান উপদেষ্টাও যখন অনবরত প্রমিত শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে যান, কথার ভেতরে আঞ্চলিকতার এই টান স্পষ্ট অনুভব করি। কলকাতার কোনো বাঙালি এই বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারবেন না। অন্য সবার অভিনয় এবং ছবির তরতাজা সমসাময়িক ভাষার অনুভবের গানগুলো ভালো লাগে। কলাকুশলীরা যথেষ্ট শক্তিমান। রাফী আসলে কথায়, সুরে, ছন্দে, সংলাপে, গল্পের গতিময়তায় আধুনিক মনের ভাষা, বর্তমান সময়ের ক্ষত, জ্বালাপোড়া যন্ত্রণা, প্রেম–বিরহ বিচ্ছেদের সঙ্গে ভীষণভাবে সম্পৃক্ত থাকেন। চলমান সময়ের সুড়ঙ্গ খুঁড়ে তাই এমন দুর্ধর্ষ ছবি উঠে আসে।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত